Advertisment

দুর্গাপুজো: বারোয়ারির একাল সেকাল

পাড়ার বয়ঃজ্যেষ্ঠরা ঠাকুর দেখে কোনদিন সন্তুষ্ট হতেন না। কোনো না কোনো খুঁত খুঁজে বের করতেনই। সেইদিন থেকে শুরু হত আমাদের পরের বছর পুজো না করার সংকল্প। সেটা চরমে পৌঁছতো দশমীর পর দিন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ - অরিত্র দে

কলকাতার বারোয়ারি দুর্গাপুজোর কথা বলি আজ। কেমন ছিল বারোয়ারি??  আসুন দেখি চেষ্টা করে। ধরুন, এই আমি। একেবারে সাধারণ একজন মানুষ। এই পাড়া,  মানে এখন যেটাকে মিল্ক কলোনি বলা হয়, আগে নাম ছিল বেলগাছিয়া বীরেন্দ্রনগর, আমি এখানে আসি উনিশশো সাতষট্টি সালে।  সেটা ছিল পুজোর পরে। ফলে আটষট্টি থেকে আমি দেখেছি / আছি এই পুজোর সাথে। আজও।

Advertisment

তখন জানেন, এই পাড়াটা সম্পুর্ণ কাঁচা রাস্তার ছিল। কর্পোরেশন থেকে বাল্ব লাগিয়ে দেওয়া হত রাস্তায়। টিমটিম করে জ্বলতো সেই বাল্ব। খোলা নর্দমা, কোটি কোটি মশা।  তারই মধ্যে সকাল সন্ধে আড্ডা মারতাম আমরা। ক্যালেন্ডার দেখতে হত না। আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘ৷ নীল আকাশ। শিউলিফুলের গন্ধ বুঝিয়ে দিত দুর্গা পুজো “ অসি গিলা”।  আমাদের ডাক পড়তো পাড়ার সবচেয়ে অবস্থাপন্ন মানুষটির বাড়ি। জিজ্ঞেস করা হত - কী? এবার দুর্গাপুজো করবি তো? প্রতিবার পুজোর পরে প্রতিজ্ঞা করতাম পরের বছর পুজো করবো না। পরের বছর আবার করতাম৷

সবচেয়ে কঠিন কাজটি ছিল চাঁদা তোলা।  ওফ, মনে করুন আপনি তিনতলায় উঠলেন চাঁদা চাইতে, বাড়ির মালিক প্রথমেই বলতেন - আপনারা কে? রোজ দেখছেন তাও।  তারপর চিনতে পেরে বলতেন - সাতদিন পরে এসো। আজ তোমাদের বৌদি বাড়ি নেই। ওর কাছেই তো টাকা পয়সা থাকে। সাতদিন পর বৌদি বলতেন - আপনাদের দাদা বাড়ি নেই আজ। ওর কাছেই তো টাকাকড়ি থাকে৷ বুঝুন!!! আর এদের যদি একটি কিশোরী মেয়ে থাকতো তাহলে তো সোনায় সোহাগা।  সেই মেয়েকে ঘরে বন্ধ করে তবে দরজা খুলতেন তারা।

তবে চাঁদার ব্যাপারে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ছিলেন পালকাকা। রোজই বলতেন - পুজা!!!  সে তো দেরি আসে..। শেষবার যেতাম ষষ্টীর দিন। পালকাকা যথারীতি বলতেন -পুজা? সে তো দেরি আসে!!  আমরা বলতাম - কাকা! আজ ষষ্ঠী! উনি বলতেন - ও বাবা! ষষ্ঠী আইয়া পড়লো গিয়া। তাইলে তো চান্দা দিতেই হয়৷ নেমে পাঁচটা টাকা দিতেন।  হ্যাঁ, ঠিক পড়ছেন। পাঁচ টাকা দশটাকাই দিতেন তখনকার মধ্যবিত্তরা ।

ঠাকুর নিতাম আমরা শম্ভুদার কাছ থেকে। কুমোরটুলির শম্ভু পাল। আমরা বলতাম - সস্তায় পুষ্টিকর ঠাকুর৷ শম্ভুদার দশাশই চেহারা ছিল৷ কিন্তু গলার স্বর মেয়েলি।  নীচ থেকে দুর্গাপ্রতিমা নিতে হত আর বাকি চার দুর্গাসন্তান ছিল ওঁর ভাষায় পুতুল। সেগুলো নিতে হত সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলা থেকে। রাত্রে যেতাম৷ ভোরবেলা ফিরতাম। কুমোরটুলির পাঁঠার( পড়ুন পাঁঠার নাড়িভুঁড়ির) ঘুগনি আর ফাটা ডিমের ওমলেট ( আমরা বলতাম মামলেট)!!  অহো… কি তার স্বাদ ছিল!!

সকালে পাড়ায় পৌঁছতেই বাড়ি বাড়ি থেকে মা কাকিমারা বেরিয়ে পড়তেন।  শাঁখ বাজাতেন। দুগ্গা এলেন পাড়ায়৷ ভোর বেলার সেই আধো অন্ধকারে আমাদের পাড়াটাকে মনে হত স্বর্গ।

আমাদের তখন বিয়েবাড়ির প্যান্ডেলের মত মন্ডপ হত। আর পাড়ায় না সব কাজের জন্যে আলাদা আলাদা লোক পাওয়া যেত।  কলাবৌ স্নান করাতে নিয়ে যাবে একজনই। পুজোর সব কাজ করবে আর একজন। সে আবার সারা বছর আমাদের দেখলে সিগারেট লুকোয় কিন্তু পুজোর কদিন একেবারে বিন্দাস!  কে আমরা?

পাড়ার বয়ঃজ্যোষ্ঠরা ঠাকুর দেখে কোনদিন সন্তুষ্ট হতেন না। কোনো না কোনো খুঁত খুঁজে বের করতেনই। সেইদিন থেকে শুরু হত আমাদের পরের বছর পুজো না করার সংকল্প। সেটা চরমে পৌঁছতো দশমীর পর দিন। পরের বছর আবার সব ভুলে পুজোয় নেমে পড়তাম আমরা৷

পুজোর চারদিন ভোগ রান্না এবং ফল কাটতেন যথাক্রমে পাড়ার মা কাকিমা জ্যেঠিমারা এবং পাড়ার কমবয়সি মেয়েরা।  এখানে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ছিল। পাড়ার কিছু ছেলে চাইতো যে মেয়েরা আলাদা জায়গায় ফল কাটুক৷ কিন্তু মা কাকিমারা কিছুতেই রাজি হতেন না৷

পুজোর মধ্যে অষ্টমী ছিল স্পেশাল দিন । সেই দিন সকালে অঞ্জলি দিতে আসতেন/আসতো পাড়ার প্রায় সবাই৷ সেই দিন অঞ্জলির ফুল দেবার দায়িত্ব পেত কিছু বিশেষ ছেলে।। সেজে গুজে সকাল থেকেই এসে যেত তারা। তাদের পছন্দের মেয়েরা অঞ্জলি দিতে আসতোই । ব্যাস, তখন অপলকে চেয়ে থাকা। ফুল না পেয়ে অনেকে চিৎকার করতেন- ওরে এবার একটু এদিকে তাকা!  আমরাও অঞ্জলি দেব তো! নাকী?

আমাদের প্যান্ডেলে খুব ভীড় কোন দিনই হত না। তবে সবাই সবাইকে চিনতেন ।  মনে হত বাড়ির পুজো৷ দশমীর ভাসানও হত সাদামাটা। আমার মনে আছে উনিশ শো সত্তর সালে আমাদের পুজোর বাজেট ছিল কুড়ি হাজার টাকা। এর সিংহভাগ আসতো চাঁদা তুলেই

এখন আমাদের পাড়ার পুজোর বাজেট প্রায় পনেরো লাখ টাকা৷ পুজোর কদিন পুরো প্রফেশনালদের মত পুজো করে পাড়ার ছেলেরাই৷ চাঁদা তো ওঠেই বিজ্ঞাপন থেকেও অনেক টাকা ওঠে। তিন দিন খাওয়া হয়। স্কুলবাড়িতে পাড়ার সবাই একসাথে খান বসে৷ পাড়ার ছেলেমেয়েরা অনুষ্ঠান করে প্রত্যেকদিন। আলোয় ঝলমল করে আমাদের পাড়া এই কদিন। থিম পুজোও হয়। বিশাল প্যান্ডেল। বাইরের শিল্পীরা আসেন অনুষ্ঠান করতে। ভীড়ও হয়। দশমীর বিসর্জন হয় মহা আড়ম্বরে। কোন তুলনাই হয় না সেই পুজোর সংগে আজকের পুজোর।

আমরা, যারা বেঁচে আছি এখনও তারা রোজ গিয়ে বসি প্যান্ডেলে।স্মৃতি রোমন্থন করি। মনে পড়ে সেই খাঁ খাঁ করা প্যান্ডেল৷ শম্ভদার ঠাকুর। ম্যাড়ম্যাড়ে আলোয় বসে থাকা আমাদের। বেশ কয়েকজন আর নেই। কেউ চলে গেছে পাড়া ছেড়ে। কেউ পৃথিবী ছেড়ে।  আমাদের সেই ভাল লাগা মেয়েরা বাপের বাড়ি আসে এই সময়৷ বড় হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের সাথে আলাপ করিয়ে দেয় মামা বলে৷ যাকে এক ঝলক দেখার জন্যে হা পিত্যেস করে বসে থাকতাম আমরা তাদের সংগে দেখা হয়৷

মনে পড়ে পালকাকাকে। ষষ্ঠীর দিন দোতলার ছাদ থেকে বলছেন- পূজা?? সেতো দেরী আসে? দশ টাকা চাঁদা দিতে কতবার ভাবতেন তারা। তখন রাগ হত। এখন নিজে সংসার চালাই, বুঝতে পারি কত অসুবিধে হত তাদের।  এক হাজার টাকা চাঁদা এখন। মোটামুটি ফিক্সড। প্রায় সবাই দেন। বেশীও দেন অনেকে৷ হইহই করে পুজো হয় আমাদের পাড়ায়।

শুধু প্রতি পুজোয় পুরনো দু একজন মানুষকে দেখি না প্যান্ডেলে। তারা আর আসবেন না কখনো প্যান্ডেলে। পুজো আরো জাঁকজমক পূর্ণ হবে। বাড়বে রোশনাই।আমরা বসবো প্যান্ডেলে সকাল সন্ধে।

ওই যতদিন আছি আমরা….।

Durga Puja 2019
Advertisment