Advertisment

'সব পেয়েছির দেশে' হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সন্তানরা

সন্তান মানুষ করা মানে যে শুধু তাদের খাওয়া-পরা-লেখাপড়ার তদারকি করা বা আমোদ-প্রমোদের খরচ যোগানো নয়, তাদের মূল্যবোধও গড়ে তোলা, একথা কি আমরা একেবারেই ভুলতে বসেছি?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kolkata new town accident

নিউ টাউনে দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই গাড়ি। ছবি: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

ঘটনা ১: এ সপ্তাহের গোড়ার দিকের এক সকাল, আন্দাজ সোয়া পাঁচটা। নিউ টাউন এলাকা দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে একটি হন্ডা সিটি গাড়ি। সেই গতিতেই ইউ-টার্ন নিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে মেট্রোর পিলারে ধাক্কা, উল্টে যাওয়া গাড়িতে বন্দী গাড়ির চালক, ২১ বছরের মোহিত জৈন, সঙ্গে ময়াঙ্ক ঝাওয়ার (১৮), কৌশল ঝাওয়ার (১৭), এবং নিষিধ জয়সওয়াল (১৭)। সামনের সিটে মোহিতের পাশে সরবজ্যোত সিং (১৭)। এখন পর্যন্ত মৃত ময়াঙ্ক, কৌশল, এবং নিষিধ। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে মোহিত। তুলনায় অক্ষত সরবজ্যোত।

Advertisment

ঘটনা ২: চলতি বছরের অগাস্ট মাসে গভীর রাতের কলকাতায় সুনসান শেক্সপিয়র সরণি-লাউডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলে প্রাণঘাতী পথ দুর্ঘটনা। দামী জাগুয়ার গাড়ির ধাক্কায় মৃত দুই বাংলাদেশী নাগরিক। ঘটনার জেরে গ্রেফতার কলকাতার জনপ্রিয় রেস্তরাঁ গোষ্ঠী আরসালানের মালিকের পুত্র, যে দুর্ঘটনার পরেই গাড়ি ফেলে পালায়, এবং পরে তার পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বাঁচানোর চেষ্টায় তার ছোট ভাইকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

ঘটনা ৩: হাওড়ার কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে সলপের কাছে গত বছরের শেষভাগে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহত এমএল রয় অ্যান্ড কোম্পানির তরুণ ডিরেক্টর শিবাজি রায়, যিনি ঘন্টায় ১৬০ কিমি গতিতে চালাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারান তাঁর ফেরারি গাড়ির ওপর। শিবাজী রায়ের সঙ্গী মহিলা গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। দুর্ঘটনায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ফেরারিটির দাম প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা।

পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে এই তালিকা বাড়িয়েই চলা যায়। কিন্তু এই লেখার উদ্দেশ্য শহরের সাম্প্রতিক পথ দুর্ঘটনার ফিরিস্তি দেওয়া নয়। একটু ভাবলে দেখবেন, তিনটি ঘটনার মধ্যেই কিছু মৌলিক মিল রয়েছে। আবার বলছি, এগুলি উদাহরণ মাত্র, এরকম আরও বহু ঘটনার কথা আমরা জানি। কিন্তু তিনবারই ঘটনার কেন্দ্রে তিন সচ্ছল বা অতি সচ্ছল পরিবারের সন্তান, যারা বাড়িতে না বলে, বা মিথ্যে বলে, দামী গাড়িতে শহরের রাস্তায় তীব্র গতির 'জয় রাইডের' শিকার।

এই ধরনের ঘটনার পর অধিকাংশ বিহ্বল, বিভ্রান্ত পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, তাঁরা বুঝতেই পারেন নি তাঁদের সন্তান কোন পথে চলেছে। আরও একটু ভাবলে দেখবেন, এই পরিস্থিতিও পরিচিত। আমাদের আশেপাশে কি দেখেন নি এমন অনেক পরিবার, যেখানে বাড়ির বাচ্চাদের 'ডিসিপ্লিন' শেখানোর চল বড় একটা দেখা যায় না? বিশেষ করে আজকের 'নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি' বা অণু পরিবারের যুগে, যেখানে অনেক সময়ই বাবা-মা দুজনেই বাড়ির বাইরে কর্মরত, বাচ্চাদের সঙ্গ দেওয়ার বদলে অপর্যাপ্ত হাতখরচ বা বিনোদনের উপকরণ হাতে তুলে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চান, এমন কাউকে কি চেনেন না?

সন্তান মানুষ করা মানে যে শুধু তাদের খাওয়া-পরা-লেখাপড়ার তদারকি করা বা আমোদ-প্রমোদের খরচ যোগানো নয়, তাদের মূল্যবোধও গড়ে তোলা, একথা কি আমরা একেবারেই ভুলতে বসেছি? নিউ টাউনের প্রাণঘাতী অ্যাকসিডেন্টে জড়িত গাড়ির চালক মোহিতের বাড়ির লোক জানতেনই না, সে ভোর চারটেয় বাবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। নিহত দুই কিশোর বাড়িতে বলে, তারা ভোরবেলা ক্রিকেট প্র্যাক্টিসে যাচ্ছে। কেন প্রয়োজন পড়ছে এই গোপনীয়তার, মিথ্যাচারের?

খবরে প্রকাশ, রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলিতে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে মূল্যবোধের পাঠ, যার পোশাকি নাম হবে 'নীতিশিক্ষা'। শুনে শুভ সংবাদ মনে হলেও একটু তলিয়ে ভাবলে বুঝবেন, এর দ্বারা সমাজের দৈন্যই প্রকাশ পায়। এই শিক্ষা তো আমাদের সন্তানদের বাড়িতেই পাওয়ার কথা। আমরা তো জানি, কী কী শেখাতে হয় - মিথ্যে বোলো না, কারোর ক্ষতি কোরো না, সবসময় নিজের কথা না ভেবে অন্যের কথাও ভাবো, ভাগ করে খাও, পরিশ্রম করো, ফল পাবেই, ইত্যাদি প্রভৃতি। যে শিক্ষা ইদানীং প্রায় তামাশার বিষয় হয়ে উঠেছে।

মুশকিল হলো, 'আপনি আচরি ধর্ম, পরকে শিখাও'। যা নিজেরাই মানি না, তা পরবর্তী প্রজন্মকে কীভাবে শেখাব? সাধ্যাতীত জীবনযাপনের তাগিদে যেখানে নিজেরাই অহরহ ইঁদুর দৌড়ে প্রাণপণ জেতার চেষ্টা করছি, নিজেদের সুখ-সুবিধা যেখানে অবধারিত অগ্রাধিকার পেয়ে চলেছে, সেখানে নিজেদের সন্তানদের নিঃস্বার্থ হতে, সৎ হতে শেখানো তো সত্যিই অসম্ভব।

আরও একটা মুশকিল আছে। আমার এক প্রতিবেশী যেমন বলেন, "বাবা, আজকাল তো কিছু বলতেই ভয় করে। যা সব পড়ি কাগজে, কিছু বললেই সুইসাইড।" অর্থাৎ, শাসন করলেই আপনার সন্তান যদি আত্মঘাতী হয়? বকাবকি করলে যদি বাড়ি থেকে পালায়? তাই কিছু বলা যাবে না।

কিন্তু কেন এই প্রবণতা? মনস্তত্ববিদরা বলছেন, "না" শুনতে অনভ্যস্ত হয়ে পড়ছে আমাদের বাচ্চারা। অতএব তুচ্ছ কোনও বারণও বিরাট হতাশার আকার নিচ্ছে। পছন্দের টিভি প্রোগ্রাম দেখতে না পারা, পছন্দের বিষয় নিয়ে কলেজে ভর্তি না হতে পারা, পছন্দের ল্যাপটপ না পাওয়া, সবেতেই যেন তাদের পৃথিবী ধ্বসে পড়ছে। সম্ভবত তাদের বাবা-মাও প্রশ্রয় এবং স্নেহের মধ্যে আর তফাৎ করতে পারছেন না। প্রশ্রয়ের ফলে যখন বিপথগামী এইসব ছেলেমেয়ে, তখন তাদের শাসন করতে গেলে যে বিপর্যয় ঘটবেই, এতে আশ্চর্য কী?

কোথাও পড়েছিলাম, পৃথিবীতে জাপানের যুব সমাজের মধ্যে নাকি আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। কেন? ইংরেজিতে যাকে বলে 'বোরডম', স্রেফ একঘেয়েমি। সব পাওয়া হয়ে গেছে, সব দেখা হয়ে গেছে, সব আনন্দই পুরনো হয়ে গেছে, বেঁচে থেকে লাভ কী? তাই বলছি, 'সব পেলে নষ্ট জীবন', গানের এই লাইনটা মাথায় রাখুন। সন্তানকে "না" বলুন, অভাব বোধ থাকতে দিন, অর্জন করতে দিন। তা নাহলে শেষের দিন কিন্তু সত্যিই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে যাচ্ছে।

Advertisment