Advertisment

অপরাধী 'মা', নেপথ্যে নারীত্ব নয়, আছে মাতৃত্বের বিকৃতি

'মাতৃত্ব' বিষয়ে সমাজের যে ধারণা, আসলে সব ক্ষেত্রে সেটা ততটা ইতিবাচক নয়। একদিকে বিষয়টা যেমন প্রবল সংবেদনশীল, উল্টোদিকে লোভ, লালসা, চাহিদা, সস্তায় বাজিমাত অথবা অন্ধ আবেগের ঘনঘটা

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
অপরাধী 'মা', নেপথ্যে নারীত্ব নয়, আছে মাতৃত্বের বিকৃতি

প্রতীকী ছবি। অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

মা!

Advertisment

নাহ, নিছক এক শব্দ বা কোনও একটি সম্পর্কের নাম নয়। 'মা' যেন সীমার মাঝে অসীমের অনুভব। 'মা' নিয়ে এতটাই আবেগতাড়িত আমরা যে লিখতে গিয়েও খেই হারিয়ে যায়।

এই অনুভূতিকে সম্মান জানিয়েও বলা যায়, 'মাতৃত্ব' বিষয়ে সমাজের যে ধারণা, আসলে সব ক্ষেত্রে সেটা ঠিক ততটা ইতিবাচক নয়। একদিকে বিষয়টা যেমন প্রবল সংবেদনশীল, উল্টোদিকে মানুষের (পড়ুন 'মা') লোভ, লালসা, চাহিদা, সস্তায় বাজিমাত অথবা অন্ধ আবেগের ঘনঘটা। আর এখান থেকেই এমন এক মরমি বিষয়ও কখনও কখনও হয়ে ওঠে জটিল ও সমস্যা জর্জরিত।

অপরাধের দরজাও খুলে দেয় মাতৃত্ব সংক্রান্ত আবেগপূর্ণ বিষয়টি

শারীরিক নানা জটিলতা বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, অনেক সময়ই নিঃসন্তান দম্পতি ছেলেমেয়ে দত্তক নেন, বা 'সারোগেট মাদার'-এর শরণাপন্ন হন। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ দু'জনেরই সমস্যা থাকতে পারে, তবে অভিযোগের খাঁড়া সাধারণত নেমে আসে নারীর ওপরেই। যাই হোক, সেইসব স্তর পার হয়ে কোনও এক সময় সন্তান দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত বা সারোগেট মাদারের ভাবনা।

এক্ষেত্রেও পরিষ্কারভাবে দু'টি পৃথক মনস্তত্ত্ব কাজ করে। যাঁরা রক্তের সম্পর্ক বা বংশ পরম্পরার বিষয়টিকে বাড়তি গুরুত্ব দেন, তাঁরা দত্তক নেওয়ার চেয়ে সারোগেট মাকেই বেশি পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে পিতা-মাতার শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন ঘটিয়ে সেই ভ্রূণ সন্তান ধারণে সক্ষম ও তাঁদের চাহিদা অনুসারে উপযুক্ত অন্য কোনও মহিলার গর্ভে স্থাপিত করা হয়। শিশু ন'মাস প্রাকৃতিক নিয়মে সেখানেই বেড়ে ওঠে। জন্মের পর সারোগেট মা শিশুকে তার মা-বাবার হাতে তুলে দেন। প্রসঙ্গত, সারোগেট মায়ের খোঁজ ব্যক্তিগত স্তরে বা সংস্থার মাধ্যমে, দু'ভাবেই হতে পারে।

দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেকেরই বংশ-বিষয়ে বিশেষ ভাবনা থাকে। মোটামুটি সকলেই সু-বংশ খোঁজেন। বলা বাহুল্য, এই 'সু' বিষয়টা আপেক্ষিক। যাঁরা দত্তক নেবেন, তাঁদের পছন্দ, সিদ্ধান্ত, সংস্কৃতি ইত্যাদি অনুসারেই এই প্রক্রিয়া ঘটে। কেউ কেউ চেনাজানা স্তরে কাঙ্খিত শিশুর খোঁজ নেন। কেউ বা কোনও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কারও ক্ষেত্রে ঘটনাচক্র, মানে, পরিবারে কোনও শিশু আকস্মিক কোনও কারণে অনাথ বা অসহায় হয়ে পড়ল। তাকে পরিবারেরই কেউ দত্তক নিলেন। আর্থিক অনটনে আছেন পরিবারের কেউ, সে ক্ষেত্রেও অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ও নিঃসন্তান আত্মীয় দত্তক নিয়ে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ ও দরিদ্র পরিবারের অনটনের স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করেন। একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয় এখানে উল্লেখ প্রয়োজন, দত্তক হোক বা সারোগেট মা, পুরোটাই একটা সুনির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া। কেউ ইচ্ছেমতো যা মন চায়, সেটা করতে পারেন না। আর খেলাটা শুরু হয় এখান থেকেই।

