Advertisment

শোভন-বৈশাখী ও বিরিয়ানির খুশবু

মিসেস কাউলের জন্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে কিছু ছাড়তে হয়নি। মান, মর্যাদা, পদাধিকার, কিছুই না। সবাই জানত, এমনকি মিডিয়াও, কিন্তু না জানার ভাণ করত। জানলেও বা কী আসে যায়?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Sovon Baishakhi Relation

ছবি- টুইটার, গ্রাফিক্স- অভিজিত বিশ্বাস

বাঙালি তার নোলার জন্য বিশ্ববিখ্যাত। শুধু ভালো খাবার নয়, কেচ্ছার রসেও চিরকাল তার মাছি-ডানা জড়িয়ে গেছে। সে ডালভাতের আটপৌরে কেচ্ছাই হোক, বা মাংস বিরিয়ানির রগরগে কাহিনী। নাক গলানো এবং তা নিয়ে এন্তার আলোচনা করা, কোনকিছুতেই আমাদের কোনও আপত্তি নেই। থাক পড়ে কাশ্মীরিদের চূড়ান্ত দুর্দশার কাহিনি, এক মাসে দু-দু'বার ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিটে সুদ কমা বা অর্থনীতির হাঁড়ির হাল। আমাদের চোখে তো সকলি শোভন, ও নিয়ে ভাববার অনেক লোক আছে। কেউ যদি নাও থাকে, রক্তাক্ত কচুয়া কাণ্ডের পরও আমাদের বিশ্বাস, রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে রক্ষাকর্তা বাবা লোকনাথ। আমরা তাই সব সমস্যা হেলায় তুচ্ছ করে আপাতত এক নেতা ও তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে পুচ্ছ উচ্চে তুলে নাচানাচি করছি।

Advertisment

বুদ্ধিমান পাঠকের নিশ্চয় দুইয়ে দুইয়ে চারের মতো রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশের এক দলবদলু নেতা ও তাঁর তুখোড় বান্ধবীটির কথা মনে পড়ে গেছে। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠেছে এক সবজান্তা আলতো হাসি, যতই বন্ধুত্বের দোহাই দাও না কেন বাবা, আসল খবর আমরা ঠিকই জানি।

আসল নকল খবর যাইই হোক না কেন, তা নিয়ে আমাদের ঘুম নষ্ট হচ্ছে কেন? এঁরা কি অপ্রাপ্তবয়স্ক? নাকি ভারতীয় রাজনীতির জগতে এধরণের বন্ধুত্ব এই প্রথম দেখা গেল? এঁরা তো 'স্মল ফ্রাই', মানে ছোট মাছ, গভীর জলে যাঁরা এতকাল খেলা করে বেড়ালেন, তাঁরা কি আমার আপনার পারমিশন নিয়ে তা করেছিলেন, নাকি পারমিশন নেওয়ার কোনও দরকার ছিল?

আরও পড়ুন, শোভন-বৈশাখী ‘ভাত-ডাল’, মত দিলীপের! মানে বুঝলেন না ‘অসন্তুষ্ট’ বৈশাখী

উঁহু, উল্লাসে লাফিয়ে উঠে নেহরু আর লেডি মাউন্টব্যাটেন বা গান্ধীজীর ফটোশপ করা মিম শেয়ার করতে লেগে যাবেন না। ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী বা সোশালিস্ট পার্টির নেতা জর্জ ফার্নান্ডেজও নিজেদের শর্তে জীবন কাটিয়েছেন। ভেতো বাঙালির অনুমোদন বা বিরোধিতা, কিছুরই তোয়াক্কা করেন নি। প্রথমজন তাঁর প্রথম অনুরাগকেই আঁকড়ে ধরে ছিলেন। গোয়ালিয়র কলেজের সহপাঠী রাজকুমারী হাক্সারের সঙ্গে অসফল প্রেমকে পরে একধরনের পরিণতি দিয়েছিলেন। তাঁরা থাকতেন পাশাপাশি, পরস্পরের দেখভাল করতেন, এমনকি অন্যত্র বিবাহিত মিসেস রাজকুমারী কাউলের মেয়েকে অটলবিহারী দত্তক নিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেই মেয়েই অকৃতদারের মুখাগ্নি করেন।

