Advertisment

এক চিমটে বিরোধিতা

বিরোধিতার কতটা মিলিজুলি আর কতটা সত্যি? শাসকদল কতটা বিরোধিতা করতে দিচ্ছে আর বিরোধীরা কতটা করছে? সমাজ, সংসার, রাজনীতি সব জায়গাতেই একটা সীমারেখা পর্যন্ত বিরোধিতা মেপে মেপে ব্যবহার করতে হয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
sanmoy bandopadhyay mamata banerjee

সম্প্রতি বাংলায় ধৃত কংগ্রেস নেতা সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

“প্রকৃতির পদে পদে বিরোধী উক্তি দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু তাহারা কি বাস্তবিকই বিরোধী? তাহারা দুই বিপরীত সত্য। আমি আলো হইয়া আলোর কথা বলি, অন্ধকার হইয়া অন্ধকারের কথা বলি। আমার দুটা কথাই সত্য। আমি কিছু এমন প্রতিজ্ঞা করিয়া বসি নাই যে একেবারে বিরোধী কথা বলিব না; যে ব্যক্তি কোন কালে বিরোধী কথা বলে নাই তাহার বুদ্ধি তো জড়পদার্থ, তাহার কোন কথার কোন মূল্য আছে কি? আমরা যে বিরোধের মধ্যেই বাস করি। আমাদের অদ্য আমাদের কল্যকার বিরোধী, আমাদের বৃদ্ধকাল আমাদের বাল্যকালের বিরোধী; সকালে যাহা সত্য বিকালে তাহা সত্য নহে। এত বিরোধের মধ্যে থাকিয়াও যাহার কথার পরিবর্ত্তন হয় না, যাহার মত অবিরোধে থাকে, তাহার বুদ্ধিটা তো একটা কলের পুতুল, যত বার দম দিবে তত বার একই নাচন নাচিবে।”

Advertisment

~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রান্নায় যেমন নুন না দিলে আলুনি, ঠিক তেমনই সবাই যদি সবসময় আপনার কথায় হ্যাঁ হ্যাঁ করে যায়, তাহলে একঘেয়ে লাগে। সেই জন্যেই বিরোধিতা জরুরি। গণতন্ত্রের বড় বড় নীতিকথায় তো বিরোধিতা থাকবেই। সেখানে নাকি বিরোধীরাই তুমুল শক্তিশালী। সাধারণভাবে সেসব উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের গল্প। গরীব দেশে জোট না বাঁধলে বিরোধীদের মূল্য কম। তাদের দেখতে পাওয়া যায় তখনই, যখন প্রভাবশালী নেতা খুঁজে বিরোধীরা শক্তি বাড়ায়।

এবার বিরোধীদের শক্তিশালী হতে দেবে কে? সে ক্ষমতা আবার শাসক দলের হাতে। যে ক্ষমতায় সে যদি বিরোধীদের বিরোধিতা করার জায়গা দেয়, তবেই না বিরোধিতা। আর উল্টোদিকে একটু বিরোধিতা করলেই যদি তাকে ধমকে জেলে পুরে দেওয়া হয়, তাহলে বাকি বিরোধীরা সাবধান হবেই। অর্থাৎ মূল প্রশ্ন হলো, বিরোধিতার কতটা মিলিজুলি আর কতটা সত্যি? শাসকদল কতটা বিরোধিতা করতে দিচ্ছে আর বিরোধীরা কতটা বিরোধিতা করছে? সমাজ, সংসার, রাজনীতি সব জায়গাতেই তাই একটা সীমারেখা পর্যন্ত বিরোধিতা ওষুধের মতো মেপে মেপে ব্যবহার করতে

আরও পড়ুন: ভাসানের কার্নিভালে জিনপিং

কে কোথায় কীভাবে বিরোধিতা করবে, তার বিভিন্ন অঙ্ক আছে। ধরা যাক, সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে। অবশ্যই এখানে ব্যবসায়িক বিষয় আছে। সংবাদমাধ্যম তো আর চিন্তা আর অক্ষরে চলে না, সেখানে বিজ্ঞাপন লাগে। আমাদের দেশে সরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করা হয়। যে সংবাদমাধ্যম সরকারের বিরোধিতা করছে, তার ক্ষেত্রে সেই বিজ্ঞাপনের অর্থ কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

আর একথা যেমন কেন্দ্রের ক্ষেত্রে সত্যি, তেমন রাজ্যের ক্ষেত্রেও। কোনও এক মন্ত্রীমশাই যদি এক সাংবাদিককে ডেকে ধমক দেন, তখন সেই সাংবাদিক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাবধান হবেন। তাঁর বা তাঁর সংস্থার খ্যাতি বা ক্ষমতা খুব বেশি থাকলে হয়ত প্রতিবাদের সুযোগ থাকে। তবে মোটের ওপর সব জায়গাতেই কিছু সমীকরণে সমাধানের মাধ্যমে ঠিক হয় বিরোধিতা। মান বসে চলরাশিতে। অর্থাৎ, যে দু'পক্ষ বিরোধী হিসেবে লড়ছেন তার কতটা সত্যি আর কতটা সাজানো, তার একটা অঙ্ক থাকবে। সেই অঙ্ক আবার সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল।

বিরোধিতার এই গল্পে কিছু নতুনত্ব নেই। আসলে মানুষ প্রাণী হিসেবে হিংস্র। তাই দু'পক্ষ মিলেমিশে থাকার তুলনায় লড়াই করলে তাতে উত্তেজনা বেশি। সেই জন্যেই খেলা হয় দলে ভাগ হয়ে। যে বিরাট কোহলি আর রবিচন্দ্রন অশ্বিন এক দেশের হয়ে খেলছেন, আইপিএলের কুড়ি কুড়িতে তাঁরাই দুই যুযুধান পক্ষে। স্কুলের হয়ে যে পড়ুয়ারা একসঙ্গে নামছে কোনও রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায়, তারাই আবার নিজের স্কুলে একে অপরের প্রতিপক্ষ। এখানে সময়টাও খুব আলাদা নয়। অর্থাৎ একই সময়ে দু'জন দু'জনের বিপক্ষে লড়ছে, আবার তার পরের দিনই একদল হয়ে অন্য প্রতিযোগীর সঙ্গে লড়াই।

আরও পড়ুন: শরণার্থী বনাম অনুপ্রবেশকারী

রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের আমরা সমালোচনা করি যে তাঁরা একদল থেকে অন্যদলে চলে যান যখন তখন। যুক্তি দিয়ে ভাবলে সেখানেও সমালোচনার খুব জায়গা নেই। একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে একদলের মধ্যে থেকেও সেখানে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। দলের মধ্যে উপদল। দল হিসেবে ক্ষমতা না থাকলেও, একই দল বা মতের মধ্যে দড়ি টানাটানি অব্যাহত। সেই কারণেই তো এ দেশে বামপন্থীদের অস্তিত্ব সঙ্কট হলেও তাদের মধ্যে কয়েক হাজার ভিন্ন মতামত। অর্থাৎ দল হিসেবে হয়ত কোনও ক্ষমতাই নেই। তাদের কথা কেউ শোনে না। কিন্তু ছোট্ট পার্টি অফিসে দরজা-জানলা বন্ধ করা সম্মেলনে চারজনের মধ্যে দু'জনের জোনাল কমিটিতে নির্বাচিত হওয়ার জন্যে ১৭ জনের গোপন ব্যালট। দু'দলের দড়ি টানাটানিতে কোন দিকে যাবেন বুঝতে না পেরে এক সদস্য হয়ত অসুস্থতার ভান করে ভর্তি হয়ে গেলেন হাসপাতালে।

