সেদিন এক সাহিত্যিককে একজন বলছেন, 'শুনুন মশাই, লাদাখ দিয়ে অনেক চিনা সাহিত্যিক ঢুকে পড়েছেন। আপনাদের লেখা আর কেউ পড়বে না। কলেজ স্ট্রিটে যাবেন চিনা বই, শিয়ালদা ইস্টিশনে যাবেন চিনা ম্যাগাজিন, হাওড়ায় ট্রেনে উঠে চিনা বই খুলে বসবেন। আপনারা বাতিল।'
কথাটা নেহাতই রসিকতা। ওই সাহিত্যিকও এই সব সর্বনেশে কথা শুনে হেসে বললেন, 'বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছি হে। এ বার তো দেখছি ভাত-কাপড় নিয়ে টানাটানি। চিনা মোবাইল, চিনা ফ্রিজের মতো এ বার বাজারে এল নতুন চিনা লেখক।'
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন।
তবে চিনা লোকের আমদানি বাংলাদেশে নতুন নয়। ১৯৩৭ সালে শান্তিনিকেতনে চিনা ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়। তার পর বহু চিনা গুণীজন দলে দলে কবির আশ্রম ভরিয়ে তোলেন। রানি চন্দ সকৌতুকে লিখলেন, 'চিনে পণ্ডিত, চিনে শিল্পী, চিনে ছাত্র-শিক্ষকে বাড়ি ভরে গেল।' বিশ্বভারতীর মূলমন্ত্রই ছিল, যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম--বিশ্ব এসে যেথায় নীড় বাঁধে। এই বিশ্বের মধ্যে চৈনিক মানুষের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। চিনা ভবন প্রতিষ্ঠায় কবির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন চিনের গবেষক তান য়ুন শান। তান-এর সঙ্গে কবির আলাপ হয় সিঙ্গাপুরে। কবির ডাকেই তিনি শান্তিনিকেতনে আসেন। এর পর দু'জনে হাত ধরাধরি করে গড়ে তোলেন চিনা ভবন। চিনের সমাজতান্ত্রিক সরকার তান-এর বাড়ি অধিগ্রহণ করেছিল। তাই তাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁইও ছিল না। শেষ পর্যন্ত বোলপুরের রাঙামাটির দেশেই তান খুঁজে পেলেন আপন নীড়। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে উঠলেন কবির আশ্রমেই। দুই চিনে বালক-বালিকা বড় হল আশ্রমেই। তান-এর মেয়ে বাংলা স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। তান-এর তৃতীয় সন্তানের জন্ম বোলপুরেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম রেখেছিলেন চামেলি। চিনা ভবনের দেওয়ালে নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি জ্বলজ্বল করছে।
১৯২৪ সালে কবি চিন ভ্রমণে যান। ভারত-চিনের মধ্যে সম্পর্কের ভিত মজবুত করতে কবি উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে তাঁর উদ্যোগ কতটা সফল হয়েছে ইতিহাসই তা বলবে। চিনে কবির সঙ্গে আঠার মতো লেগে ছিলেন তরুণ কবি সু সি মো। তিনি ছিলেন রবীন্দ্র অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথ চিন দেশে প্রচুর চায়ের সরঞ্জাম উপহার পেয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে ফিরে তিনি সু সি মো-র নামে একটি চা চক্রের আয়োজন করেছিলেন। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান সু সি মো।
অনিমেষ বৈশ্যের আরও কলাম- এখন দেশটা আমার
কলকাতার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ও চাঁদনি চক এলাকায় প্রচুর চিন দেশের লোক বাস করেন। তাঁরা মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। কবে তাঁরা স্বভূমি ছেড়ে কলকাতায় এসেছিলেন তা জানা নেই। চিনের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের সূচনা হয় সম্ভবত কবির হাত ধরেই। তবে রুশ সাহিত্য বা উপকথা এ দেশে যতটা জনপ্রিয় হয়েছে, চিনা সাহিত্য তার ধারকাছ দিয়েও হাঁটেনি। লু সুন ছাড়া কোনও চিনা লেখকই বাংলায় ততটা জনপ্রিয়তা পাননি। সত্তর দশকে চিনের চেয়ারম্যানকে আমাদের চেয়ারম্যান করে বাংলার বহু তরুণ বিপ্লবের বহ্নিশিখা জ্বলিয়েছেন বটে, কিন্তু চিন যেন বরাবর আমাদের কাছে দূরের দেশই থেকে গেছে। চিনা সামগ্রীতে গেরস্থালি ভরে উঠলেও চিন কোনওদিনই ভারতবন্ধু হয়ে ওঠেনি সেভাবে। বরং আর এক সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়া ছিল আমাদের অনেক কাছের। রুশ সাহিত্য ও উপকথা আমরা ছোটবেলা থেকে গিলেছি। সোভিয়েত দেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পত্রিকার চকচকে পাতা দিয়ে বইয়ের মলাট দিয়েছি। রাশিয়ার 'দাদুর দস্তানা' যেন বাংলার এঁদো গাঁয়ের দস্তানা। গোর্কির 'মা' যেন আমারই মা। নিকোলাই অস্ত্রভস্কির 'ইস্পাত' তখন মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে ঘরে। যাঁরা কমিউনিস্ট নন, তাঁরাও ওই সব ঝকঝকে ছাপার বই পড়তেন। কারণ প্রচার-পুস্তিকা ছাড়াও বিশুদ্ধ সাহিত্যরসের বই মিলত নামমাত্র মূল্যে। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের অবশ্যপাঠ্য ছিল। আমি ওই বইটা কিনেছিলাম আট আনায়। লেনিনের 'রাষ্ট্র'-র দামও ওই চার-আট আনা ছিল। চেকভের নাটক বা স্তানিস্লাভস্কির নাট্য পরিচালনার বইও মিলত প্রায় লেড়ো বিস্কুটের দামে। অতএব এই সব বই ও প্রচার পুস্তিকার গুণে রাশিয়ার শ্বাসপ্রশ্বাস আমরা যেভাবে টের পেয়েছি, চিনেরটা সেভাবে পাইনি।
অনিমেষ বৈশ্যের আরও কলাম- সাইকেলের রডে বনলতা সেন
পুজোর সময় প্রায় প্রতি পাড়ায় সিপিআইয়ের কর্মীরা বইয়ের দোকান দিতেন। সেখানে যাঁরা দোকানদারি করতেন তাঁরা ছিলেন অতীব সুভদ্র। মদ্দ-জওয়ান খুব কমই ছিল। অধিকাংশেরই মাথাভর্তি পাকা চুল। কেউ কেউ ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের সমঝদার। তাঁরা রাজনীতির লোক হয়েও যেন রাজনীতি থেকে কিঞ্চিৎ দূরে থাকেন। পঞ্চায়েতের চাপাকল খারাপ হলেও তাঁরা 'সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের' গন্ধ পেতেন। মেদিনীপুর বা বাঁকুড়ার চেয়ে নিকারাগুয়া বা গুয়াতেমালার ঘরদোর তাঁরা চেনেন বেশি। তবে মানুষগুলি খুবই সৎ এবং শিক্ষিত। কে যেন বলেছিল, 'কার্ল মার্ক্স ও রবীন্দ্রনাথকে একটা বোতলে ভরে কিছুক্ষণ ঝাঁকালে যিনি ধরাধামে পদার্পণ করবেন তিনি সিপিআইয়ের লোক।' শ্রেণি সংগ্রামে আছি, নিরাকার ব্রহ্ম নিয়েও আছি। সাইবেরিয়ার তৃণভূমি কিংবা ক্রেমলিনের প্রাসাদের সঙ্গে আমাদের সেতুবন্ধন করেছেন ওই পাকা চুলের মানুষগুলোই।
একটা দেশের সঙ্গে আমরা কতটা আত্মীয়তা অনুভব করি তা বোঝা যায় সন্তানের নামকরণে। রেলবস্তি, বাঙাল কলোনি, মধ্যবিত্ত পাড়া তখন মুড়ে আছে রুশ নামাবলিতে। আমাদের পাশের বাড়িতেই আছে দুই ভাই ক্রুশ্চেভ ও কোসিগিন। ঠাকুমার নাম শিবরঙ্গিণী, কিন্তু নাতির নাম ক্রুশ্চেভ। রোগা ডিগডিগে উনপাঁজুরে ফুটবলারের নাম ছিল গোর্কি। রাশিয়ার মহাকাশ অভিযানের বছরে জন্ম বলে সীতার মা ছেলের নাম রাখলেন গ্যাগারিন। ঢাকা থেকে আগত উদ্বাস্তু ছেলেকে বলছেন, 'অ গ্যাগারিন, দুফইরা বেলায় যাস কই। কলমি শাক দিয়া দুগা ভাত খাইয়া যা।' রেল লাইনের ধারে যত লেনিন কলোনি আছে, তার ঘরে ঘরে যদি একজন খুদে বলশেভিক থাকত, তা হলে বাংলায় কবে বিপ্লবের আগুন জ্বলে যেত। কিন্তু তা আর হল কই! তবে কোনও বাঙালি ছেলের নাম মাও জে দং বা চৌ এন লাই রাখেনি। বাঙালি জিহ্বায় মাও বা চৌ খুব শ্রুতিমধুরও হতো না নিশ্চয়। রাশিয়ার কাছে এখানেই চিনের পরাজয়।
তবে নামে কী আসে যায়! গোর্কি বিড়ি বাঁধছেন, নিকিতা ক্রুশ্চেভ লোকাল ট্রেন চালাচ্ছেন, গ্যাগারিন কোথায় ঘাঁটি গেড়েছেন জানি না।।
এক জীবনে কত কী দেখলাম রে ভাই!
অমিমেষ বৈশ্যের সব কলামগুলি পড়ুন এখানে