মিসেস কাউলের জন্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে কিছু ছাড়তে হয়নি। মান, মর্যাদা, পদাধিকার, কিছুই না। সবাই জানত, এমনকি মিডিয়াও, কিন্তু না জানার ভাণ করত। জানলেও বা কী আসে যায়? একবার এবং একবারই মিসেস কাউল এ ব্যাপার নিয়ে ইন্টার্ভিউ দিতে রাজি হয়েছিলেন এবং সপাটে বলেছিলেন, তিনি এই সম্পর্ক নিয়ে কখনওই "অ্যাপলোজেটিক এক্সপ্লানেশন" (আমতা আমতা ব্যাখ্যা) দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি, করবেনও না।

প্রবল প্রতাপান্বিত সাম্যবাদী নেতা জর্জ ফার্নান্ডেজ তাঁর পরিণত জীবনের বেশির ভাগটাই কাটিয়েছেন বান্ধবী জয়া জেটলির সঙ্গে দিল্লিতে তাঁর লুটিয়েনস বাংলোতে। সে কারণে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তিতে কোনও ভাটা পড়েছে বলে কখনো শোনা যায় নি। শুধু মুম্বই নয়, ভারতের মিল শ্রমিকদের কাছে তিনি ছিলেন বিরাট মসিহা। পরে আলঝাইমার্সে আক্রান্ত হওয়ার পর নিজের সম্পত্তি নিয়ে বান্ধবী জয়া জেটলি ও স্ত্রী লায়লা ফার্নান্ডেজের মধ্যে প্রলম্বিত আইনি লড়াইয়ের তাৎপর্য বুঝতে পারবেন, সেই মানসিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন একদা প্রচণ্ড লড়াকু এই শ্রদ্ধেয় নেতা।

আরও পড়ুন: তৃণমূলের মতো সংগঠিত সন্ত্রাস বাম আমলেও দেখিনি: শোভন

ভারতীয় রাজনীতিতে ডান বা বাম নির্বিশেষে নেত্রী ও নেতারা বিবাহের বাইরের সম্পর্কে জড়িয়েছেন আর পাঁচজন সাধারণ ভারতীয় পুরুষ-নারীর মতোই। তার জন্য তাঁদের নানা সময়ে ঝামেলা হলেও বিরাট আত্মত্যাগ কিছু করতে হয় নি, বা এত সমালোচনার খোরাক হতে হয় নি, যতটা হতে হচ্ছে মহানগরীর প্রাক্তন মেয়র ও তাঁর অধ্যাপিকা বান্ধবীকে।

তবে তাঁদের নিয়ে ম'ম' কেচ্ছায় চারদিক যতই সুরভিত হয়ে উঠছে, ততই আমরা নিজেদের লজ্জাহীন পরচর্চার আনন্দ, অপরিণতমনস্কতা, নিজেদের স্ববিরোধ তেড়েফুঁড়ে প্রকাশ করছি। একবারও ভেবে দেখছি না যে আমাদের বঙ্গীয় প্রায়-ষাট নেতাটি কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে ইতোমধ্যেই অনেক বলিদান করেছেন। নেত্রীর অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন থেকে চোখের বালাই হওয়া, দল থেকে নির্বাসন, পদ থেকে নির্গমন, সংসার-স্ত্রী-সন্তান ত্যাগ, বন্ধুত্বের কারণে এত আত্মোৎসর্গ খুব কম রাজনীতিকই করে থাকেন।

এ দলেরই আরো অনেক নেতা রয়েছেন, যাঁরা অন্য সম্পর্ক কার্পেটের তলায়, মানে ফ্ল্যাটের চৌহদ্দিতে লুকিয়ে রাখতে বেজায় স্বচ্ছন্দ। সেখানে বুক বাজিয়ে এই বন্ধুত্ব উদযাপন, অন্যরকম সততার কথা, বাঙালির কাছে আজব মনে হয়েছে হয়তো। হয়তো যে নীতিমালার প্রথম পাঠ 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি', তাতেও প্রচণ্ড ধাক্কা লেগে থাকবে। তাই মহা আক্রোশে এই সমবেত ছিছিক্কার।

আরও পড়ুন, শোভনের বিজেপিতে যোগদান দেখে হাসছেন রত্না! কেন?

পেশাসূত্রে বান্ধবীটিকে না চিনলেও বহুদিন হলো জানি। বাম আমলে ইনি চাকুরিক্ষেত্রে বঞ্চনা ও নির্যাতনের অভিযোগ এনে অনেক জল ঘোলা করেছিলেন। তাতে সত্য বা মিথ্যা কতটা ছিল আমার সম্যক জানা নেই, কিন্তু টিভিতে যাঁরা সাক্ষাৎকার দেখেছেন তাঁরাও বুঝবেন, মহিলা তুখোড় বুদ্ধিমতী, স্বচ্ছন্দ, সপ্রতিভ এবং সাহসী। এগুলোর কোনোটাই অপগুণ নয়, তাই বাঙালি মেক আপের কথা তুলে খোঁটা দিতে শুরু করল, দুজনের পোশাকের এক রঙ নিয়ে হাসিতে ফেটে পড়তে লাগল। যে বালখিল্যতার অভিযোগ এই পরিণত জুটির বিরুদ্ধে তোলা যেত, আপামর জনসাধারণ নিজেই সে দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ল। চৌধুরী মশাই ঠিকই বলেছিলেন, মনে হয় এ সব দেখলে, বাঙালি আত্মঘাতী।

তাঁর বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ আগে কখনো না উঠলেও অধ্যাপিকা যেহেতু মহিলা, চরিত্র লাঞ্ছনার বেশির ভাগটাই তাঁর পাওনা হলো, যদিও নেতার পূর্ববান্ধবী যোগের প্রমাণ এই সেদিনও বিজেপি অফিসে পাওয়া গিয়েছে।

আমার কোনও দায় নেই তথাকথিত নৈতিককে অনৈতিক বা উল্টোটা প্রমাণ করবার, কিন্তু না ভেবে পারি না, বাঙালিকে এতো বিচারপ্রবণ বা জাজমেন্টাল হওয়ার ভার কে দিল? কেচ্ছাচর্চার আনন্দ ডালভাতের মতো ক্ষুন্নিবারণ করে, না মাংস বিরিয়ানির মতো রসনা তৃপ্তি, সে তর্ক নাহয় তোলা থাক। কারণ যদি কারো অধিকার থাকে জাজমেন্টাল হওয়ার, তা একান্তভাবেই উক্ত নেতার স্ত্রী-সন্তানের, অধ্যাপিকার স্বামীর। আমি বা আপনি কেউই জানি না, সত্যি কোন ব্যথা তাঁদের কোথায় বাজছে! তাঁরা সত্যিই সার্বিক ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী, নাকি আইন আদালত সব কিছু হয়ে যাওয়ার পরও গুমরে কাঁদাই তাদের ভবিতব্য।

আমরা যেটা পারি, সেটা হলো এই অসুস্থ চর্চা বন্ধ করা। কুৎসিত মিম আর না বানানো, যেখানে স্ত্রী ও বান্ধবীর ছবি পাশাপাশি রেখে বোঝানোর চেষ্টা চলে, কেন নেতার এই 'ভীমরতি'। কারণ এতকিছুর পরেও ভালোবাসা সত্যি তো আর শুধুই 'স্কিন ডিপ' বা চেহারানির্ভর নয়। সে এক অব্যাখ্যাত রসায়ন, যার গভীরতা এবং আকস্মিকতা আজও মাপা যায় নি, ভবিষ্যতেও যাবে না।

Advertisment