সেলুনগুলো টিকলে হয়! বিরাট কোহলি থেকে পাড়ার বটা--সবাই বাড়িতেই চুল কাটছেন। সে চুল কাটার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াচ্ছে। এবং নাপিতের বুকও ছ্যাঁত করে উঠছে। এরপর আর কেউ সেলুনে আসবে তো?
লকডাউনের মধ্যেই একটু একটু করে দোকান-টোকান খুলছে। কিন্তু সেলুন খোলার লক্ষণ নেই। সেলুনের উপর রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু। সেলুন কিছুতেই খোলা যাবে না। কারণ, চুল-দাড়ি কাটতে গেলে দুটো মানুষ কাছাকাছি হয়। নাপিতের নিশ্বাস টাটা-বিড়লার গায়ে লাগে। বুর্জোয়ার ঘাড় ধরে প্রলেতারিয়েতের এমন টানাটানি বোধহয় সেলুনেই সম্ভব। সেলুন বস্তুত সাম্যের পরাকাষ্ঠা। তুমি যেই হও বাপু, তোমার মুন্ডু নিয়ে গেন্ডুয়া খেলার হক শুধু নাপিতেরই আছে।
এবং নাপিতের ভূমিকায় আপাতত মেয়েরাই। মেয়েদের অসীম ক্ষমতার শেষতম সংযোজন পুরুষের চুল কাটা। সরঞ্জাম বলতে একটা কাঁচি আর একটা চিরুনি। নাপিতের বাক্স বলে যে একটা চরম ঐশ্বর্যময় এবং রহস্যে মোড়া জাদুবাক্স ছিল, সেটা আপাতত তালাবন্দি। বাড়ির বারান্দায় পুরুষটি মেনি বিড়ালের মতো ঘাড়টা আভূমিপ্রণত হয়ে আছে। আর নারী ত্রিশূলের মতো এক হাতে কাঁচি আর এক হাতে চুলের গোছা ধরে 'আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী আমি রণদা সর্বনাশী' গোছের ভাব করে অনন্ত আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে কেশদাম। পুরুষের ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দেওয়ার এই সুযোগ মানব ইতিহাসে আর আদৌ আসবে কি না, কে জানে।
পড়ুন, অনিমেষ বৈশ্যের গত সপ্তাহের কলাম- করোনা, ঘূর্ণিঝড় ও নিমাইয়ের বৌ
আমার নিজের চুলটাও বেশ লম্বা হয়েছে। নিজেকে মাঝে মাঝে 'সন্ন্যাসী রাজা'র উত্তমকুমারের মতো লাগছে। সেই দৃশ্যটা মনে করুন। মৃত্যুর(?) বহু বছর পর রাজাবাবু গাঁয়ে ফিরে এসেছেন। গাঁয়ের মেয়ে-বৌরা বলাবলি করছেন, 'শুনেছ তোমরা, নদীর ধারে এক সাধুবাবা এসেছেন। তাঁকে নাকি একদম আমাদের রাজাবাবুর মতো দেখতে।' এই শুনে দাবা-পাশার অনন্ত অবকাশে মত্ত রাজাবাবুর চেলারা ছুটলেন নদীর ধারে। সেখানে বসে রাজাবাবু ওরফে উত্তমকুমার। লম্বা চুল কানের পাশ দিয়ে নেমে এসেছে ঘাড় অব্দি। চুলের অবগুণ্ঠনের পাশ দিয়ে রাজাবাবু বিলম্বিত লয়ে ঘাড়টা প্রজাদের দিকে ঘোরালেন। এমন স্বর্গীয় 'লুক' আর কোনও সিনেমায় কেউ দেখেছে কি? উফফ, গুরু গুরু। ওই চুলে প্রশান্তি আছে, ওই চুলে চাল-ডাল-অম্বল-আমাশা থেকে মুক্তির দিগন্তজোড়া ডাক আছে। মনে হচ্ছে, সকল গৃহ হারাল যার তোমার চুলে তারই বাসা। তা আমারও প্রায় দার্শনিক উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়া ওই চুলটাকে ছেঁটে ফেলতে বড় মায়া হচ্ছে। মনে পড়ছে বহু যুগ আগে মরে-হেজে যাওয়া বটুরাম ঠাকুরের কথা।
বটুরামদা ছিল বিহার থেকে আগত এক পরিযায়ী নাপিত। পরিযায়ী বলতে তখন আমরা শুধু পাখিকে বুঝতাম। শ্রমিকও যে 'পরিযায়ী' হয় তা তখন জানা ছিল না। পেটে কিল মারা শ্রমিকদের আগে এমন একটি রোমান্টিক শব্দ জুড়ে দেওয়ার কথা তখন কাগজওয়ালাদের মাথায় আসেনি। তা যাই হোক, বিহারের বেগুসরাই থেকে বটুরামদা খ্রিস্টপূর্ব কত সাল নাগাদ এ মুলুকে এসেছিল তার কোনও হদ্দহদিস ছিল না। উচ্চতায় প্রায় ছ'ফুট। রোগা ছিপছিপে। হেঁটো ধুতি আর ফতুয়া। গলার স্বরটি ছিল অতীব ঘ্যাসঘেসে। সপ্তসুরের একটিও তার গলার ত্রিসীমানায় ঘেঁষত না। তবে মানুষটি ছিল বড় ভালো। পাড়ার এক ধারে এক পর্ণকুটিরে বটুদা থাকত। ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়-এর অদূরে ছিল একটি বাঁশঝাড়। তৃণভূমিতে ঘুরে বেড়াত দুটি দুগ্ধফেনিল খরগোশ ছানা। একটা ফলসা গাছ ছিল। আর ছিল একটা নেড়া নোনা গাছ। সেই গাছের নীচে পাতা থাকত মগধের অনিবার্য প্রতীক একটি দড়ির খাটিয়া। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় সেই খাটিয়ায় বসে শ্রীরামচন্দ্র ও হনুমানের স্মরণে নানাবিধ সুর সংযোজন করত বটুদা। সে চেষ্টা কদাচ সফল হয়েছে এমন অভিযোগ কেউ কোনও দিন তোলেনি।
তা যাই হোক, বটুদার সেলুন ছিল পাড়ার মোড়ে। শিমুল গাছের নীচে। হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও ছিল। মানে একটু তদ্বির করলে বাড়িতে এসেও চুল কেটে দিত। বগলে থাকত সেই আশ্চর্য নাপিতের বাক্স। কেন কে জানে, চুল বড় হওয়ার সঙ্গে বখে যাওয়ার একটা দুর্বোধ্য সম্পর্ক ছিল। বাঙালি রবীন্দ্র-নজরুলের পুজো করে বটে, কিন্তু তাঁদের লম্বা চুলের সঙ্গে যে কাব্যপ্রতিভার কোনও সংঘাত নেই, এটা যেন বাপ-কাকারা বুঝেও বুঝত না। সবারই ধারণা, শ্রীমানের চুল অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা অবিলম্বে কর্তন না করলে উচ্ছন্নের রাস্তা অতি সুগম। বটুরামদা চুল কাটার আগে বাপ-কাকারা নিষিদ্ধ ফিসফিসানির মতো কী একটা বলত। সেই ফিসফিসানির বেদমন্ত্র ছিল, চুলটা যত পারো ছোট করো। আজ অব্দি কোনও মহামানবের আমি ছোট চুল দেখিনি। তবু কেন যে বড় চুল নিয়ে এত বিরাগ তা আমার বোধগম্য হয়নি। একবার পাড়ার এক দাদাকে শুধুমাত্র বড় চুল আছে বলে নকশাল সন্দেহে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সে বেচারা বাজারে সবজি বিক্রি করত। চিনের চেয়ারম্যানকে কোনও দিনই নিজের চেয়ারম্যান ভাবেনি।
তা বটুদা বাক্স খুলে যন্ত্রপাতি বের করত। একটি সুপ্রাচীন মরচে ধরা কাঁচি। আর খান কতক নানা মাপের চিরুনি। আমার কেন জানি মনে হত, চাণক্যর টিকিও এই কাঁচিতেই কাটা হয়েছিল। আমি বসতাম একটি ব্যাটারির বাক্সে। বটুদা তার লিকলিকে দুই হাঁটুর ফাঁকে আমার মাথাটা ফরসেপের মতো চেপে ধরত। তার পর কাঁচি চালাত এক অপূর্ব তাল-লয়ে। আমার ঘাড় টনটন করত। মাথাটা মুক্তির আশায় ছটফট করত ঘনঘন। কিন্তু বটুদা কিছুতেই হাঁটু দুটো আলগা করত না। মিনিট পনেরোর নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচারের পর যখন বটুদা হাঁটু আলগা করত, তখন নিজেকে খাঁচা ছাড়া অচিন পাখি মনে হতো। বটুদা ভাঙা আয়নাটা সামনে ধরত। এ কী! এ কি আমি? নিজেকেই যে চিনতে পারছি না।
অবিশ্যি নিজেকে কে-ই বা কবে চিনেছে! আজ এই তালাবন্দির দুঃসময়ে মাঝে মাঝেই ভাঙা আয়নাটা খুঁজি। যদি একটু নিজেকে দেখা যায়। কিন্তু পাচ্ছি কই!