ঠিক যখন যুদ্ধ বাঁধে বা যুদ্ধ বাঁধার মতো অবস্থা হয়, তখন মনে হয় দেশটা আমার। বাকি দিনগুলোয় আমি আমার মধ্যে ডুবে থাকি। দেশ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা থাকে না। তখন আমার বাড়ি, আমার জমি, আমার পাটখেত, আমার ভাঙা সাইকেল---সব আমার। দেশ মানে তখন যে রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ায়, দেশ মানে যে ব্যাঙ্কের সুদ কমায়, দেশ মানে যে লালকেল্লায় ওড়ায় দুরন্ত তেরঙা। দেশের উত্তরে হিমালয়। আমার বাড়ির উত্তরে দত্তদের পাঁচিল। দেশের দক্ষিণে সাগর, পশ্চিমেও সাগর। আমারও আছে দক্ষিণে মজা খাল, পশ্চিমে হাঁসচরা বিল। দেশের পুবে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশ তো আমারই দেশ।
এই যে এখন লাদাখের গালওয়ান নদীর উপর একটি সেতু তৈরি হল। ষাট মিটার লম্বা ওই সেতুটি এখন আমার সেতু। যেহেতু এখন চিনের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব এবং ওই সেতুই নষ্টের গোড়া তাই ওই সেতুটি শুধু দেশের নয়, আমারও। আমি এতদিন সেতুটির কথা শুনিনি। শোনার দরকারই মনে করিনি। কিন্তু যেই যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব, ওই সেতুটি এখন আমার। সেতুটি কেউ ভেঙে দিলে যেন আমারই ঘর ভাঙে। সেতুটি গড়ে উঠলে যেন আমারই আত্মার নিত্য চলার পথ তৈরি হয়। সেতুর উপর যে আকাশ, সেতুর নীচে যে কুলকুল নদী তা আর কিছু নয়, আমারই অংশ। আমার দেশপ্রেম জেগে ওঠে। প্রেম থেকে প্রতিহিংসা, প্রতিহিংসা থেকে যুদ্ধ।
পড়ুন, অনিমেষ বৈশ্যের কলাম- লকডাউন ও মহম্মদ রফির ভাই
আমি জানি ফি বছর কোথাও বন্যা হয়, কোথাও খরা। কেউ ডুবে মরে, কেউ জ্বলে মরে। ধানের চারা ডুবে যায়, ধানের চারা পুড়ে খাক হয়ে যায়। বিপন্ন কৃষক কেউ খড়কুটো খুঁজে মরে। কেউ পায়। কেউ পায় না। কেউ ভাঙা ঘরের চালাতে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ে। মৃত্যুর সময় মোরগ ডাকে, পুকুরে হাঁস চরে, দিগন্তে হাওয়া বয়। তখন দেশটা আমার নয়। শুধু ওই মরা লোকটার। মরা লোকটার স্বজন কাঁদে, বিলাপ করে, ভাঙা ঘরের ফাঁক দিয়ে দেখে উড়ন্ত চিল। তখন দেশ আমার নয়, মৃত্যু আমার নয়, আমি আছি আমাকে নিয়ে।
কখন এই দেশ আমার?
যখন যুদ্ধ বাঁধে বা যুদ্ধ বাঁধার মতো অবস্থা হয় তখন...।
পড়ুন, অনিমেষ বৈশ্যের কলাম- উত্তমকুমার অথবা বটুরামদার কাঁচি
এ রাজ্যের দু'জন সেনা মারা গেলেন। কেউ বললেন নিহত হলেন। কেউ বললেন শহিদ হলেন। একপক্ষ বললেন, 'জওয়ান কখনও শহিদ হন না। কারণ তিনি বেতনভুক। লোকে যেমন রেলে, ব্যাঙ্কে, সওদাগরি আপিসে চাকরি করতে যায়, এটাও স্রেফ তেমন একটা চাকরি। শহিদ হলেন ক্ষুদিরাম, বিনয়-বাদল-দীনেশ। ওঁরা দেশের কাজ করেছেন। পয়সা নেননি।' আর এক পক্ষ বলবেন, 'ধুর মশাই। আপনি আঁতেল না হয় আরবান নকশাল। যে জওয়ান নিজের জান বাজি রেখে দেশের সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন, যিনি মা-বাবা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা থেকে অনেক দূরে থেকে সামলাচ্ছেন দেশের সবার ঘরদোর, তিনি শহিদ হবেন না তো কি আপনি হবেন? যত্ত সব!'
যিনি মারা গেলেন তিনি জানেন না, তিনি আসলে কী? নিহত? নাকি শহিদ? শুধু তাঁর মা-বাবা জানলেন তাঁদের বুকের ভিতরটা খাঁ খাঁ। সেখানে হৃদপিণ্ড নেই, অলিন্দ নেই, নিলয় নেই, শুধু খোকার অবিরল শ্বাসপ্রশ্বাস। ওই শ্বাসপ্রশ্বাসের নাম 'নিহত' নাকি 'শহিদ' তা তাঁরা জানেন না। তাঁরা জানেন, খোকা এই সেদিনও পায়ের বুড়ো আঙুল মুখে পুরে খিলখিল হাসত, তাঁরা জানেন, বড় হয়ে হিম পর্বতে ওই খোকা দেশ পাহারা দিত। পাহারার বিনিময়ে তাঁদের খাবার জুটত। কখন দেশটা আমার, কখন?
শুধু যখন যুদ্ধ বাঁধে বা যুদ্ধ বাঁধার মতো অবস্থা হয়, তখন।
পড়ুন, অনিমেষ বৈশ্যের কলাম- করোনা, ঘূর্ণিঝড় ও নিমাইয়ের বৌ
আমি কত কী জানি, কত কী শুনি---কোনও সময়েই দেশটাকে আমার দেশ মনে হয় না। দেশের বহু লোক আধপেটা খায় আমি জানি। দেশের বহু লোক নিরক্ষর আমি জানি। দেশের কত লোক শীতের রাতে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকে, আমি জানি। কিন্তু কোনও দিন দেশটাকে আমার মনে হয় না। আমি একটা শিশুকেও অক্ষর চেনাইনি, আমি একজন ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে একটা দানা তুলে দিইনি, আমি কখনও একজন আত্মঘাতী কৃষকের উঠোনে বসে গুড় দিয়ে মুড়ি খাইনি। কারণ, তখন দেশটা আমার নয়। যখন সীমান্তে যুদ্ধের বাদ্যি বাজে, তখনই দেশটা আমার।
এই তো কিছুদিন আগে তামিলনাড়ু থেকে হাঁটতে হাঁটতে ছত্তিসগড়ে আসছিল এক কিশোরী। গাড়িঘোড়া বন্ধ, বহুদিন মা-বাবার মুখ দেখেনি। তাই শুরু হল হাঁটা। বাড়ির কাছাকাছি চলেও এসেছিল। কিন্তু ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়ল মেয়েটি। নিথর দেহ পড়ে রইল পথের ধারে। তখন দেশটা আমার ছিল না। তখন দেশটা আমার মনে হয়নি।
কিন্তু এখন হচ্ছে। সীমান্তে সেনার প্রাণ গেছে। সরকার করছে কী? বদলা চাই, বদলা চাই। কেউ কেউ বলছেন, চিনা পণ্য বয়কট করো। খেলনা, পুতুল, টিভি, ফ্রিজ, করোনার কিট সব বয়কট করো। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের জুতোর দোকান বয়কট করো। এখন আমার দেশপ্রেম জেগে উঠেছে।
কিন্তু বাপু হে, বদলা চাইলেই তো বদলা নেওয়া যায় না। এখন কেউ যুদ্ধ চায় না। ভারতও নয়। চিনও নয়। আর চিন কিন্তু পাকিস্তান নয়। যে উড়োজাহাজে চড়ে দুটো আধলা ছুড়ে এলাম। তবু আমার যুদ্ধ চাই। হাল্লা রাজার মতো থেকে থেকে বলে উঠছি, যুদ্ধ যুদ্ধ।
এখন দেশে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। এখন এ দেশ আমার। ওই গালওয়ান নদী আমার, ওই পাহাড়ের সানুদেশ আমার, ওই সেনার মা আমার মা, ওই সেনার বাড়ি আমার বাড়ি। বাকি সময় যাই হোক। এখন যে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব! এখন এ দেশ আমার।