মাতৃত্বের চরম আবেগ ঘিরেই গড়ে ওঠে অপরাধচক্র

সংবাদমাধ্যম সূত্রে অতি সম্প্রতি এভাবেই উঠে এসেছে এক ঘৃণ্য অপরাধের খবর। জানা যায়, কলকাতার নিউ আলিপুরের এক দম্পতি বহুদিন নিঃসন্তান। সন্তান লাভের আশায় ভবানীপুরের এক চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁরা এক সারেগেট মাকে ৬ লক্ষ টাকা দেন। টাকা দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও সন্তান না পেয়ে খোঁজ করে তাঁরা জানতে পারেন, মহিলা পলাতক। পরে ওই দম্পতির অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ মহিলা, সংশ্লিষ্ট ডাক্তার এবং আরও কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। আরও কিছু লোকের খোঁজ চলছে।

এটা যে একটা চক্র, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আর এদের কাজকর্মও চলছে দীর্ঘদিন ধরে, গুছিয়ে, বিস্তৃত আকারে। আইন কী ব্যবস্থা নেবে, সেটা সময় বলবে। কিন্তু যে দম্পতির বিশ্বাস ও স্বপ্নভঙ্গ হলো, তার খেসারত দেবে কোন আইনের শাসন? এরই সঙ্গে উঠে আসে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রশ্নটি, মাতৃত্বের নামেই কিন্তু একজন মহিলা অপরাধের এই খেলায় নামে! এটা করতে কোথাও তার হৃদয় এতটুকু দুর্বল হয় না?

কয়েক বছর আগের ঘটনা। লন্ডনবাসী এক ভারতীয় দম্পতি এক মারাত্মক অপরাধে অভিযুক্ত হয়। গুজরাতের এক ১১ বছর বয়সী কিশোরকে দত্তক নেয় তারা। পরে খুন হয় ছেলেটি। অভিযোগ, তার নামে করা জীবনবিমার টাকা আত্মসাৎ করাই ছিল ওই দম্পতির লক্ষ্য। সেই উদ্দেশ্যেই রাস্তায় গুন্ডা লাগিয়ে মোটরবাইক দুর্ঘটনার চিত্রনাট্য রচনা করে দম্পতি। অনাথ ওই কিশোর তার দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে বসবাস করত। দুর্ঘটনায় ছেলেটির জামাইবাবুও মারা যান। এই নিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রচুর আইনি কূটকচালি চলে। এখানেও কথা হলো সেই সন্তান আকাঙ্খার মিথ্যে নাটক, যেখানে তথাকথিত মাতৃত্বজনিত গৌরবের কালো দিকটি উঠে আসে বড়ই নির্মম সত্যতায়। ওই কিশোরের কপালে অমন মর্মান্তিক মৃত্যুলিখনে তথাকথিত ভাবে একজন মা-ও আছে, বিশ্বাস করতে রীতিমতো কষ্ট হয় আমাদের।

এ বছরেরই ঘটনা। তেলেঙ্গানার এক সাত বছরের বালিকাকে পাওয়া যায় চরম বিধ্বস্ত অবস্থায়। তার গোপনাঙ্গে সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ, ঠোঁটে কামড়ের চিহ্ন। এছাড়াও সারা শরীরের বিভিন্ন স্থানে চরম অত্যাচারের প্রমান মিলেছে। বোঝাই যায়, প্রবল যৌন নির্যাতন ভোগ করেছে মেয়েটি। সঙ্গে দারুণভাবে অপুষ্টির শিকারও সে। অভিযোগ, শারীরিক আঘাতের যন্ত্রনায় বিপর্যস্ত, অপরিসীম আতঙ্কে দিশেহারা বালিকার এই হাল করেছে তার দত্তক নেওয়া মা-বাবা। হ্যাঁ, সঠিকভাবে জানা না গেলেও পালক বাবার সঙ্গে তার পালিকা মা-ও আছে এমন নৃশংস ভূমিকায়, সেটা ঘটনাক্রমে পরিষ্কার।

