Advertisment

লকডাউন ও মহম্মদ রফির ভাই

'কথা আছে গুরুভাই। শিয়ালদা না দমদম? কোথায় নামবে?' আমি বললাম, 'শিয়ালদায়।' সুশীলদা পরের গানে গেল। তার হাতে একটা কর্ডলেস মাইক। ট্রেনের তাকে একটা ব্যাটারির বাক্স আর একটা সাউন্ড বক্স।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
'Tin Chokka Putt': Special column by Animesh Baisya on impact of corona man woman relationship

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় অনিমেষ বৈশ্যের বিশেষ কলাম।

সবে চোখটা লেগে এসেছে, এমন সময় চিৎকার, 'ইয়া হু, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে।' তাকিয়ে দেখি, কোথায় শাম্মি কাপুর? কোথায় বরফের পাহাড়? এ তো সুশীলদা। ট্রেন ছুটছে। ঝমঝম আওয়াজ। সুশীলদা রোগা শরীরটা ঝাঁকিয়ে গেয়ে যাচ্ছে, 'ইয়া হু।'

Advertisment

সুশীলদা আগে রিকশা চালাত। প্যাডেলে পা দিয়ে গুনগুন করত মহম্মদ রফির গান। আমি ভাবতাম, কত লোকই তো গায়। সুশীলদাও তেমনই গাইছে। কিন্তু এত ভালো গায় জানতাম না। বহুদিন সুশীলদাকে দেখিওনি। একদিন শুনলাম, সুশীলদা রিকশা বিক্রি করে দিয়ে পাততাড়ি গুটিয়েছে। সেদিন হঠাৎ ট্রেনের কামরায় তাকে গাইতে দেখে আমি তো অবাক। গানটা শেষ হলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর বলল, 'কথা আছে গুরুভাই। শিয়ালদা না দমদম? কোথায় নামবে?' আমি বললাম, 'শিয়ালদায়।' সুশীলদা পরের গানে গেল। তার হাতে একটা কর্ডলেস মাইক। ট্রেনের তাকে একটা ব্যাটারির বাক্স আর একটা সাউন্ড বক্স। ওটাই সুশীলদার সংসার। ওটাই ভাত-কাপড়ের পুঁজি। আগে রিকশার প্যাডেল, এখন মহম্মদ রফি। সুশীলদার এলেম আছে।

পড়ুন, অনিমেষ বৈশ্যের কলাম- করোনা, ঘূর্ণিঝড় ও নিমাইয়ের বৌ

ট্রেন দমদমে ঢুকতেই সুশীলদা যাত্রীদের দিকে হাত বাড়াল। তার আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে কুড়ি টাকা, পঞ্চাশ টাকার নোট। যেন এত টাকাই রোজ তাকে দেয় লোকে। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা পেল পকেটে ভরে আমার পাশে বসল সুশীলদা। হাসিটা রফির মতোই ঝকঝকে। বলল, 'শরীরটা ভালো যাচ্ছে না গুরুভাই। রাতে কাশি ওঠে। ঘুম হয় না। খাটনির জন্য রিকশা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু গানে আরও খাটনি। দিনভর গেয়ে যাই। নৈহাটি থেকে শিয়ালদা। আবার শিয়ালদা থেকে নৈহাটি। আবার...। আর কতদিন গাইতে পারব জানি না। আচ্ছা, গুরুভাই, আমার টিবি হয়নি তো? ও রোগের চিকিৎসায় অনেক খরচ। ভালো ভালো খেতে হয়। দুধ, ফল, পাব কোথায়? দাদা তো এত টাকা দেন না আমায়।'
---দাদা কে?
---মহম্মদ রফি। আমি তো রফির ভাই।
আমি কেঁপে উঠলাম। বলে কী সুশীলদা? মুখে একটা নকল হাসি ঝুলিয়ে বললাম, 'আরে ধুর, ওসব কিস্যু হয়নি। ডাক্তার দেখিয়েছ?' সুশীলদা বলল, 'ডাক্তার দেখাইনি। তবে ওষুধ খাই।'
কী ওষুধ খাও?
---বাসক পাতার রস আর মধু। বাসক গাছ কি এখন পাওয়া যায় ছাই। হাজার জায়গা ঘুরে একটা গাছ খুঁজে পেয়েছি। হাই রোডের ধারে। কেউ যাতে দেখতে না পায় তার জন্য সুপুরির ডাল দিয়ে গাছটা ঢেকে রেখেছি। আচ্ছা নামি এ বার গুরুভাই। পরে দেখা হবে আবার।' ব্যাটারির বাক্স আর মাইক হাতে নিয়ে দ্রুত নেমে গেল সুশীলদা।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন।

ট্রেনের গায়করা আসলে জীবনপুরের পথিক। সবারই একজন ইষ্টদেবতা আছেন। নৈহাটির দেবতা যদি মহম্মদ রফি তো ব্যান্ডেলের দেবতা কিশোরকুমার। বনগাঁর হেমন্ত মুখুজ্জের থানে কেউ পুজো দেন তো, চন্দননগরের কেউ মান্না দে-র থানে। সন্ধ্যা মুখুজ্জের নামে শীতলার থানও আছে। এক অন্ধ দম্পতির সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়। মেয়েটির হাতে টিনের বাটি। ছেলেটির হাতে লাঠি। তাঁরা ডুযেট গান করেন। মেয়েটি যদি বলেন, 'থাক থাক নিজমনে দূরেতে', ছেলেটি আকুল গলায় বলেন, 'আমি শুধু বাঁশরির সুরেতে।' তার পর দুজনে একসঙ্গে গেয়ে ওঠেন, 'পরশ করিব ওর প্রাণমন/ অকারণ/ মায়াবন বিহারিণী।' দু'জনে দু'জনের হাত ছুঁয়ে থাকেন। রবির গান আলো হয়ে নেমে আসে ট্রেনের কামরায়। 'পরশ করিব ওর প্রাণমন অকারণ।'

পড়ুন, অনিমেষ বৈশ্যের কলাম- উত্তমকুমার অথবা বটুরামদার কাঁচি

দু'জনে লাঠি ঠুকে ঠুকে চলে যান এক কামরা থেকে আর এক কামরায়। আমি একদিন বললাম, 'এই যে আপনারা ট্রেনের দরজা ঘেঁষে এক কামরা থেকে আর এক কামরায় যান, পড়ে যাওয়ার ভয় নেই?' ছেলেটির উত্তর, 'আপনি কোনওদিন শুনেছেন, কোনও অন্ধ ট্রেন থেকে পড়ে গেছে? যাদের চোখ আছে তারা পড়ে যায়, আমাদের চোখ নেই ঠিকই, কিন্তু পথ দেখানোর লোক আছে।' মেয়েটির গলায় সুর খেলে, 'কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি কী মিষ্টি এ সকাল।'

ট্রেনের কামরায় সবচেয়ে দাম বেশি কিশোরকণ্ঠীদের। সবার কিশোরদা। শুরু হয় এই ভাবে, 'দাদা, বি কম পাশ করেছি। চাকরিবাকরি পাইনি। কিশোরদার গান গেয়ে খাই। একটা রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে শুরু করছি। সাউন্ডট্র্যাকে বাজনা বাজে। তিনি গেয়ে ওঠেন, 'একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি...।' তার পর আধুনিক, তার পর ছায়াছবির গান, তার পর হিন্দি ছবির গান। একের পর গান গেয়ে চলেন। মাঝে মাঝে তিনিই যে গানটি গাইছেন সেটা প্রমাণ করতে মুখের কাছ থেকে মাইক সরিয়ে খালি গলায় গেয়ে ওঠেন। তাঁরও আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে নোট। সুশীলদার মতো। দাদারা-দিদিরা কেউ দু'টাকা দেন, কেউ পাঁচ টাকা। ট্রেনের কামরা গানে ঝলমল করে। এক সুপারহিট কিশোরকণ্ঠী ইদানীং এক সঙ্গীকে নিয়ে ওঠেন। একটা-দুটো গান গেয়ে তিনি মাইক তুলে দেন সঙ্গীর হাতে। একদিন তাঁকে বলি, আপনি আর বেশি গান করেন না কেন?' তিনি শুধু বলেন, 'গলায় ব্যথা।' কিসের ব্যথা? তিনিও কি সুশীলদার মতো...।

একদিন রাত দশটা নাগাদ দমদম থেকে ট্রেনে উঠেছি। ঠাসাঠাসি ভিড়। তার মধ্যেই দেখি রজনীগন্ধার মালায় ভরে আছে কামরা। জানলায় মহম্মদ রফির ছবি ঝুলছে। আর একজন রফির গান করছেন। কী ব্যাপার? একজন বললেন, 'আজ রফির জন্মদিন। তাই এই আয়োজন।' গানের পর ট্রেনের সব যাত্রীদের অকাতরে লাড্ডু বিলি। ওঁরা কেউ ভিখারি নন। গানপাগল। যে ট্রেনে এত ভিড়, এত মারপিট সেখানে কী করে ছড়িয়ে থাকে এত  ভালোবাসার হিরের কুচি?

বহুদিন ট্রেন চলে না। খাওয়া জুটছে সুশীলদার? কিশোরকণ্ঠীর গলার ব্যথা কেমন আছে? সেই অন্ধ দম্পতি কি কোথাও গাইছেন, 'চিত্ত আকুল হবে অনুখন অকারণ...।' জানি না।

খিদের আওয়াজ পাচ্ছি। সঙ্গে লাঠির আওয়াজ। ঠুক ঠুক ঠুক।

kolkata local train Lockdown corona virus Tin Chokka Putt
Advertisment