Advertisment

দল বদল, বিশ্বাসের মৃত্যু ও মুলতুবি থাকা স্বপ্নেরা

আমাদের এটাও মনে থাকবে এই তীব্র বিশ্বাসহীনতার সূচনা কিন্তু একদা ঘটিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলই, নির্বিচারে অন্য দল থেকে নেতা কিনে এনে। এই প্রবণতা, ভারতীয় রাজনীতিতে ‘আধুনিকতা’-র অবসান ঘোষণা করে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
TMC to BJP

এই দলবদল অনেকটা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের জার্সিবদলের মতো

মাত্র ৭০-৮০ বছর আগেও এমন একটা পৃথিবীতে ছিলাম আমরা, যেখানে মেক্সিকোর অপরিসর সরাইখানায় বসে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ফেঁদে বসত কয়েকজন স্বপ্নদ্রষ্টা যুবক। তাদের মধ্যে হাতে-গোনা কয়েকজন ১৯৫৩ সালে কিউবার মনকাডা দুর্গ আক্রমণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। তাদের সেই ২৬ জুলাই মুভমেন্টের চরম লক্ষ্য পূরণ করতেই এবার প্ল্যান করা হল নতুন ভাবে। মেক্সিকো উপকূল থেকে ‘গ্রানমা’ রণতরীতে চেপে ৯০ জন অমিত শক্তিশালী প্রতিভাবান মানুষ শুরু করল বিপ্লবের দৌড়। বাতিস্তার বোমারু বিমান আকাশপথে ঘিরে ফেলল তাদের। অতর্কিত আক্রমণে অধিকাংশ যুবকের মৃত্যু হল। বাকিরা সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ে ঘাঁটি এলাকা গড়ে তুলল আর শুরু হল কিউবার বিপ্লবী লড়াই। বাতিস্তার স্বৈরাচারী শাসন উচ্ছেদের লক্ষ্যে। সময় লেগেছিল মাত্রই দু’বছর। বাতিস্তার সৈন্যবাহিনী নাস্তানাবুদ হল তাদের প্রত্যয়ের সামনে। অবশেষে পাহাড়-জঙ্গল-গ্রামাঞ্চল দখল সম্পূর্ণ করে বিপ্লবী গেরিলাবাহিনী ঢুকে পড়ল রাজধানী হাভানায়। পথের দুধারে হাজারো জনতা অভিনন্দন জানাল তাদের , দেশ ছেড়ে সপরিবারে পালাল শাসক বাতিস্তা। আশ্রয় নিল মিয়ামিতে। ১৯৫৯। সফল হল কিউবার বিপ্লব।

Advertisment

আজ, এই ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে, পৃথিবীর এমনকি একটা দুর্বল দেশেও কেউ ভাবতে পারবে এরকম একটা দুঃসাহসী বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটানোর কথা? না। পারবে না। তার এক ও অন্যতম কারণ হল যে অপরিসীম বিশ্বাস আর স্বপ্নে ভর করে ওই ছেলেরা ভাসিয়েছিল গ্রানমা রণতরী, আজকের উত্তর-সত্য বা ‘পোস্ট-ট্রুথ’ রাজনৈতিক পরিসরে তার বাস্তবতাটাই স্রেফ হাপিশ হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন, ডেঙ্গির দিনগুলিতে দেশপ্রেম

গোটা ভারতের প্রায় আঠারো-উনিশটা  রাজ্য দখল করে নিয়েছে বিজেপি। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে এরকম বেশ কিছু রাজ্য আছে যেখানে বিজেপির অস্তিত্ব, সংগঠন বা ধারাবাহিক গণ-আন্দোলনের নামমাত্রও ছিল না কস্মিনকালেও। শুধু টাকা ছড়িয়ে, মানি-মাসল পাওয়ারের খেলায় বিপক্ষীয় দলের বিধায়ক-সাংসদ-নেতা-কর্মীদের কিনে নিয়েও যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা যায়, সেই চরম নীতিহীন রাজনীতিকেই আজকের মূলধারার রাজনৈতিক লাইন বানিয়ে বিজেপি প্রমাণ করেছে, ‘আধুনিক’ ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় তারা এমন এক নীতিহীন, অবিশ্বাসের রাজনীতির আমদানি করেছে, স্বাধীনতার ৭৩ বছরে আর কেউ যে রাজনীতির  এতো কৌশলী প্রয়োগ ঘটাতে পারেনি। রাজনীতি জিনিসটার মধ্যে যে গাম্ভীর্য, যে সদর্থক ‘এসেন্স’ ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে যেতেও সামান্য কিছুটা হলেও বজায় ছিল এতোদিন যাবৎ, বিজেপি এক ফুঁয়ে তার ব্যান্ড বাজিয়ে দিয়েছে। শোভন চট্টোপাধ্যায় আর তাঁর বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগ দিলে সেটা আর এই কারণে কোনও খবর নয় যে তারা আদৌ তৃণমূল দল ও দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন কি না। বরং তাঁরা খবর এই কারণে যে গোটা রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক পরিসর তাকিয়ে বসে রয়েছে তাঁরা বিজেপির কাছ থেকে এরপর আর কী কী সুবিধা আদায় করতে চলেছেন। আগামীদিনে তাঁদের কব্জায় আর কী কী আসতে চলেছে।

এই দলবদল অনেকটা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের জার্সিবদলের মতো। স্রেফ জামা পাল্টালেই একটা লোকের অবস্থান বদলে যেতে পারে—এটা আজ আমাদের কাছে এক অতি স্বাভাবিক ঘটনা। চড়া দাগের দক্ষিণী সিনেমার পর্দায় দেখা দৃশ্যের মতোই এই ঘটনাপ্রবাহ, যেন অবিকল বানিয়ে-তোলা চিত্রনাট্যের খসড়া।

জাঁ বদ্রিলার উত্তর-আধুনিক ফিনান্স পুঁজির যুগে যে ‘হাইপার-রিয়ালিটি’ তৈরি হবার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন, আজকের রাজনীতি তার সার্থক উদাহরণ। আমরা সকলেই জানি যে বাস্তবতা চোখের সামনে দেখছি তা এক ফাঁপা, বানানো, কৃত্রিম, মিথ্যা বাস্তবতা। তবু আমরা সেই বাস্তবের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে মজে আছি। আজ আমরা জানি কোনও সামাজিক উপাদান বা ঘটনার ভিতরেই আর কোনও ‘এসেন্স’ অবশিষ্ট নেই। পুরোটাই নির্বস্তুক আর ‘অর্থ’-বিহীন এক গভীর শূন্যস্থানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে গোটা জনপরিসরকে । চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি মিথ্যা পরিসংখ্যান, মিথ্যা সামরিক হানা, মিথ্যা শত্রু-চিহ্নিতকরণ। তবু সেই মিথ্যার মায়ায় মজে রয়েছি আমরা উন্নততম প্রযুক্তির তীক্ষ্ম প্রকৌশলে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আদ্যন্ত মিথ্যায় মোড়া একজন প্রধানমন্ত্রীকে যার একমাত্র দায়বদ্ধতা দেশের ক্রোনি শিল্পপতিদের সম্পদ বাড়ানো্র প্রতি। যাকে লার্জার দ্যান লাইফ হিসেবে দেখানো হচ্ছে মিথ্যা হাইপার-রিয়াল মায়াবিভ্রমের সহায়তায় । কিন্তু আদতে তিনি দেশের মানুষের প্রাত্যহিক ভালো-মন্দের সঙ্গে আদৌ যুক্ত নন। সামাজিক-রাজনৈতিক  বিচারটা শুরুই হচ্ছে এক গভীরতম অবিশ্বাসের জায়গা থেকে। বিশ্বাসযোগ্যতা জিনিসটাই যেন এক  পুরোনো, ফেলে-আসা সময়ের অবলুপ্ত প্রতিনিধি আমরা যার কঙ্কাল বয়ে নিয়ে চলেছি।

আরও পড়ুন, দল গৌণ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি এখন মুখ্য

তাই মুকুল রায় যখন হুংকার দিচ্ছেন তৃনমুলের ১০৭ জন বিধায়ক তাঁর দলে যোগ দিচ্ছেন, যখন দেখতে পাচ্ছি ১৯৯৮ সালে অনেক লড়াই আর অসম্মানের বোঝা মাথায় নিয়ে তৈরি-হওয়া দলটির একের পর এক জনপ্রতিনিধি অনায়াসেই যোগ দিচ্ছেন শক্তিমান প্রতিপক্ষের সঙ্গে, তখন আমাদের এটাও মনে থাকবে এই তীব্র বিশ্বাসহীনতার সূচনা কিন্তু  একদা ঘটিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলই, নির্বিচারে অন্য দল থেকে নেতা  কিনে এনে। এই প্রবণতা, ভারতীয় রাজনীতিতে ‘আধুনিকতা’-র অবসান ঘোষণা করে। বুঝিয়ে দেয় আজকের মূলধারার রাজনীতি আসলে শুরুই হচ্ছে এক তীব্র অবিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু থেকে যেখানে কারও অবস্থানই কোনও আদর্শ, ন্যায়-নীতি বা লড়াইয়ের অভিমুখী নয়। যেখানে ১৩০ কোটি বুঢ়বক জনতার সামনে চরম নীতিহীন, বিশ্বাসঘাতক কয়েকজন রিংমাস্টারের আঙুলের সুতোয় নেচে চলা ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই। তাই, আপাতত সমস্ত বিপ্লব, সমাজবদল, র‍্যাডিকাল পরিবর্তনের স্বপ্ন মুলতুবি থাকবে। এখন রাজনীতির নির্বস্তুক, ফাঁপা ‘চিহ্ন’-গুলোর সঙ্গে নিজেদের পরিচিত করিয়ে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই।

(অর্ণব সাহা শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment