কয়েকদিন ধরে জানালার বাইরে একটা দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। কলকাতা বা অন্য যে কোন শহরের সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্য বোধ করি এখন এটাই, একটা বহুতল বাড়ি তৈরির প্রস্তুতি চলছে। আপাতভাবে নতুন কিছু নেই। এখানে একটা পুরোন বাড়ি ছিল। একটু জীর্ণ চেহারার। মালিকরা থাকত না, মানে আমি গত পাঁচ বছরে দেখিনি। গজিয়ে ওঠা ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে আবছা দেখা যেত দু একজন মিস্তিরি ধরণের লোক থাকে। একবার কিছুদিন তাদের কোনও একজনের বৌও ছিল। তখন আমার রান্নাঘরের জানলা দিয়ে দেখা যেত খুব কম আলো ভাঙা ভাঙা ঘরটার ভেতরে দেওয়ালে একটা রঙিন ক্যালেন্ডার ঝুলছে। কিছুদিন পর বাড়িটা ভেঙে ফেলা শুরু হল। যারা থাকছিল তারাই ভাঙার কাজটা করল কি না জানিনা। আবার বেশ কিছুদিন পড়ে রইল জায়গাটা।
এক দুটো গাছ গজাল, তারপর বর্ষায় একেবারে জঙ্গল হয়ে উঠল। চারপাশে যেন কলকাতার ব্যস্ত নাগরিকতা নয়, নিশ্চিন্দিপুর কিম্বা গোরাবাড়ি। গাছেদের কাণ্ডই আলাদা। যেই একটু ফাঁকা জায়গা পেয়েছে আর লোকেদের অন্যমনস্কতার একটু ফাঁক, অমনি গুটিগুটি সেখানে এসে হাজির। আর তারা তো একা আসেনা, পাখি কাঠবেড়ালি ফড়িং পোকপতং হাজারখানা এনে এমন নিজেদের সংসার পেতে বসবে যেন কোন তাড়াহুড়োই নেই। কবে হাজার দুহাজার বছর আগে কেমন ভাবে থাকত, তার সব মনে করে গুছিয়ে এনে উপস্থিত। কিন্তু তেমন তো আর নেই কিছুই। কাজেই শরতের শুরুতেই একদিন দেখি বড় গাড়ি করে লোকজন এসে কোদাল কুড়ুল দিয়ে গাছপালা কেটেকুটে সাফ করে দিয়েছে। পাখিরা কাঠবেড়ালিরা মহা ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। পোকাদের দেখা যাচ্ছেনা ভাগ্যিস। বাড়ি হারিয়ে বিপদে পড়া প্রাণীদের যতো কম দেখা যায় ততই ভালো।
আরও পড়ুন, মন্দিরে যৌন ভাস্কর্য – বিশ্বাসের সেকাল একাল
দুর্গাপুজোর দিন পনের আগে দেখি জানালা জুড়ে অন্য বাড়ির সম্ভাবনা আর ভুলে থাকা যাবেনা। খন্তা কোদাল নিয়ে মেলা লোকজন এসে পড়েছে। ভিত কাটার কাজ আরম্ভ হয়ে গেল অচিরে। সারাদিন মাটিকাটিয়েরা তিন চার পাঁচ হাত মাটি কাটে। পাশে পাহাড়ের মত ঢিপ হয়ে থাকে। গর্ত যেমন যেমন গভীর হয়, আমি দেখি নিচেকার মাটির চেহারা কেমন বদলে বদলে যাচ্ছে। ছ’সাত হাত নিচ থেকে যে মাটি উঠছে তার রঙ কালো। নরম মসৃণ কালো। দেখতে দেখতে অন্য একটা ছবি খুলে যেতে থাকে মাথার মধ্যে। ওই কালো মসৃণ মাটি গঙ্গার আপন স্রোতে বয়ে আনা মাটি, যা দিয়ে সে আমাদের এই দেশ তৈরি করেছিল। এক-দেড় লক্ষ বছর আগে এই জলধারাটি পর্বতকন্দর থেকে বেরিয়ে তার পাথর-মাটি ক্ষয় করতে করতে নামছিল। আরও কত কত জলের ধারার সঙ্গে মিশে সুদূর হিমালয় পর্বতের এমাথা ওমাথা থেকে সেই প্রাচীন বৃষ্টিজলের সঙ্গে বয়ে আসা মিহি মাটি, নিজের পথে পথে ঘুরে পরিশ্রম করে পাথর ক্ষইয়ে আনা মাটি, সব স্রোতজলে বয়ে এনে জমা করেছিল সমুদ্রপ্রান্তে। সেই মাটি জমে জমে কে জানে কতো হাজার বছরে এতোটা উঁচু হল যে তা মাথা তুলতে পারল সমুদ্রজলের ওপরে। সেই নোনা মাটির ওপরেও শতশত বছর জমা হল হাজার বন্যার পলি। তবে এই কোমল কালচে মাটি। সেই উর্বর মাটি ঢেকে গাছ। ঘন বন। মানুষ। তার বসতি। তিনশ বছর আগেও ঘন জঙ্গলে ঢাকা সেই সব এলাকায় ছিল মানুষজনের ছোট, খোলামেলা গ্রাম।
পিছু হটে আজ সেই বহুবছরে জমে ওঠা মাটির ইতিহাসকে আজ দেখতে পাচ্ছি। একইঞ্চি মাটি জমতে শুনি আটশ থেকে হাজার বছর লাগে। ছ’ সাত ফুট মাটি...আমার ভাবনা আর থৈ পায়না। গিরিজা দা কে জিজ্ঞেস করতে হয়। গিরিজা দা ভূতত্ত্বের বড্ডো ভালো মাস্টারমশাই, আমার হাজার উদ্ভট প্রশ্নেও বিরক্ত হননা। প্রশ্ন শুনে একটু ভেবে বললেন, অতোটা মাটি এই অঞ্চলে জমতে সময় লেগেছে মোটামুটি আঠারো থেকে কুড়ি হাজার বছর। এই যে মাটি নিচ থেকে খুঁড়ে তুলে রাখা আছে আঠেরো হাজার বছর আগে তা তৈরি হয়েছিল! তার ওপর আরো আরো আরও মাটির স্তর জমেছে। আজ যে মাটি খোলা পড়ে আছে রোদে, অনেক রাত্রে ট্রাক এসে যাকে তুলে নিয়ে যায়, কে জানে কোথায়, হয়তো কোন পুকুর কিম্বা জলাজমি ভরাট করতে, ওর গায়ে কোনদিন আলো লাগেনি এর আগে। হিমালয়ের কোন শিলাচুর্ণ থেকে তৈরি হওয়া এই মাটি তাহলে আমার এই সমস্ত প্রাণশৃঙ্খলার, আমাদের সভ্যতার আদি মাতা! যখন ইয়া দেবী সর্বভূতেষু সৃষ্টিরূপেণ সংস্থিতা...স্থিত হয়ে আছেন, বলে স্তব করি তখন আসলে এই দেবীর কথাই বলা হয়। বাংলাভাষায় কে এর নাম দিল ‘মা-টি’! তাঁকেই টেনে বার করে আমার পায়ের তলা থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও রেখে আসি। যেখানে তার থাকার কথা নয়। আমি দেখতে থাকি। জল উঠছে নিচ থেকে, এখনও। জলমাটির যে শৃঙ্খলা এ পৃথিবী লক্ষকোটি বর্ষে আপন নিয়মের ধীর যত্নে তৈরি করেছিল, তার এক অংশকে আজ চোখে দেখতে পাচ্ছি। কত কতবছরে সঞ্চিত ওই জল পাম্প বেয়ে অবহেলায় বয়ে যাচ্ছে ভবানীপুরের রাস্তার নালি দিয়ে। যারা ফেলছে বেচারিরা জানেও না কী ফেলছে। সমস্তটা কীরকম পরাবাস্তব মনে হয়।
সৌরভ ফোনে হাসছিল, ওদের পাড়ায় দুর্গামণ্ডপে ঘটস্থাপনের মাটি পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খুঁজে শেষে একজায়গায় ফ্ল্যাটবাড়ির ভিত খোঁড়া হচ্ছিল, সেখান থেকে একটু মাটি চেয়ে আনা হয়। পুজোর ঘট বসানোর কথা শুনে পয়সা নেন নি তারা।
জল মাটি সিরিজের সব লেখা একত্রে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে