অধীর বিশ্বাস
'রবিবাবুর জন্মদিনে বালক রবি থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার যাত্রাপথ-- এ সব নিয়ে কথায়-গানে 'পঁচিশে বৈশাখ'-- হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে এক বন্ধু।
লিখলাম, বেশ। রেডিওটা সারাব কাল। মনে করে শুনব। তার পর হাসিমাখা চিহ্ন পাঠাল সে।
সত্যি তো, কবে থেকে পড়ে আছে রেডিওটা। জানি, খারাপ। কী খারাপ, মনে নেই এখন। কিন্তু এখনও যে মনে পড়ছে টিমটমে হারিকেন ঝুলিয়ে আমি আর বাবা। বাবা যায় পাচুগোপালের বাড়ি। রেডিও শুনতে। রেডিওর খবর। খবর মানে আকাশবাণী। রেডিও পাকিস্তান নয়।
খালপাড়ে পাচুকাকার বাড়ি। বাজারে তামাকের দোকান। হুকো খাওয়ার তামাক, পান-দোকতা তামাকের ব্যবসা। গ্রামে একটাই রেডিও। চৌষট্টি সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ। লাগল বা লাগতে চলেছে। ইন্ডিয়া যুদ্ধে হেরে যাক, পাকিস্তানে থেকেও বাবা চাইত না। বাবা তাই ইন্ডিয়ার খবর শুনতে যেত পাচুকাকার বাড়ি।
বাইরে ঝিঁঝি-ডাকা রাত। জোনাকিরাও ভেসে বেড়ায়। হারিকেনটা নামিয়ে নিভু করে রাখে বাবা। 'ও পাচু, কটা বাজে?'
ঘরে ঢুকেই রেডিওটা চালিয়ে দেয়। কচরমচর গানকথা পার করে রেডিওর সেন্টার ঘুরতে থাকে। কাকিমা ঘোমটা টেনে পার হয়ে গেল। গান হচ্ছে রেডিওতে। খবরের আগে এমন গানই হয়। এ গান তাই খুব চেনা। গানের গলায় দু:খ বইছে।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে এসে এক দাদা এমন গান গেয়ে চান করতে যাচ্ছিল। বলি, রবীন্দ্রসঙ্গীত?
ম্যাট্রিক-দাদা বেজায় অবাক। বলল, কী করে জানলি?
'ওই যে আকাশবাণী খবরের আগে এমন গান হয়। পাচুকাকা বলে দিয়েছে, এ গান রবীন্দ্রসঙ্গীত। এটা শেষ হলেই 'আকাশবাণী! খবর পড়ছি, নীলিমা সান্যাল!'
আরও পড়ুন, ছোটগল্প অমর মিত্র: তাহাদের সংসার
২.
পাটনির চালা পার হয়ে আমগুলো কাছের জঙ্গলেই রেখে এসেছি। দেরি হলেও ঢুকে পড়ব পিছন দিয়ে। সতীশস্যার সুর করে কবিতা পড়াচ্ছেন। ছেলেমেয়েরাও গলা মিলিয়েছে। টুক করে বসে পড়ি। স্যার চশমার ফাঁক দিয়ে দেখলেন মনে হল!
দুই বছর স্কুলে যাচ্ছি। দুই সময়ে ঠিকমতো যেতে পারি না। বর্ষা আর গরমকাল। বোশেখ-জষ্ঠিতে বিষ্টি আর মেঘ ডাকলে মাথার ঠিক থাকে না। ছিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। খানা-খোন্দলে মাছ খুঁজি। ঘোলা স্রোত দিয়ে কই মাগুর টাকি মাছরা হুটপাটি করে। কত যে ঘাই তাদের! না-পাই, ফাতনা ফেলে দেখতেও মজা। স্কুল মনে থাকে না তখন। নীলডাউন, কান ধরে--!
আর এই গরমকাল। আমের গুটি। কাঁচা আম পাকা আম। সিন্দুর রং আম ফেলে ঠিক সময়ে যাওয়া যায়? কুড়োতে কুড়োতেই দেরি। নদীকূলে আগাছা দিয়ে ঢেকে রাখি আমগুলো । তার পর ক্লাশ। বগলে স্লেট আর 'কচিকথা' বই। ছবি-আঁকা গল্পকবিতা।
চার দিক খোলা চালায় ক্লাশ। এত ছাত্র, ক্লাশময় যেন গম গম। তার মধ্যেই দেখে ফেলল, স্যার?
'এই রতন, কী পড়াচ্ছিলাম রে?'
'বক-কবিতা।'
স্যার রেগে যান। 'বক-কবিতা?'
'ক তো!'
বেতের বাড়ি দেখতে পাচ্ছি। গা হিম হয়ে আসে। ধীরগলায় বলতে থাকি--
ঐ দেখা যায় তালগাছ
ওই আমাদের গাঁ।
ওইখানেতে বাস করে কানা বগীর ছা
ও বগী তুই খাস কি, পান্তাভাত চাস কি?
প্লান্তা আমি খাই না
পুঁটিমাছ পাই না
একটা যদি পাই
অমনি ধরে গাপুসগুপুস খাই।
স্যার বললেন নে, বয়!
তার পর দেশবাড়ি, আমার বাল্যস্কুল ছেড়েছুড়ে চলে এলাম সেই আকাশবাণীরই দেশে। কলকাতায় এসে জানতে পারলাম, নামটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া। গড়ের মাঠে পশ্চিম দিকে 'আকাশবাণী ভবন'।
আজ সেই বক-কবিতাটা মনে পড়ল। কবিতা মানেই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! কিন্তু আজ জানলাম, এটি তাঁর লেখা নয়! আশ্চর্য, লেখাপড়ার কিছুই আর মনে নেই। স্যারকে বলেছিলাম নিজের মতো বানানো কবিতার নাম। আর এই কটা লাইন। শুধু এটুকুই মনে আছে।
আরও পড়ুন, আমাদের পহেলা বৈশাখ: বাংলাদেশ থেকে বলছি