মাস দেড়েক আগে শেষ হওয়া লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে প্রদত্ত ভোটের একটা বিপুল অংশ গেছে তৃণমূল এবং বিজেপির ঝুলিতে। নির্বাচন কমিশনের হিসেবে তৃণমূল ৪৩.২৮ শতাংশ, বিজেপি ৪০.২৫ শতাংশ, বামফ্রন্ট ৭.৪৬ শতাংশ এবং কংগ্রেস ৫.৬১ শতাংশ। অর্থাৎ বুঝতে কোন অসুবিধেই নেই যে বুথে পৌঁছনো ভোটারদের মধ্যে সাড়ে তিরাশি শতাংশ মানুষ হয় তৃণমূল নয়তো বিজেপিকে সমর্থন করেছেন।
সারা দেশের কথা ভাবলে অবশ্যই বিজেপি সংগঠনভিত্তিক একটি দল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কথাটা ততটা সত্যি নয়। অবশ্যই বহুদিন ধরে এই বাংলার মাটি কামড়ে আরএসএস কিংবা বিজেপিকে সমর্থন করছেন অথবা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এ রকম মানুষ অল্পসংখ্যক আছেন। কিন্তু তাঁরা এই নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে দারুণ ফলাফলের পথ দেখিয়েছেন, এমনটা নয়। এবারের বিজেপির ভালো ফলের কারণ, রাজ্যে তৃণমূল সরকারের কাছ থেকে জনসমর্থন সরে যাওয়া এবং বিজেপির অন্য দল ভাঙানোর সাফল্য। এই ধরনের নীতির চচ্চড়ি বানানো রাজনৈতিক কৌশলকে তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাংগঠনিক শক্তির সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে।
আরও পড়ুন: সংসদে বাংলার বাজার চড়া
২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে যখন তৃণমূলের অগ্রগতি শুরু হয়, তখন বামফ্রন্টের (আরও নির্দিষ্ট করে বললে সিপিএম) সংগঠন ছিল তৃণমূলের চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু জনগণের চাহিদায় ২০১১ পর্যন্ত সময় নিয়ে বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূলে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পন্ন হয়েছিল। সংগঠন সেখানে মুখ্য বিষয় ছিল না। আজকের বিজেপির ক্ষেত্রেও বিষয়টা সংগঠনের নয়। বামফ্রন্ট বা কংগ্রেসকে দিয়ে তৃণমূলকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয় বুঝে একটি সর্বভারতীয় দলের ছাতার তলায় আসতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষ।
এই নির্বাচন তাই বড় অংশের মানুষের তৃণমূল বিরোধিতার জোট। তৃণমূলের নেতা ভাঙানোর রসায়ন বিজেপির অগ্রগতির বিক্রিয়ায় অবশ্যই অনুঘটকের কাজ করেছে। এখানে ভোটের আদানপ্রদানে ভোট করানো নেতানেত্রীদের অবদান মানতেই হবে। স্বাভাবিক নিয়মেই যাঁরা ভোট করান, তাঁদের কৌশলের সঙ্গে পেশীশক্তিরও প্রয়োজন হয়। ব্যারাকপুরের বিভিন্ন নির্বাচনী ফলাফল তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তাই 'ব্যারাকপুর মডেল' শিরোনামে একটি পরিচ্ছেদ লিখতেই হবে।
ইতিহাস অনেক বারই বুঝিয়ে দিয়েছে, ক্ষমতার বদল মানেই খারাপ - পুরনো গিয়ে ভালো নতুন এলো - এমনটা নয়। অর্থাৎ একথা প্রমাণ করা শক্ত যে যখন তৃণমূল ক্ষমতায় এলো তখন তৃণমূল যারা চালাচ্ছিলেন তাঁদের গড় ভালোত্ব ছিল বামফ্রন্টের থেকে উচ্চমার্গের। আসলে রাজনীতির ক্ষেত্রে ভালো মন্দের বিচার খুব কঠিন। বাম আমলে যাঁরা সাধারণ মানুষের কষ্ট কিংবা বিরক্তির কারণ হয়েছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ স্বাভাবিক নিয়মেই তৃণমূলে ঢুকে শাসকের পদ পেয়েছেন। এদের মধ্যে সবাই যে শুধু বাহুবলী এমনটা নয়। বরং বামফ্রন্টের বিদ্বজ্জনেরাও রঙ পালটেছেন, এবং তৃণমূলের কাছ থেকে 'বঙ্গ-বেচারা' গোছের একটা উপাধি এবং যথেষ্ট সুযোগ সুবিধে বাগিয়ে নিয়েছেন।
আরও পড়ুন: কোথা থেকে এলো নুসরত জাহানের বিরুদ্ধে ‘ফতোয়ার’ গল্প?
সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামে বামফ্রন্টের কর্মপদ্ধতি ইতিহাস বিচার করবে। আপাত বিশ্লেষণে তা এই রাজ্যে বাম শাসকদের ক্ষমতা হারানোর মুখ্য কারণ। একদিন না একদিন যেতেই হতো, তবে ঘটনার পরম্পরায় কৃতিত্ব পেয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গের দুটো অনামী জায়গা। কিন্তু সেই সময় যাঁরা তীব্র সমর্থন করছিলেন বামফ্রন্টকে, তাঁদের একটা বড় অংশ তৃণমূল রাজত্বে দল বদলালেন। শুধু অপরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তৃণমূল-বিজেপি ছাড়া আজকের দিনে তৃতীয় মতের শরিকরাও অনেকে বঙ্গ-বিভীষণ সাঁটানো একটি মানপত্র পেলে আঁজলা ভরে সেই সম্মান গ্রহণ করবেন।
বড়-গলা সম্পন্ন অন্যপক্ষের ডিগবাজি এ রাজ্যে চপ-মুড়ি খেয়ে চোঁয়া ঢেকুর তোলার মতই স্বাভাবিক। এঁদের একটা বড় অংশ এইসময়ে বঙ্গ-বিজেপির দিকে ঘেঁষছেন। আর সঙ্গে তো আছেনই হতাশ আদি তৃণমূলের অসংখ্য নেতাকর্মী। এর মধ্যে তুলনায় কম সংখ্যক হলেও এমন নেতা আছেন যাঁদের বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূল ঘুরে বিজেপি যাত্রা সম্পূর্ণ। সাধারণ ভোটারদের কাছে বদলের বদল, বিকল্পের বিকল্প, এই সমস্ত সুমধুর শব্দরাশি ডিগবাজি-পটু রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদে নির্বিকল্প সমাধিতে বিলীন।
দুর্ভাগ্যের যেমন কালজয়ী তেরো আছে, তেমনই আছে এবারের তেরো শতাংশ। এ রাজ্যে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের মোট জনসমর্থন এখন এটাই। তারাই এ রাজ্যের তৃতীয় পক্ষ। এদের মধ্যে কে তিন আর কে চার না ভেবে অতি সরলীকরণের এক বন্ধনীতে ফেলাটাই শ্রেয়। জোটভাঙার এই আঁতাতে বাম সমর্থনে দুটি মূল্যবান লোকসভা আসন জুটিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস। এর পরেও হয়ত কিছু নেতানেত্রী বিভিন্ন বাধ্যবাধকতায় বিদ্ধ হয়ে তৃণমূল বা বিজেপির দিকে ঝুঁকতে পারেন। সোজা হিসেবে কংগ্রেসের এই রাজ্য থেকে জেতা দুই সাংসদ যদি সরে যান, তাহলে কংগ্রেসের ভোট আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
একই গলিপথে জামানত জব্দ হওয়া নেতাদের কেউ ডিগবাজি খেলে বাম দলের প্রাপ্ত ভোটের অংশ কমতে পারে আরও কিছুটা। তবে এবার এই রাজ্যে নোটায় যেমন প্রায় এক শতাংশ (০.৯৬) ভোট পড়েছে, অন্তত তার থেকে সামান্য বেশি ভোট কংগ্রেস কিংবা বামেদের হাতে থাকবে বলে আশা করা যেতেই পারে। সঙ্গে কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেতা হওয়ার সুবাদে অধীরবাবু হয়ত এই বাংলায় দলকে আরও কিছুদিন সসম্মানে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।
এখনও এমন মানুষ আছেন যাঁরা প্রকাশ্যে এই সহস্রাব্দের বাম নেতৃত্ব সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ, কিন্তু শেষপর্যন্ত ফেব্রুয়ারির ব্রিগেডে হাঁটেন এবং ভোটটা দিতে বাধ্য হন বামফ্রন্টকে। আছেন এমন সমর্থক যাঁরা কংগ্রেসকে সর্বভারতীয় প্রগতিশীল সমাজবাদ ঘেঁষা দল হিসেবে এখনও বিশ্বাস করেন। এঁদের এই একগুঁয়েমি চটজলদি দলবদলের বাধ্যবাধকতার থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এঁরাই হয়ত বলে ওঠেন যে ধোনির দস্তানায় আত্মবলিদানের চিহ্নর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষ উইকেটরক্ষক হিসেবে তিনি উড়ে গিয়ে একটা শক্ত ক্যাচ আঁকড়ে ধরতে পারলেন কিনা। এঁরা বেশিরভাগই মনেপ্রাণে বাঙালি এবং অন্য ধর্ম অন্য রাজ্যের বন্ধুদের দয়া করে খাওয়াচ্ছি, পরাচ্ছি এবং পড়াচ্ছি বলে মনে করেন না। 'জয় শ্রীরাম' কিংবা 'জয় হিন্দ', কোন স্লোগানেই এঁদের অঙ্গে ফোসকা পড়ে না। অর্থাৎ ধোনির দস্তানা কিংবা ধ্বনি, যে কোন বলিদানেই এঁদের ধড়ের ওপর মাথা যথাস্থানেই থাকে। সোজা বাংলায়, বিজেপির হিন্দুত্ব চটকানো তীব্র জাতীয়তাবাদ আর তৃণমূলের আবোলতাবোল সর্বধর্ম সমন্বয়ের তোষণভিত্তিক রাজনীতি - দুই থেকেই দূরে থাকেন এই গোষ্ঠী।
আরও পড়ুন: এক দেশ এক নেতা এক আদর্শ এক ধর্ম এক স্লোগান: এই কি ভবিতব্য?
পড়শি দেশের পরাজয় এবং হয়রানি প্রত্যক্ষ করা এঁদের জীবনের একমাত্র আনন্দ নয়। এঁরা খুব সন্তর্পণে বুঝতে চেষ্টা করেন, এবার বিজেপি যে বিপুল ভোট পেয়েছে, তার একটা অংশ তৃণমূলের বিরুদ্ধে 'দেখ কেমন লাগে' গোছের কিনা। তার কিছুটা আবার বামফ্রন্ট বা কংগ্রেসের দিকে ফিরে আসবে কিনা, সেই নিয়ে এঁদের ভাবনা যুক্তিবোধের সীমা ছাড়ায় না। সূর্যকান্ত মিশ্র আর সোমেন মিত্রর একসঙ্গে ভাটপাড়ায় পথ হাঁটা এদের কাছে জোট রাজনীতির শেষ কথা নয়। পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরার বামফ্রন্ট এবং দেশজুড়ে কংগ্রেসের বিভিন্ন গোলমেলে কাজ বহু বছর ধরে অনুধাবন করেও এঁরা প্রবল-প্রতাপ তৃণমূল বা বিজেপিকে সমর্থন করতে পারছেন না। কারণ ভাটপাড়া আর কাটমানি এঁদের রাজনীতির অঙ্গ নয়। তৃণমূল ভাঙিয়ে বিজেপির নির্বাচনী কৌশল কিংবা প্রশান্ত কিশোরের রাজনীতি প্রক্রিয়াকরণে তৃণমূলে ভোট ফিরে আসার অঙ্ক, কোনটাতেই এঁদের বিশ্বাস নেই। বাধ্য হয়ে তাই সমর্থক রয়ে গেছেন সেই পুরনো দলেরই।
তবে দিনের শেষে এঁদের সংখ্যা নগণ্য। বাকি বাঙালিদের তৃণমূল বা বিজেপি হতেই হবে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটার মানেই তাঁদের বাঙালি হতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয় নি। তবে এই আলোচনা যেহেতু বাঙালিদের নিয়ে, তাই এই গোষ্ঠীকে সংজ্ঞায়িত করার প্রশ্নটা কতিপয় অনুচ্ছেদ পূর্বের চোঁয়া ঢেকুরের সঙ্গে উদ্গীরণের সম্ভাবনা থাকছেই। সেখানে মুশকিল হলো, কাদের বাঙালি বলে ধরা হবে, সেই হিসেবটাই তো গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বারবার। আর সেই জন্যেই বাঙালি এখন অবাঙালি, সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, মতুয়া, ইমাম, টুপি পরা, টিকি রাখা, ছাগলদাড়ি, রামনবমী কিংবা রথযাত্রার মিছিলে হাঁটা, মাংস থেকে কাঁটা বেছে খাওয়া, শাঁকালু চিবোনো, তৃণমূল, বিজেপি ইত্যাদি বিভিন্ন বর্গে ভাগ হচ্ছে।
তার মধ্যে একটু চেপেচুপে সিপিএম আর কংগ্রেসটাকে ঢুকিয়ে দিলে ক্ষতি কী? বাম ভোট শতাংশের যোগফলে ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি কিংবা সিপিআই থাকলেও আপাতত তাদের জন্যে জায়গা রাখা যাচ্ছে না। এ রাজ্যে নোটার থেকে বেশি ভোট পেলে তখন পঞ্চম, ষষ্ঠ বা সপ্তম পক্ষের কথা ভাবা যাবে। আপাতত সূচনা থেকে উপসংহারে বেশিরভাগ বাঙালি জোট বেঁধে তৃণমূল কিংবা বিজেপি। তবে লুপ্তপ্রায় প্রজাতির রক্ষার দায়িত্ব সংসদীয় গণতন্ত্রে থাকা উচিৎ। বিজেপি বা তৃণমূল সেই প্রগতিশীলতার ভুল ফাঁদে পা দেবে কি? কোনদিন আবার যদি সেই তৃতীয় স্থানাধিকারী অন্যপক্ষের তেরো শতাংশ গেরো কাটিয়ে বাড়তে থাকে?
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)