Advertisment

চিন বন্ধু না শত্রু? সাধু সাবধান

প্রথমে দুপক্ষ চিহ্নিত করবে কোথায় কোথায় দুপক্ষের ঐক্য। তারপর দেখতে হবে কোথায় কোথায় তাহলে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হবে!

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
প্রয়াত প্রণব॥ ফের চিনা আগ্রাসন॥ জিডিপিতে বড় ধস॥ প্রশান্তের ১ টাকা জরিমানা

চিন এবং ভারত আবার একটি দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক চুক্তি করল। এবার প‍্যাংগং সো (Pangong Tso) এবং গোগোরা স্টলিং ১৭এ থেকে চিনারা সেনা প্রত‍্যাহার করতে এখনও রাজি নয়। ২৪ জুলাই (২০২০) তাই চুক্তিতে বলা হল, দুপক্ষই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পূর্ণ সেনা প্রত‍্যাহার করবে। চুক্তিতে সেনা প্রত‍্যাহার শব্দটির বদলে বলা হয়েছে early and complete disengagement.মাও জে দং-এর একটা সুত্র ছিল বিরোধ মেটানোর জন্য। বলা হত, ঐক‍্য-অনৈক‍্য-ঐক্য তত্ত্ব। প্রথমে দুপক্ষ চিহ্নিত করবে কোথায় কোথায় দুপক্ষের ঐক্য। তারপর অনৈক্যের বিষয়গুলি দেখতে হবে। শেষ পর্যন্ত কোথায় কোথায় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যায় তা ঠিক করতে হবে।

Advertisment

এবার পাংগং লেক সংলগ্ন এলাকা থেকে চিন তার সেনা বাহিনীর অধিকার খর্ব করতে চায় না। সমস্যা হল, ভারত ও পাকিস্তান সীমান্ত যাকে বলে লাইন অফ কনট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখা সেটি নিয়ে বির্তক থাকলেও একটা সুনিদিষ্ট সীমা আছে। কিন্তু চিন ভারতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কনট্রোল) সেভাবে সুনির্দিষ্ট নয়। তাই চিন ও ভারত দুপক্ষই ওই উচ্চতায় বরফের মধ‍্যে সীমা সম্পর্কে নিজেদের ধারণা অনুসারেই চলে।

ভারত ও চিন সীমান্ত কার্যকলাপের বিষয়ে পরামর্শ ও সমন্বয়ের জন্য একটি ওয়ার্কিং মেকানিজম আছে। দু’দেশের বিদেশ মন্ত্রককে নিয়ে এই মেকানিজম। দুপক্ষই ভার্চুয়াল বৈঠক করেছে এ তো আনন্দের কথা‌। যদি আলোচনাটাই
বন্ধ হয়ে যেত তবে সে হতো এক বড় আতঙ্কের বিষয়। তবে ৬ জুন থেকে এই আলোচনা এই পর্বে নতুন করে শুরু হয়েছে। চারবার বৈঠক হয়েছে। চারটি সংঘর্ষ এলাকার দু’টি পয়েন্ট লাদাখে, এই ফ্রন্টিয়ার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
পিপি- ১৪ (গালওয়ান উপত্যকা) এবং পিপি-১৫ (হট স্প্রিং)।

‘প‍্যাংগং-সো’তে চিনা সেনা ফিংগার-৪ (যেটি লেকের উত্তর ব‍্যাঙ্কে আছে, ফিংগার-৮ থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে)-এক মধ্যে ঢুকে পড়ে। এরপর ৪ নম্বর ছেড়ে ৫ নম্বর ফিংগারে ঢোকে চিনা সেনা। কিন্তু ৪ নম্বর ফিংগারের রিজ লাইনটাও চিনা সেনারা দখল করে রাখে। এই ঘটনার পর ভারতীয় সেনারাও তৎপর হয়ে ওঠে। ভারতীয় সেনারা না চাইলেও আত্মরক্ষার জন্য তৎপর হতে হয়। এখন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুসারে ভারতীয় সেনারাও পিছিয়ে আসবে।

২০২০ সালের ৫ জুলাই দুপক্ষের মধ‍্যে টেলিফোনে কথাবার্তা হয়। সেই কথাবার্তাই প্রথম বরফ গলায় এবারের বরফ গলার পর। এখন প্রশ্ন একটাই, চিন কি তবে আমাদের বন্ধু না শত্রু? এর আগে কতবার দু’দেশের মধ‍্যে শান্তি চুক্তি হয়েছে‌?

১৯৬২ সালে যখন জওহরলাল নেহেরু দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনও চিন আক্রমণ করার পর আবার শান্তি চুক্তি করেছিল। কিন্তু তারপর আবার তাহলে ৬৭' সালেই চিন লাদাখে হানা দিল কেন? পন্ডিত নেহেরুর উদ‍্যোগে যে চিনকে ভারত গ্ৰহণ করেছিল বন্ধু হিসেবে, হিন্দি-চিনি ভাই-ভাই স্লোগান উঠেছিল চো-এন-লাইয়ের ভারত পদার্পণ কালে, তারপরও কী ঘটেছিল সে কথা ভুলে গেলেও চলবেনা।

চিন-ভারত যে সংঘর্ষ হয় আগের শতাব্দীর ছয়ের দশকে সেটার অন্তর্নিহিত কারণটা কী? তা এই সাম্প্রতিক লাদাখ কাণ্ডের পর আবার পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। চিন কী তবে এক দোদুল্যমান প্রতিবেশী? সবরমতী নদীর তীরে যেদিন নরেন্দ্র মোদী চিনা প্রেসিডেন্ট সিকে দোলনায় বসিয়ে নতুন এক মৈত্রীর অধ‍্যায় শুরু করতে চাইলেন সে তো ছিল আপাতভাবে এক নতুন রোমান্টিসিজম। কিন্তু তবু চিন আপন তো হল না। দূরমনস্ক দেশ শুধু নয় প্রকৃত শত্রুর মতই আচরণ দেখালো।

প্রশ্ন একটাই। অরুণ শৌরি থেকে রামমাধব- দক্ষিনপন্থী আরএসএস চিন্তাবিদরা মনে করেন, ভারত আসলে বারবার হাত বাড়ালেও চিন কখনোই বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়নি। তাই শক্তিধর চিন রাষ্ট্রকে কখনই বিশ্বাস করা উচিত নয়। চিনা প্রেসিডেন্টকে ডেকে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের অঙ্গীকার করাটা কূটনীতির একটি অঙ্গ হতে পারে। কারণ চিনা রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা কিন্তু নিজেদের কোনও প্রবঞ্চনা নয়। অরুণ শৌরি আজও মনে করেন, চিনের সঙ্গে বন্ধুত্বের চেষ্টা হল একধরনের আত্ম-প্রবঞ্চনা। আগ্ৰাসনের মাধ‍্যমে আগ্ৰাসী চিনও কিন্তু ভারতের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সর্বদাই সচেষ্ট।

অতীতকে তাই জানা প্রয়োজন চিনকে জানার জন্য। যে নিষ্ঠুর পথে লাসায় তিব্বতীদের সমস্ত প্রতিবাদ চিন সরকার দমন করেছিল তা কিন্তু গোটা দুনিয়া দেখেছে। এক ভয়ঙ্কর জটিল পথে একটি সমগ্ৰ জাতিকে তার স্বভূমিতেই চিন সরকার সংখ্যালঘুতে পরিণত করে। নির্ম‍ম ও নিষ্ঠুরভাবে তাদের দলিত করে দেওয়া হয়। তাদের ধর্ম, তাদের প্রাচীন সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হল যেভাবে তা পৃথিবী দেখেছে।

১৯৫৯ সালের পর থেকে চিন বারবার অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে গেছে। চিন ভারতের এক বিশাল অংশ, যেমন গোটা অরুণাচল রাজ‍্যটির ওপর বারবার দাবি করে আসছে। দু’দেশের সীমান্ত সংক্রান্ত আলোচনার মেকানিজম দুদেশের মধ্যে জীবন্ত আছে কিন্তু এ আলোচনা কার্যত এক দীর্ঘসূত্রতায় পরিণত হয়েছে। লাদাখ থেকে সিকিম ও অরুনাচল পর্যন্ত ভারতীয় ভূখণ্ডে চিনের অবৈধ অনুপ্রবেশ আজ এক মস্ত বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে।

নেহেরুর সময় চিন যখন আগ্ৰাসী মনোভাব নেয় তখন কিন্তু রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ আগাম সর্তকবার্তা দেন নেহেরুকে। রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদের বক্তব্য ছিল, ৫২' সালের জুলাই মাসে চিন বিশাল সেনা প্লাবনে ভাসিয়ে তিব্বত দখল করে নেয়। চিন থেকে এই সেনা দলকে খাদ্য সরবরাহ করা দুঃসাধ্য। বরং ভারত থেকে একাজ করা অনেকটাই সহজসাধ্য, বর্তমানে চিন যা করছে। ১৯৫৯ সালের ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পন্ডিতজিকে চিঠি লিখলেন। তিনি পন্ডিত নেহেরুকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে আগে ২৩ সেপ্টেম্বরও এক দীর্ঘ ও গোপন চিঠি দেন, যার মাধ‍্যমে তিনি চিনের সুদীর্ঘ সীমানা সম্পর্কে অনেক প্রস্তাব দেন। রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ নেহেরুকে চিঠিতে জানান - "আমরা জানি যে আকসাই চিন অঞ্চলে একটি বৃহৎ রাস্তা নির্মিত হয়েছে যা আমাদের দেশীয় ভূখণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। এই রাস্তাটি ব‍্যবহার করাও হচ্ছে। অনুমানসাপেক্ষে এটা ধরে নেওয়া হয় যে সমগ্ৰ অঞ্চল বিশেষত, রাস্তার উত্তর দিকের অংশ পর্যন্ত চিন অধিকার বজায় রেখেছে। হয়তো বা, দক্ষিণের কিছুটা অংশ পর্যন্ত কিছুটা অধিকার করা আছে। আমি অনুমান করতে পারি, যে আমাদের ভূখণ্ডের মধ‍্যে দিয়ে পুনরায় দক্ষিণের দিকে আরও একটি রাস্তা মোটামুটিভাবে সমান্তরাল চলে গেছে। যদি এই রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়ে থাকে, অথবা যদি তৈরি হওয়ার পথে থাকে, নিঃসন্দেহে তা চিন জবরদখল করবে। শুধুমাত্র দুই রাস্তার মাঝখানের অঞ্চলটাই নয়, প্রকৃতপক্ষেলাদাখের যতটা জবরদখল করা যায় ততটা অংশের সম্পূর্ণটাই অধিকৃত হবে। আমি সঠিক জানি না যে ভারতের কতটা অংশে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমরা হয়তো পুনরায় অনুপ্রবেশ রুখতে পারব কিন্তু যখনই অঞ্চলটিতে সামরিক পরিদর্শনের প্রশ্ন ওঠে এবং আমাদের পুলিশ অথবা সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মচারী সেখানে প্রবেশ করেন, চিন তাঁদের অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করে গুলি করে হত্যা করে, নয়তো বন্দি করে। ঠিক যেমন কিছুকাল পূর্বে তাঁরা আমাদের কোনও পদস্থ কর্মচারীর সঙ্গে করেছে। এটা ঠিক যে চিনের সঙ্গে এই সমস্যা সমাধানের জন্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে পারস্পারিক আলোচনার মাধ্যমে সর্বোত্তম প্রয়াস চালাতে হবে। কিন্তু এই ধরনের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা না হলে, অথবা ফলপ্রসূ না হলে তার পরিণাম কী হবে সেই সম্পর্কে কোনও ধারনা আমার নেই। তারা ইতিমধ্যে ভারত ভূখণ্ডের হাজার হাজার বর্গমাইল অঞ্চল অধিকার করেছে।

যদি দ্বিপাক্ষিক আলোচনা না হয় অথবা তা অসফল হয়, তবে চিন ভারতের যে অঞ্চল বলপূর্বক দখল করেছে তা নিরাপদে কব্জা করে রাখতে পারবে। সুতরাং ভবিষ্যতে কোনওদিন আমাদের জমি পুনরুদ্ধার করতে গেলে, সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু এই অভিযান কখনও সফল হবে না‌, যদি না তার জন্য যথোপযুক্ত প্রস্তুতি থাকে। সেই ভূমির ওপর প্রথম থেকেই চিনের সুবিধাজনক অধিকার বজায় আছে। প্রায় দশ বছর পূর্ব ও পশ্চিম বরাবর বড়-বড় নির্মাণ করা ছাড়াও আমাদের ভূখণ্ড সংযোগকারী রাস্তা নির্মাণ করে চিন এই সুবিধা অর্জন করেছে।"

রাষ্ট্রপতি স্বনির্বন্ধ করে জানিয়েছেন যে, অনুপ্রবেশ রোধ করতে ব‍্যবস্থা গ্ৰহণ ছাড়াও প্রতিরক্ষা সুদৃঢ় করতে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা গ্ৰহণ করা উচিত। রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব‍্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে অবশ্যই দৃষ্টিপাত করতে হবে। রাষ্ট্রপতি
লিখলেন, এর সঙ্গে সংযোজন হিসেবে বলা যায় সর্বশেষ রাজ‍্যপালের অধিবেশনে সেনাধ‍্যক্ষ যা বলেছিলেন তা আমাদের গোপন রাখতে হবে। সেনাপ্রধান বলেছিলেন যে, অন‍্যান‍্য সকল প্রয়োজন সাপেক্ষে সেনাবাহিনী যথেষ্ট নয়। যেমন তারা পূর্বে ইন্দো-চিন সীমান্তে মোতায়েন করেছিল। কিন্তু উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অতিরিক্ত সেনাদলকে ছোট-ছোট ভাগে বিভক্ত করে মোতায়েন করা সহজসাধ্য নয়।

চিঠির পরিশেষে ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ লিখেছেন, "দীর্ঘ সীমানার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা এখন বাধ‍্য
হয়েই সচেতন এবং যতটা সম্ভব সুরক্ষিত রাখা যায় তার ব‍্যবস্থা করতে হবে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল-- যে হাজার হাজার বর্গ কি.মি. ভূখণ্ড চিন সীমান্ত লঙ্খন করে বেদখল করেছে তা পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি। আর যদি সকল শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ না হয়, তবে অপূরণীয় ক্ষতি মেনে নেওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে। আমরা তবুও আশা করব এই সমস্যা শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হবে এবং আমরা সুফল লাভের জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করে যাব। তবুও আমরা শুধুমাত্র আশাবাদী হয়ে নিশ্চেষ্ট থাকতে পারি না। যে-কোনও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিতে গেলে দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন। যত শীঘ্র এই প্রস্তুতি শুরু হবে ততই সুফল পাওয়া যাবে।"

রাষ্ট্রপতির বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে যে ক্ষতিহীন, অতীতের দিকে তাকালে তা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়। তিনি যে প্রস্তুতির কথা বলেছেন তা পন্ডিতজি মেনে নিতে অনিচ্ছুক।

রাষ্ট্রপতি দেশের তিন সেনাবাহিনীর সংবিধানিক প্রধান। সেনাসূত্রে তিনি নিশ্চই বহু তথ্য পেয়েছিলেন। কিন্তু নেহেরু তাঁর বক্তব্য মানতে রাজি যেমন ছিলেন না ঠিক সেভাবেই তিনি চিনে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে.এম. পাণিককরের বক্তব্যকে বেশি বিশ্বাস করেছেন। পাণিককর নেহেরুকে যেমন বলেছিলেন, তিব্বত থেকে ভারত আক্রমণ করা চিনের অসাধ‍্য।সেই ইতিহাসের পূনরাবৃত্তি কেন হবে? তাই বলি, সাধু সাবধান।

ভারত-চিন চুক্তি যতই হোক, অদূর ভবিষ্যতে যে চিন আবার আক্রমণ করবে না এমনটা ভেবে আবার যেন আমরা চিনের ষড়যন্ত্রের শিকার না হই।

china
Advertisment