শিল্পীরা সব সমাজের বিবেককে ধারণ করে এসেছেন যুগ যুগ ধরে। তাঁদের কাজ দিয়ে, তাঁদের ভাবনা দিয়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষের বলতে না পারা কথাগুলো শিল্পীরাই তো বলে এসেছে। আর শিল্পীরা তো একজনের কথা বলেন না, অনেক মানুষের হয়ে বলেন। আর তাই, শিল্পীরা যখন গলা তোলেন, সত্যি বলার দায়টাও তাঁদের ওপরেই বর্তায়।
সম্প্রতি এয়ারপোর্ট অথোরিটি অব ইন্ডিয়া আয়োজিত টিএম কৃষ্ণর কনসার্ট বাতিল করে দিল, তা আমায় খুব অবাক করেছে। একদল মানুষ প্রতিবাদ করেছেন এই বলে, কৃষ্ণ আমাদের রাজধানীতে অনুষ্ঠান করতে পারবেন না। এইখানেই আমার সমস্যা। অনুষ্ঠান তো একা টিএম কৃষ্ণর ছিল না। আমারও ছিল, হ্যাঁ আমার মতো অনেক শিল্পীর অনুষ্ঠান করার কথা ছিল।
পাঁচ দশকের ওপর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এক শিল্পীর পক্ষে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া এবং বাতিল হওয়া, দুইয়ের জন্যই অনেক প্রস্তুতি লাগে। আমি নিশ্চিত এটাই কৃষ্ণর প্রথম বাতিল হওয়া অনুষ্ঠান নয়। এর আগেও নিশ্চয়ই একাধিকবার হয়েছে।
টিএম কৃষ্ণর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সবাই জানেন। এর আগে দেশের কোথাও অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয়নি তাঁকে। উনি ভবিষ্যতে অনুষ্ঠান করার আরও অনেক মঞ্চ পেয়ে যাবেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। শাসক দলের সঙ্গে শিল্পীর বনিবনা নাই হতে পারে। শাসক দলের প্রধানের সঙ্গে তিক্ততা থাকতে পারে। কৃষ্ণর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিন্তু শিল্পীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হবে? এ ক্ষেত্রে হল কিন্তু।
আমার বক্তব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এবার আসি। শিল্পীর অধিকার আছে শাসক দলকে অপছন্দ করার। কোনো রাজনৈতিক দলকে পছন্দ করতেই হবে, এটা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু ব্যক্তিগত আঘাত তো মেনে নেওয়া যায় না। এই যে মোদীর ইজরায়েল সফর নিয়ে যখন শিল্পী কটাক্ষ করলেন, আমার ভালো লাগেনি। শিল্পীসত্তার সঙ্গে ব্যক্তিসত্তা মিশে যাবে কেন? শিল্পী তো শিল্পের ভাষায় কথা বলবেন। সেখানে রাজনীতিও আসার কথা না। এই পার্থক্যটা মানুষ ভুলে যাচ্ছে।
আর জীবনের সব সমস্যার জন্য নরেন্দ্র মোদীকে দায়ী করা কবে বন্ধ করব আমরা? আমরা শিল্পীরা ভুলতে বসেছি, এর মধ্যে কোনো বুদ্ধিমত্তা নেই, মননশীলতা নেই। চূড়ান্ত বৌদ্ধিক দেউলিয়াপনায় ভুগছি আমরা। শিল্পীদের যেটা একেবারেই থাকার কথা না।
এরকম সময় জরুরি অবস্থার কথা মনে পড়ে যায়। শাসক দলের নেক নজরে না থাকলেই শিল্পীদের অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যাওয়াটাই রীতি ছিল যখন। এ অবশ্য পরেও হয়েছে। ২০০৪ সালে অনুপম খের, রবীনা ট্যান্ডন এবং আমাকে বিভিন্ন সাংবিধানিক পদ থেকে সরতে হয়েছিল একটাই কারণে। আমরা আগের শাসক জমানার সুনজরে থাকার অপরাধে।
২০১৪ সালে টিএম কৃষ্ণ নিজেই বলেছিলেন, "একজন সংগীতকারের মানুষ হিসেবে রাজনৈতিক অবস্থান থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু নিজের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান শক্তিশালী করে তোলার জন্য সংগীতকে ব্যবহার করলে তাতে নান্দনিকতা থাকে না"। শিল্পী নিজেই কি ভুলে গেছেন সে কথা?
Read the full story in English