সেই বইওয়ালাকে আর দেখি না। চোখে চশমা, গায়ে ধুতি ও ফতুয়া। পায়ে স্যান্ডেল। অনেকটা দই চাই দই-এর মতো তিনি হাঁক দিতেন, বই চাই, বই। গলাটি আজও কানে বাজে। সুরেলা।
বই বলতে গোপাল ভাঁড়, আদর্শ লিপি, সচিত্র যোগ ব্যায়াম, ভারতের মানচিত্র ইত্যাদি। কাঁধে ঝোলা। তাতে উঁকি দিচ্ছে রঙিন মলাট। মনে হতো, রোদ্দুর উঁকি দিচ্ছে। আমি কোনও দিন কিনতাম। কোনও দিন কিনতাম না। তখন বই কেনা ছিল বিলাসিতা। তবু আমি কিনতাম। গোপাল ভাঁড়কে আমার বড় ভালো লাগত। বইওয়ালা নেই। কবে মারা গেছেন জানি না। তবে শুনেছি মারা গেছেন। আমি যাঁদের ভালোবাসতাম, তাঁরা কেউই প্রায়ই বেঁচে নেই। শুধু আমি বেঁচে আছি। কেন আছি, জানি না।
বইওয়ালা একা মারা যাননি। তিনি আমাদের বাড়ির গলির যাবতীয় অনুষঙ্গ নিয়ে মারা গেছেন। গলির দু'ধারে অনেক ঝোপঝাড় ছিল। নেই। বাড়িগুলো ছিল টিনের অথবা টালির। নেই। গলিতে হাঁস-মুরগি চড়ত। নেই। কিছুই যখন নেই, তিনিই বা থাকবেন কেন?
এখন কোনও দৃশ্যের জন্ম হয় না। পুরোনো দৃশ্য ঘুরেফিরে আসে। চশমার ঘষা কাচ দিয়ে সেগুলি দেখি। ওগুলো আমার আফিংয়ের গুলি। আমি তা নিয়মিত সেবন করি। এবং রোজ একটু একটু করে তামাদি হয়ে যাই। আমার মন্দ লাগে না।
আজকাল কেউ গলির ফেরিওয়ালার কাছে বই কেনে না। কেনার উপায়ও নেই। দরকার তো নেই-ই। হাতের মুঠোয় যখন বই পাওয়া যায়, তখন ফেরিওয়ালার কী দরকার! তবে বই আমাদের বড় গর্বের জিনিস। পড়ি অথবা না-ই পড়ি।
আমরা নানা অছিলায় জানিয়ে দিই, আমাদের বাড়িতে কত বই আছে। টেলিভিশনের সঞ্চালক অথবা গায়ক বইয়ের আলমারির সামনে বসে অনুষ্ঠান করছেন। আমরা দেখছি তাঁর বাড়িতে কত বই। বইয়ের বদলে চিনে মাটির সরঞ্জাম, বাঘের চামড়া, মোষের শিংও থাকতে পারত। কিন্তু তা থাকেনি। কারণ বই আমার বড় গর্বের জিনিস। আর সেই বই যদি দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্বোধ্য হয়, তা হলে তো কথাই নেই। অনেকেই দেখি রোজ জানিয়ে দেন, আজ বইয়ের ঘরটা ঝাড়পোঁচ করলাম। কত পুরোনো বইয়ের গন্ধ ভেসে এল, কত স্মৃতি, বিস্মৃতি ইত্যাদি। কেউ বলেন না, আজ গুদাম ঘর বা রান্নাঘর পরিষ্কার করলাম। আমরা দিনভর বুদ্ধিজীবীদের গালাগালি দিই। কিন্তু আমরা সবচেয়ে ভালোবাসি বুদ্ধিজীবী হতে। একটু বুদ্ধিজীবী হওয়ার জন্য আমার প্রাণ কাঁদে। বুদ্ধিজীবী হওয়ার যাবতীয় অনুষঙ্গ আমি খুঁটে খাই। বুদ্ধিজীবী হওয়ার ঢাক বেজেই যায়। থামে না।
ওই বইওয়ালার মতো কত লোক আজ নেই। নানা কিসিমের চরিত্র ঘুরঘুর করত পথেঘাটে। এখন নেই। যেন সবাই একই ছাঁচে তৈরি। যেন একটাই মানুষকে আটশো কোটি টুকরো করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পৃথিবীতে। একই মানুষের সাড়ে আটশো কোটি সতীপীঠ। সবারই একই মন্ত্র।
গুলবাজ বা বাতেলাবাজ লোক এখন পাড়ায় নেই। টেনিদা বা ঘনাদা কোনও চরিত্র নয়। বাঙালি সমাজের একটি অংশের প্রজেকশন। সব পাড়াতেই একজন টেনিদা সংস্করণ ছিল। অনেকেই মহর্ষি হওয়ার বাসনায় বনে গিয়ে ধ্যান করত। আমাদের পাড়ায় ছিল চক্কোত্তি খুড়ো। গাঁজার ছিলিমে টান দিলে খুড়োর হিতাহিত জ্ঞান থাকত না। খুড়ো শুরু করত, 'তা বুঝলি অনেক দিন আগের কথা। উনিশশো তিপ্পান্ন বা চুয়ান্ন সাল হবে। আমি তখন...।'
আমি বললাম, 'স্বাধীনতার আগে খুড়ো?' খুড়ো বলত বহু আগে, বহু আগে। কথার মাঝখানে কথা বলিস না। তা গাড়ু হাতে বনে গেছি...।'
---ধ্যান করতে?
---আহ, ধ্যান করতে কেন? প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। গাড়ু হাতে বসেছি। হঠাৎ শুনি পিছনে খচখচ আওয়াজ। তা পিছনে না তাকিয়ে দিলাম গাড়ুটা ছুড়ে। আর সাড়াশব্দ নেই। কিছুক্ষণ বাদে গিয়ে দেখি গাড়ুর ঘায়ে একটা বড় বাঘ মরে পড়ে আছে।'
চক্কোত্তি খুড়ো মারা গেছে। খুড়োর ঘরে কোনও বইয়ের আলমারি ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলাম ছাড়া কোনও লেখকের নামই শোনেনি। কিন্তু কত গল্প জানত খুড়ো। কত গল্প বানিয়ে ফেলত নিমেষে। কোনওদিন খাওয়া জুটত। কোনওদিন জুটত না। কিন্তু মেজাজটা ছিল উচ্চমার্গের। ওই গাঁজায় ফোঁপরা হয়ে যাওয়া বুকে এত বাঘের গর্জন কী করে লুকিয়ে রাখত খুড়ো? খুড়োর কোনও দেখনদারি ছিল না। গাঁজার ধোঁয়ায় হলুদ অমলতাসের মতো ঝিলিক দিত খুড়োর বাঘ মারার গল্প।
সেদিন পাড়ার পাঠাগারে গিয়েছিলাম। কেউ আসে না। কিন্তু আজও টিকে আছে। দু'একটা ভাঙা চেয়ার, কিছু ঝুলে ভরা আলমারি। ছোটদের বইয়ের জন্য যে আলমারিটা ছিল সেখানে ছুটে গেলাম। গ্রন্থাগারিক ভদ্রলোককে বললাম, 'একটু চাবিটা দেবেন?' তিনি কান খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন, 'কী খুঁজবেন? অতীত?' আমি বললাম, 'বটকালীর জঙ্গলে' বইটা আছে? কিংবা 'কেউটের ছোবল?' 'নিঝুম রাতের কান্না' বইটিই বা কোথায়? গ্রন্থাগারিক হাসলেন। তাঁর হাসিটা ক্রমে উচ্চকিত হল। বললেন, 'ওসব বই আজকাল কেউ পড়ে না। নেইও। তবু বলছেন যখন খুঁজে দেখুন।' আমি আলমারি খুলে বই হাতড়াতে থাকলাম। চল্লিশ বছর আগের একটা গন্ধ ভেসে এল। আমি চিনি এই গন্ধ। কাঁচা তেঁতুল, বুনো কুল, গোলাপি হাওয়াই মিঠাইয়ের গন্ধে ভুরভুর করছে আলমারি। একটা টিকিটিকি মহাকালের মতো টিকটিক করে উঠল। আমি ভূতে পাওয়া মানুষের মতো 'বটকালীর জঙ্গলে' খুঁজে যাচ্ছি। গ্রন্থাগারিক হাসছেন। দু'একটা মৃত বইপোকা আমার তালুতে। আমি পোকার গন্ধ শুঁকছি। বহুদূর থেকে সেই গলির বইওয়ালার ডাক শুনতে পাচ্ছি, বই বই, বই চাই? গলির ঝোপঝাড়, গলির হাঁস-মুরগি, গলির গোপাল ভাঁড় ঘুরঘুর করছে আলমারিতে। আমি বুঝতে পারছি আমি ফের তামাদি হয়ে যাচ্ছি। যেমন যাই রোজ। একটু একটু করে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন