গিয়েছিলাম তমলুক বইমেলা। ভারি সুন্দর মঞ্চসজ্জা, ঠিক যেমনটি হবার কথা তমলুকে। ব্যাকস্ক্রিনের ছবিতে একরাশ বইয়ের সঙ্গে মাতঙ্গিনী হাজরা। সুন্দর সাজানো প্রাঙ্গণ। উৎসাহী মানুষজনের ভিড়ে গমগম করছে শেষদিনের দিনশেষ। মাঠের মঞ্চে মনোযোগী শ্রোতাদের সামনে আলোচনা হল জল-সমস্যা জল-রক্ষা নিয়ে।
রাত্রে ঘুমোনো আর পরদিন সকালটুকু কাটানোর জায়গাটি এক সত্যিকারের অবিশ্বাস্য উদ্যান-বাটিকা। সে কথা কখনও আলাদা করে বলতে হবে। একনিষ্ঠ ভালোবাসা, এমনকি একজন মানুষেরও, কী যে করতে পারে, তা দেখার সৌভাগ্য হল আবার।
বাংলা ভাষা ও ভাবনায় ইংরেজি আধিপত্য
তমলুক যাবার একটা বড় আকর্ষণ ছিল যদি কাছেই মহিষাদল রাজাদের তৈরি উনপঞ্চাশটি দীঘি দেখে আসা, অন্য আকর্ষণ তাহলে বর্গভীমা মন্দিরের সুবিখ্যাত দীঘি। সকালে বিশ্বরঞ্জন নামের এক কিশোর আমাকে নিয়ে গেল বর্গভীমা মন্দিরে। বর্গভীমার দীঘির গল্প শুনে আসছি বহুকাল ধরে। বাংলার যেসব দীঘিপুকুরের গল্প বহুকাল ধরে লোকের মুখে মুখে চলে আসছে তার মধ্যে কমলাসাগর কি যোগাদ্যা পুকুরের গল্পের মতই বিখ্যাত বর্গভীমার দীঘির গল্প।
সে গল্প এরকম, তমলুকের প্রাচীন জনপদে এই দীঘি ছিল অন্যতম পবিত্র জলাশয়। এখান থেকে দেবীর পূজোর জল ছাড়াও নেওয়া হত বিশেষ প্রয়োজনে বা অভাবকালের জল। তাছাড়াও এক আশ্চর্য আশীর্বাদ ছিল এই দীঘির ওপর। পল্লীর যে কোনো পরিবারে যদি বেশী লোকজন খাওয়াবার দরকার হত, বেশী বাসন লাগলে এই দীঘিকে আগেরদিন বলে আসতেন গৃহিণীরা। পরদিন ভোরে দীঘির জলে গৃহস্থের প্রয়োজনীয় বাসন ভেসে উঠত। কাজ মিটে গেলে ধুয়েমেজে সে বাসনপত্র আবার দিয়ে আসতে হত দীঘিতে। দীঘি তাই ছিল গাঁয়ের বৌঝিদের কাছে দেবীর স্বরূপ। কিন্তু সেই সুখের শেষ হল কারো একজনের লোভে। সকলে যে আশীর্বাদ পেত, সেই বাসনের মধ্যে একটা থালা কেউ একবার লোভ করে রেখে নিল, ফেরত দিলনা। ব্যস, একের পাপে সবার সাজা, আর ভেসে উঠলনা বাসন।
একসময়ে এসব গল্পকে আমার কিছু বন্ধুদের মত আমিও ভাবতুম কুসংস্কারের আবর্জনা। সেদিন যখন বিশ্বরঞ্জনকে বললাম, ও খানিকটা মন দিয়ে শুনল। সেটা কিছুটা নিশ্চয়ই কিশোরসুলভ গল্প শোনার কৌতূহলে আর কিছুটা বা ওদের নিত্যপরিচিত এই পুকুরকে নিয়ে বাইরেও এরকম গল্প আছে, সেই বিস্ময়ে। স্থানীয় একটি অন্য গল্পও আছে, সেটাও ভাঙা ভাঙা শোনার সৌভাগ্য হল আমার। ভাঙা ভাঙা এজন্য যে বিশ্ব আর তার বন্ধু জয় পুরোটা ঠিক জানে না, ওরকমই শুনেছে। একটা গল্প ছোটবেলা থেকে বারবার শুনলে যেমন মনে থাকে, তেমনটা শোনা হয় নি। শুধু স্কুলের চাপে নয়, ওরা অন্য অনেক কাজ করে, যেমন ওই বিরাট বাগানের পরিচর্যা। প্রত্যেকটা গাছের নাম, ল্যাতিন নাম, স্বভাব, বিশেষত্ব- সব জানে। কিন্তু ওদের কাছে পুকুরের গল্প গুছিয়ে বলবার মত মানুষের কিছুটা অভাব। কেবল তমলুকের ওই ছাতিমতলাতেই নয়, আমাদের আশপাশে সব জায়গাতেই। নিজেদের গ্রাম, নিজেদের পল্লী, নিজেদের সমাজের অভ্যাস – সম্পর্কে ভালো করে, খুঁটিয়ে কিছু জানা, ছোটদের সেসব কথা বলার চল নেই। সময়ও নেই কারণ সেই বলাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় না।
মানুষকে ভালো রাখা, না মানুষের শরীরকে ভালো রাখা?
অথচ একটি ছোট মানুষ যদি নিজের জায়গা, নিজের পরিবার, নিজের সমাজ সম্পর্কে জানতে জানতে বড় হয়, তাহলে সে বড় হয়ে যতদূরেই যাক, যেখানেই বসত করুক, কখনো শেকড়হীন হবার অসংলগ্নতায় কষ্ট পাবে না। চট করে তার স্মৃতি কেউ ভোলাতেও পারবে না। গ্রীক পুরাণে দেবরাজ জিউসের কন্যা মিউজরা বন্দিত হন স্মৃতিরক্ষার দেবী বলেও। বলা হয় তাঁরাই স্মৃতিরক্ষার মধ্য দিয়ে অতীতকে সঞ্জীবিত রাখেন। মানুষ যেন তার অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়-সেটা দেখাই তাঁদের কাজ। স্মৃতিহারা, অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ বড় অসহায়। সে বহুকিছু করে যা সে স্বাভাবিক অবস্থায় কখনই করত না।
এত কথা নতুন করে আবার মনে পড়ল বর্গভীমার দীঘি দেখে। মন্দিরের বিশাল, মার্বেল বাঁধানো চাতাল সুজ্জিত প্রাচীন অশত্থ যার গায়ে মানতের রঙিন খুদে খুদে অসংখ্য ঘট বাঁধা রয়েছে, সর্বাঙ্গে ‘ভক্তি আর বিশ্বাসে’র সযত্ন ছাপ, তার একপাশে কয়েকধাপ সিঁড়ি নেমে পড়ে আছে একটি ছোট, বাঁধানো, অত্যন্ত নোংরা জলাশয় যার নাম বর্গভীমার পুকুর। ‘ভক্তি বিশ্বাস’ বা সম্ভ্রমের কোন চিহ্ন লেগে নেই সেই অবহেলার অসম্মানিত জলাশয়। অথচ সমগ্র পুণ্যস্থানটির মধ্যে সেই ছিল সবচেয়ে জীবন্ত। তার জলে ছোটবড় মাছ ঘাই মারছে এখনো। কিন্তু চারিপাশের বাড়ি গুলি যেভাবে তাকে চেপে ধরেছে, প্লাস্টিক প্যাকেটসহ যে আবর্জনা ভাসছে তার মলিন জলে, তারমধ্যে হয়ত ওইসব বাড়ি থেকে আসা দূষিত জলের ধারাও থাকতে পারে, তাতে সত্যিই মনে একটা ধাক্কা লাগল। নিজের কোন আদরণীয়াকে অন্যের উঠোনে নোংরায় বসে এঁটো বাসনের স্তূপ মাজতে দেখলে যেমন ধাক্কা লাগে! তখন তার পালয়িত্রী রূপ মুছে গেছে, তার সৌন্দর্যমহিমা অবিশ্বসনীয়, নিতান্ত কৃপার পাত্রী যতদিন মরে না যায়, বেঁচে থাকার ঋণশোধ করছে। দেবীমূর্তির মহিমা জানি না কিন্তু তাঁর ইচ্ছাপূরণশক্তির বর্ণনা মানতের গাছে আর ভক্তদের ভীড়ে সপ্রমাণ। তাই মন্দিরচাতালের মণ্ডন আছে, ফুলের দোকান এমনকি জুতোরাখার দোকানেরও স্বর আছে, কেবল যে সবচেয়ে জীবন্ত, যে বাস্তব স্মৃতিবাহী, তার কোনো সুরক্ষা নেই, মহিমা নেই। একসময়ে যে ছিল তার প্রমাণ ওই গল্পগুলো।
মানুষের মুখে মুখে চলে আসা গল্প যে আমাদের সমাজে ইতিহাসকে, মূল্যবোধগুলিকে রক্ষার সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা, সেই কথা আজ আর নতুন নয়। একসময়ে যা ‘দেবতারা আসেন পূর্ণিমার দিনে, ওখানে মানুষকে বেশি যেতে নেই’ ধরনের নিষেধের গল্পবেড়া ছিল, পরে সেরকম সব জায়গা থেকেই উদ্ধার হয়েছে মহেঞ্জোদড়ো, অজন্তা, নাগার্জুনকোন্ডার মত বহু ইতিহাসের প্রামাণ্য সাক্ষ্য, একথা সবারই জানা। তাহলে, একটি পুকুর, যখন তা ‘দেবস্থানের পবিত্র পুকুর’ কিংবা ‘কিংবদন্তীর পুকুর’ বলে চিহ্নিত থাকে, তাকে আমরা একটু গুরুত্ব দিয়ে দেখার, বোঝার, রক্ষা করার চেষ্টা করি না কেন?
সকলেই বুঝতে পারছেন এসব কথা মোটেই কেবল বর্গভীমার দীঘি সম্পর্কে বলছিনা। তার সম্পর্কে অনেকদিনের কল্পনা আর সাধ ছিল বলে ধাক্কাটা লেগেছে জোরে কিন্তু সারা রাজ্যে, আশপাশে সুন্দর পুকুর বলতে কিছু যে আর বাকি নেই সে কী আর জানি না! না, আছে। দিনাজপুরের বিখ্যাত মহীপাল দীঘিসহ বেশ কিছু দীঘিপুকুর দেখেছি আজও।
মাত্র পাঁচবছর আগেও কথা হয়েছিল মহীপাল দীঘিকে চড়া টাকার বিনিময়ে ব্যক্তিগত মালিকানায় মাছধরার ঠিকায় দিয়ে দেওয়া হবে। তীরবর্তী মানুষদের এক হয়ে আপত্তি করায় তা বাস্তবায়িত করা যায় নি। দিনাজপুর এখনো তার ইটাহার (শুনেছি তার মানে নাকি জলের হার), ছাপান্ন গন্ডা(ছাপান্ন গুণিত চার জলাশয়) ছয়ঘটি, নয়ঘটি(ছয় বা নয় ঘাটযুক্ত পুকুর) কালদীঘি ধলদীঘির গর্ব করে। আরো কিছু জনপদও করত নিশ্চয়ই, কিন্তু তাতে তেমন জোর ছিল না। তারা তাই আগাগোড়া বাঁধা পড়ে কেউ শিকারা চালাচ্ছে, কেউ অন্য কিছু ‘ট্যুরিস্ট এট্রাকশান’ জুগিয়ে পয়সা তুলছে। পাঁচিলে কিংবা কাঁটাতারে বাঁধা প্রায় সকলেই। কী করে যে জানা গেল ‘ট্যুরিস্ট’রা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে ভালোবাসেন না, কে জানে!
সে গল্প ভিন্ন। কিন্তু, এই মুহূর্তে পয়সা জোগানো কিংবা খালি জমি হিসাবে, ময়লাফেলার স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হওয়াই দীঘি-পুকুরদের সমাজ বা প্রকৃতি নির্ধারিত কাজ ছিল না। প্রাকৃতিক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চক্রকে অটুট রাখার কাজ করত আমাদের সব জলাশয়। মেঘের যে জল আমরা বিনা শুল্কে, বিনা দামে প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে, প্রচুর পাই, সেই পরম সম্পদকে বছরের বাকি সময়ের জন্য রক্ষাকরে জলাশয়। অর্থাৎ আমাদের মত নিয়মিত মৌসুমী বৃষ্টিধারার দেশে ব্যবহার্য জলের সর্বোচ্চ সুরক্ষা ছিল দীঘি-পুকুর-জলাশয়। সঙ্গে তাদেরই গায়ে লেগে লেগে ছিল আমাদের সামাজিক ইতিহাসের বড় বড় ঘাসের চাপটা।
কখন থেকে নষ্ট হওয়া শুরু হল? কেন হল? সেও সামাজিক রাজনৈতিক ইতিহাস বইকি। জলকে ‘জীবন’ বলে কি আর কাব্য করে?
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে