Advertisment

গাছ লাগান, গাছ কাটুন, তাহলে হাতে রইল কী?

বৃক্ষ নিধন ও রোপণ প্রসঙ্গে সময় একটা খুব বড় অঙ্ক। একটা ১০০ বছরের পুরোনো গাছ কেটে, নতুন গাছ লাগিয়ে আবার তো সেই ১০০ বছরের অপেক্ষা। এই মাঝখানের সময়টায় পরিবেশকে কে রক্ষা করবে?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Tree

কেমন করে গাছ বাঁচিয়ে রাস্তাঘাট, রেললাইন ইত্যাদি হবে, তা অবশ্যই ভাবতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।

গাছ লাগাও।

Advertisment

পরিবেশ বাঁচাও।

প্রচারে, বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ। প্রচুর আয়োজন করে গাছ লাগানোও চলছে। এ প্রসঙ্গে কিছু পরিসংখ্যান।

সারা দেশের হিসেবে ২০১৭-র রেকর্ড অনুযায়ী বনাঞ্চলের আয়তন ৮০০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি। এটা পুরো দেশের ভৌগোলিক আয়তনের ২৪ শতাংশের বেশি। ২০১৫ থেকে ২০১৭, বনাঞ্চলের আয়তন বৃদ্ধি রেকর্ড পরিমাণ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালে বনভূমির আয়তন ছিল ৭০৮ বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি, অর্থাৎ মোট ভূখণ্ডের প্রায় ২২ শতাংশ। কতটা বেড়েছে, সে তো আগেই বললাম। লক্ষ্যমাত্রা মেনে দেশের ১৫টি রাজ্যে গড়ে ৩৩ শতাংশ বনাঞ্চল বেড়েছে। এর মধ্যে ৭টি রাজ্যে বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। বাকি আটটিতে ৩৩ থেকে ৭৫ শতাংশ। এগিয়ে মধ্যপ্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ ও ছত্তিশগড়।

আরও পড়ুন, রাজনীতিনামা: এনআইএ সংশোধনী বিল পাশ, সকলের এক রা!

২০১৭ থেকে ২০১৯। বলা বাহুল্য, হিসেবমতো সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। কারণ গাছ লাগানোর উদ্যোগ ও উৎসাহে এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। রাজস্থান সরকার ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের জন্য বৃক্ষরোপণ বাধ্যতামূলক করেছে। বিপুল পরিমাণ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে পাঞ্জাব সরকারও। এবছর ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সাড়ে বারো হাজারের বেশি গ্রামে ৫৫০ টি গাছ লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে তারা। উত্তরপ্রদেশ সরকার তো রেকর্ড গড়ার ব্রত নিয়েছে। লক্ষ্য, ১,০০০ কোটি টাকা খরচ করে ২২ কোটি চারাগাছ রোপণ। মহারাষ্ট্র সরকারের ১৩ কোটি গাছ লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০১৮ থেকে ২০১৯-এর জুলাইয়ের মধ্যে।

সরকারি প্রকল্পগুলি ছাড়াও এগিয়ে এসেছে বেশ কিছু কর্পোরেট সংস্থা। ২০১৯-২০ বর্ষ সময়সীমার মধ্যে টাটা প্রজেক্টস লিমিটেড দেশজুড়ে তাদের ১৬০টি প্রজেক্ট সাইটে ২৫০,০০০ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়াও তেলেঙ্গানার একটি গ্রামে ১২,০০০ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। টাটার মতো সংস্থা এই হারে উদ্যোগী হলে, সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও অনেকেই যে এগিয়ে আসবে বা আসছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই সমস্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান চোখের সামনে রাখলে, যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেটা নিঃসন্দেহে খুব ইতিবাচক। কিন্তু সত্যি কি তাই? প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি সত্যি কি আমরা এতটা দায়িত্বশীল? এতটাই যত্নবান? প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে কিছু ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা। আমাদের, বিশেষত শহরে বসবাস যাঁদের, প্রকৃতির সঙ্গে যোগসূত্র ইদানিং ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। সকলেই কমবেশি পরিবেশ দূষণের শিকার।

বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় আবহাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গাছ নেই। তাই বৃষ্টিও হচ্ছে না। বৃষ্টির অভাবে আমাদের নিত্য জীবন বিপর্যস্ত। শুধু এটাই নয়, প্রকৃতি, বিশেষত গাছপালার, সংস্পর্শের অন্যান্য অনেক উপকারী প্রভাবও রয়েছে আমাদের জীবনে। চোখের আরাম, মনের শান্তি, নিজের সঙ্গে একাত্মতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া, সব ক্ষেত্রেই প্রকৃতি ও পরিবেশের ভূমিকার গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন মনোবিদরা বারবার।

আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্যে এগোবো কোন পথে?

এই সব প্রাপ্তির লোভে বা তীব্র আকর্ষণে যাঁরা প্রায়ই প্রকৃতির কাছে ছুটে যান, আমি তাঁদেরই একজন। এই অনুষঙ্গেই বহুবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড় ও জঙ্গলে ঘোরাফেরা। উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বিস্তৃত অঞ্চলে এভাবেই আসাযাওয়া। তখনও আমার কলকাতার বাস ওঠেনি। মনে পড়ছে, যখনই উত্তরবঙ্গ, সিকিম, আসাম, বিহার, ওড়িশার প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে কলকাতায় ফিরতাম, প্রত্যেকবার কলকাতার গাছেদের দেখে বড্ড যন্ত্রণা হতো।

পার্থক্যটা অতি স্পষ্ট। কলকাতার গাছেরা ধূলিধুসরিত, শীর্ণকায়। তাদের দেহে পেরেক পুঁতে ব্যানার, লিফলেট ইত্যাদি লাগিয়ে জর্জরিত করা হয়েছে (আর সব বড় শহর ও শহরতলীর মতোই )। এ হলো যে ক'টি অতি কষ্টে এখনও বেঁচে, তাদের কথা। বেশির ভাগই তো কেটে ধ্বংস। গাছ লাগানোর হিড়িক বা হুজুগের পাশাপাশি এটাও একটা ছবি। এটাও আমরাই করে চলেছি। জঙ্গল কেটে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহর বানানোর চক্করে প্রথম কোপ পড়ে গাছের ওপরেই।

তথাকথিত উন্নয়ন থেকে প্রোমোটার এবং চুরির এক বিরাট চক্র আছে বৃক্ষনিধনের পিছনে। উন্নয়ন প্রসঙ্গে একটাই কথা বলার, কেমন করে গাছ বাঁচিয়ে রাস্তাঘাট, রেললাইন ইত্যাদি হবে, তা অবশ্যই ভাবতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। এলাকার মানুষের সচেতন হওয়াও সমান জরুরি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনা। মহারাষ্ট্রে বুলেট ট্রেনের লাইন পাতার জন্য কেটে ফেলা হবে ম্যানগ্রোভ অরণ্য, এটা জনসমক্ষে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশবিদ থেকে মিডিয়া, বিভিন্ন সংগঠন ও এক বিরাট সংখ্যক সাধারণ মানুষ এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামার পর ট্রেনের গতিপথ বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ভূমিকা কি, সেটা একটি স্কুল পড়ুয়া শিশুও জানে। আর মহারাষ্ট্র সরকার জানে না, এটা হাস্যকর।

আরও পড়ুন, মানবাধিকার বিরোধী জোড়া আইনে শিলমোহর সংসদে, প্রতিবাদই একমাত্র পথ

এরপরই ওই রাজ্যে আবার গাছ কাটা বিতর্ক। মুম্বই থেকে নাগপুর হাইওয়ে, এই ৭০০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা নির্মাণের জন্য কাটতে হবে দেড়শ একরের বেশি বনভূমি, যেখানে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ১ লক্ষ গাছ। প্রশাসনের দাবি, পুনরায় গাছগুলিকে রোপণ করা হবে। শিকড় ওপড়ানো গাছকে পুনঃস্থাপন করে তাদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব কিনা, তার জবাব দিতে পারে একমাত্র সময়।

শুধু মুম্বই কেন, গাছ কাটা বিতর্কে দিল্লি ও কলকাতাও কম যায় না। দিল্লির ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ আজ জাতীয় পর্যায়ে চিন্তা ও আলোচনার বিষয়। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন যে এর একটা বড় কারণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কলকাতার যশোর রোড, ভিআইপি রোড, সাম্প্রতিক কালে কল্যাণী এই গাছ কাটার সূত্রে সমালোচনা ও বিতর্কে জায়গা করে নিয়েছে। সারা শহরের মধ্যে এখনও কিছুটা সবুজ বেঁচে রবীন্দ্র সরোবর অঞ্চলে। কবে সেখানেও লোভের হাত প্রসারিত হয় কে জানে!

সময়! বৃক্ষ নিধন ও রোপণ প্রসঙ্গে সময় একটা খুব বড় অঙ্ক। একটা ১০০ বছরের পুরোনো গাছ কেটে, নতুন গাছ লাগিয়ে আবার তো সেই ১০০ বছরের অপেক্ষা। এই মাঝখানের সময়টায় পরিবেশকে কে রক্ষা করবে? কে কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিয়ে বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে সাহায্য করবে আমাদের? এর উত্তর কারও জানা নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জায়গার অকুলান ও সেই বাবদ দেশে বৃক্ষনিধন যজ্ঞ চলছে আবহমান কাল ধরে। তার সঙ্গে একদল অসাধু ব্যবসায়ী, আন্তর্জাতিক কাঠ পাচার চক্রের লেনদেনের ফলে অরণ্য অসুরক্ষিত। বলা ভালো, সর্ষের মধ্যেই ভূত। সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে অসাধু কালনাগিনীর প্রবেশপথ।

লোভ। মানুষের অন্তহীন লোভের থাবা সর্বত্র প্রসারিত। এই প্রসারণ ক্রমবর্ধমানও বটে। আর এটা চলেও আসছে সেই ইতিহাসের কাল থেকে। সাল ১৮৭১। পূর্ব ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জঙ্গলমহল। ব্রিটিশ রাজের আদেশে ভূমিপুত্রদের অরণ্যে প্রবেশ নিষিদ্ধ হলো। এই নিষেধাজ্ঞা জারির উদ্দেশ্য ছিল, ঠিকাদার ও জমিদারদের হাতে জঙ্গলমহলের ইজারা তুলে দেওয়া ও নিজেদের আর্থিক স্বার্থরক্ষা। হাজার হাজার বছর ধরে অরণ্যের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবনযাত্রার গতিমুখ গেল বদলে। মানুষ বা গাছপালা, শিকড় ওপড়ালে বাঁচা তো সকলের জন্যই কঠিন।

সেই ইতিহাসের পরিবর্তন হয়নি। পরিবেশের ভারসাম্য আমরা নিজে হাতে নষ্ট করে চলেছি। এখন হাহাকার করে কী হবে? প্রাচীন গাছ হলো পরিবারের প্রবীণ মানুষের মতো। পরিবেশ রক্ষা থেকে বন্যপ্রাণীর আহার, পাখপাখালি, কীটপতঙ্গের বাসস্থান। গাছ নেই তো কিছুই নেই। চারাগাছ লাগিয়ে 'অরণ্য সপ্তাহ' পালন খুব ভালো কথা। কিন্তু সেই চারা বড় হওয়ার আগেই তার পরিবারকে, অর্থাৎ বড় গাছকে ধ্বংস করে দেওয়া আসলে পৃথিবীকে ধ্বংস করার প্রথম অধ্যায়। আমরা সচেতনভাবে সেটাই করে চলেছি।

আরও পড়ুন, আধারের আঁধারে আলোর হদিশ

সম্পূর্ণ জীবজগত একে অপরের সঙ্গে কোথাও একটা সূত্রে বাঁধা। সেটা জীবনচক্র। মানুষ ও উদ্ভিদ, উদ্ভিদ ও পশু, সকলেরই সকলকে প্রয়োজন। গত কয়েক দশকে ২ লক্ষ ৪০ হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি (২০১৭-র জানুয়ারির পরিসংখ্যান) বনাঞ্চল হারিয়েছে ভারত। বৃক্ষরোপণ ও নিধনের অঙ্ক কষে হয়তো দেখা যাবে, এতটা নিরুৎসাহিত হওয়ার কিছু নেই। গাছের গুরুত্ব বুঝেছে মানুষ। শুধু সেই সব প্রাচীন গাছের দল, যাদের শাখাপ্রশাখা, শিকড়বাকড়ে বহু যুগের ইতিহাস জড়িয়ে। যারা পরমাত্মীয় হয়ে শুধু দিয়েই গেছে আমাদের, তাদের নিধনযজ্ঞ বন্ধ না হলে চারা রোপন করে পৃথিবীকে বাঁচানো যাবে কি?

সেই কবে রবীন্দ্রনাথ বলাই ও তার গাছের গল্প শুনিয়েছেন আমাদের। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তাঁর মতো আর কে বুঝেছেন? গাছের সঙ্গে বলাইয়ের প্রাণের মেলবন্ধন ছিন্ন করে তাকে বিকল্প বন্ধু খুঁজে দেওয়া যায়নি। পৃথিবীর মানুষের জন্য গাছ সেই অবিকল্প বন্ধু। এই বন্ধুত্ব পরম যত্ন ও ভালোবাসা ছাড়া টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।

Advertisment