পুলিশ ও শিশুরক্ষা কমিটির সদস্যরা যে অবস্থায় মেয়েটিকে উদ্ধার করেন, তা দেখলে অতি নিষ্ঠুর মানুষেরও হৃদয় কেঁপে উঠবে। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, মেয়েটিকে দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ আইনও মানা হয়নি। এই পরিবারে দুটি ছেলে আছে। একটি কন্যাসন্তানের অভাব ছিল। সেই জন্যই নাকি মেয়েটিকে পালন করতে শুরু করে এরা। কিভাবে পালন, কেন কন্যাসন্তান, তার বিশদ ব্যাখ্যা না করলেও সংবেদনশীল পাঠক আশা করি সবটাই বুঝেছেন। মেয়েটি আপাতত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এমন চরমতম না হলেও দত্তক বা সারোগেট মায়ের মাধ্যমে সন্তান নেওয়ার পর সবসময় সেই শিশুদের প্রতি যে সুবিচার করা হয় না, তার সাক্ষী আমরা অনেকেই। খুব উৎসাহ ও আবেগের সঙ্গে শিশুকে ঘরে তো আনা হলো। কিন্তু বহুক্ষেত্রেই দেখা যায়, কিছুদিন পর সেই আবেগে কেমন যেন ভাটা পড়ছে, এবং শিশুটি চরম অবহেলার শিকার হচ্ছে। ফলে সম্পর্কটাই দানা বাঁধতে পারছে না। একটা সময়ের পর সেই শিশু যত বড় হচ্ছে, তত তার মধ্যেও জন্ম নিচ্ছে ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ। মোদ্দা কথা, সন্তান গ্রহণের উদ্দেশ্য তো ব্যর্থ হচ্ছেই, তার সঙ্গে সামগ্রিক এক অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যার ফল ভোগ করছে ওই নিরপরাধ শিশুটি।

ফিরে আসি শুরুর কথায়। যে পবিত্র অনুভূতি নিয়ে আমরা মাতৃত্বের ব্যাখ্যা করি, আদতে তা কতটা বাস্তব? যে নারী একেবারে নিজের মনের তাগিদে অত্যন্ত পরিণতমনস্কতার সঙ্গে, সুবিবেচনায় ভিন্ন পরিবারের বা অন্য নারীর গর্ভে বেড়ে ওঠা এক শিশুর মা হতে চলেছেন, তাঁর কথা আলাদা। তিনি স্বেচ্ছায় বিষয়টি গ্রহণ করছেন। কিন্তু পরিবার বা সমাজের চাপে যিনি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাঁর মধ্যে সেই স্নেহের টান গড়ে ওঠা সম্ভব কি? পরবর্তীতে শিশুর প্রতি অবহেলা, অযত্নের জায়গাটা তৈরি হয় এখান থেকেই। সে যে আর সবাইকে ছেড়ে তার মায়ের কাছেও অনাকাঙ্ক্ষিত, এটা এক ভয়াবহ শূন্যতার সৃষ্টি করে শিশু-কিশোরের মনে। এখান থেকেই সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণা। নিটফল, অসুস্থ মন ও অপরাধ প্রবণতা। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে হলেও অপরাধের আঁতুড়ঘর নির্মিত হলো।

এর অনেকটা সমান্তরালেই যেন চলে অপরাধচক্র। এই চক্র রীতিমতো নেটওয়ার্ক বানিয়ে কাজ করে। বিশেষত সারোগেট মায়ের ক্ষেত্রে যে এক শ্রেণীর মহিলা অসাধু পথে উপার্জনে নামে, তার একাধিক দৃষ্টান্ত মেলে। সন্তানের জন্ম দিতে না পারা মায়েদের মধ্যে যে হতাশা, আক্ষেপ, যন্ত্রনা, আকুলতা কাজ করে, তাকেই হাতিয়ার করে এই মহিলারা। সঙ্গে থাকে চিকিৎসকরূপী এক দালালচক্র।

এরই পাশাপাশি উঠে আসে সন্তান বিক্রি করে দেওয়ার মতো অবিশ্বাস্য অপরাধ। দত্তক বা সারোগেট মায়ের ব্যাপারটা আইনকানুন মেনে করতে গেলে অসাধু উপায়ে রোজগার হবে না। এইসব ক্ষেত্রে প্রভূত অর্থের বিনিময়ে মা তার সন্তানকে নিঃসন্তান দম্পতির হাতে তুলে দিয়েছে, এমন ঘটনাও শোনা যায়। শিশুকন্যাকে ভবিষ্যত যৌনকর্মী বানানোর খেলায় নেমেছে তার মা, এমন ঘটনাও অহরহ ঘটে। শিশুদের ঘিরে সমাজে যে অপরাধচক্র সক্রিয়, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ির লোক, এমনকী মা জড়িত, সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবর বারবার স্তম্ভিত করে আমাদের।

পাঠক মাফ করবেন। নিতান্ত নেতিবাচক পথেই এগিয়েছে এই প্রতিবেদন। নারীর যাবতীয় মহিমা শুধুই মাতৃত্বে, এই দর্শনের পরিপন্থী আমরা নই। কিন্তু আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বাস্তব ছবিটাকে কেমন করে অস্বীকার করি? একটি শিশুর মা হওয়া, সে দত্তক নিয়ে পালিকা মা হোন বা সারোগেট রূপে গর্ভধারিণী, অপরাধ তো অপরাধই। যারা সন্তান নিয়ে ব্যবসা করে, তাদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। এদের আর কী করে মহিমান্বিত করা যায়? মা হলেও!

Advertisment