বিরোধিতা বেঁচে থাকতে গেলে শাস্তিও থাকতে হবে। একদল বিরোধিতা করে যাচ্ছে আর অন্যদল একেবারেই পাত্তা দিচ্ছে না, তাতে খেলা জমে না। সমাজ মাধ্যমে (সোশ্যাল মিডিয়া) একটু ঘোরাফেরা করলেই দেখা যায় বিভিন্ন ধরণের ব্যঙ্গচিত্র থেকে কুৎসা। সাধারণভাবে তার জন্যে কোনোরকম শাস্তি হয় না। অর্থাৎ বেশির ভাগটাই প্রভাবশালীরা উপেক্ষা করেন। যদিও আইন আছে প্রচুর। বাস্তবে এই আইনের ব্যবহার হয় অত্যন্ত কম সংখ্যক ঘটনায়। বিচ্ছিন্ন কিছু ক্ষেত্রে এই অপরাধকে শাস্তিযোগ্য হিসেবে পেশ করা হয়। তার পেছনে যেমন তীব্র বিরোধিতা থাকতে পারে, তেমনই সুকৌশলী বোঝাপড়া থাকাও অসম্ভব নয়। যারা এই বিষয়টিতে বাদী কিংবা বিবাদী হিসেবে আছেন তারাও সবটা জানবেন তেমনটা নাও হতে পারে। কিন্তু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনায় যুক্ত হয়ে পড়েন সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ। কেউ পেশার প্রয়োজনে, কেউ বা নিছকই কোনও পক্ষ নেওয়ার উৎসাহে। ছোট ঘটনা অনেক বড় আকার নেয়। তার প্রভাব পড়ে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি বা আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ঘটনা সাজানো বাগান থেকে শুরু হলেও বিবর্তনের পর সেখানে দাবানল শুরু হয়ে যেতে পারে।

আরও পড়ুন: চিনের চেয়ারম্যান ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

মোটের ওপর একটা বিষয় কিন্তু পরিষ্কার যে, একটা সভ্যতা ঠিকভাবে চলতে গেলে তাতে কিছু নিয়ম লাগে। সেই নিয়ম কখনও মহাজাগতিক, কখনও প্রাকৃতিক, কখনও বা মানুষের নিজের সৃষ্টি করা। যেটুকু মানুষের হাতে নেই, যাকে আগের থেকে বুঝে নেওয়ার মত প্রস্তুতি এখনও বিজ্ঞানের নেই, সে কথা আলাদা। কিন্তু মানুষের সৃষ্টি করা নিয়ম-নীতি, আইন-কানুন যদি একেবারে গুলিয়ে যায় তাহলে কিন্তু অশান্তি বাড়বে অনেক বেশি।

গোটা বিশ্বে এখন বিরোধিতা এবং দ্বন্দ্বের প্রকোপ বেশি। গত কয়েকবছরে মধ্যপ্রাচ্যের মত এক অতি প্রাচীন সভ্যতাকে প্রায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আধুনিক সভ্যতাতেও সেই জায়গার গুরুত্ব জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের জন্যে অপরিসীম। কিন্তু সেকথা বিশেষ কেউ ভাবছেন বলে মনে হয় না। আমাদের দেশ বা রাজ্যের ক্ষেত্রেও উন্নয়নের সঠিক প্রশ্নের থেকে অনেক বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিরোধের বিভিন্ন কৌশলী কিংবা যদৃচ্ছ উদাহরণ। সাজানো (কৌশলী বা অঙ্ক কষা) বিরোধ বাড়তে বাড়তে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যায় যেখানে গোটা বিষয়টি শেষমেশ যদৃচ্ছ আকার নেয় এবং তখন সেখানে কোনও পক্ষেরই বিশেষ নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

ঠিক ভুল বোঝা কঠিন, তবে মোটের ওপর ক্ষমতাশালী নেতানেত্রীরা মনে করেন, জনগণের উন্নয়নের স্বার্থে বিরোধের মাত্রা কম হতেই হবে। এটা বাস্তব যে প্রতিটি ক্ষেত্রে অশান্তি চললে উন্নয়ন হয় না। তবে শাসকেরাও অপ্রয়োজনীয় বিরোধ সৃষ্টি করে খুব সহজেই জনগণের দৃষ্টি রুটি, জামা আর কুঁড়েঘর থেকে ধর্ম, সম্প্রদায় কিংবা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে গোলমালের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারেন। নোবেল থেকে বাইবেল, সব কিছু নিয়েই তখন বিতর্কের ঝড় ওঠে। সেই বেল পাকলে সাধারণ কাকের কিছুই উপকার হয় না, বরং ঝড়ে ডানা ভাঙে। উপসংহার তাই অমীমাংসিত। বিরোধিতার মধ্যে বাস করে বিরোধিতার পরিমাপ করা বোধহয় অসম্ভব। সে ফিতে কেউ খুঁজছেন কি?

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

tmc Mamata Banerjee west bengal politics All India Trinamool Congress
Advertisment