সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে বা দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটে নাগরিক, গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারে। ১৫ জুলাই ভারতবর্ষ তা আরেকবার প্রত্যক্ষ করল। ইউএপিএ ও এনআইএ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনী বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় লোকসভা ও রাজ্যসভাতে পাশ হয়ে গেল।
বিরোধীরা তেড়েফুঁড়ে মৌখিকভাবে সংসদে প্রতিবাদ করলেও শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটিতে কংগ্রেস সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলি সংশোধনীর বিরুদ্ধে ভোট দিল না - ব্যতিক্রম ৬ জন সাংসদ।
সদ্যসমাপ্ত লোকসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের ইস্তাহারে যে মানাধিকারের দাবিগুলো (রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন বাতিল করা, আফস্পা-র পুনর্মূল্যায়ন, জম্মু-কাশ্মীর উপত্যকা থেকে সেনার সংখ্যা হ্রাস) ছিল, নির্বাচনোত্তর বিশ্লেষণের সময়ে কংগ্রেসের নেতারা সেগুলি সম্পর্কে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, উগ্র জাতীয়তাবাদী পরিবেশে এহেন প্রতিশ্রুতি নির্বাচনী বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। ইউএপিএ ও এনআইএ-র সৃষ্টিকারী কংগ্রেস সংশোধনীর মৌখিক সমালোচনা করেই রণে ভঙ্গ দেয়। পরোক্ষে সংশোধনী সমর্থন করে। সঙ্গে ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চাণক্যীয় চাল:- সংশোধনীর বিপক্ষে যে কথা বলবে, সেই সন্ত্রাসবাদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে, তা বুঝে নিতে হবে।
আরও পড়ুন, জরুরি অবস্থার স্মৃতি আজও প্রাসঙ্গিক
ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতায় আসার জন্য উদগ্রীব শক্তির কাছে তাই এগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাটপাড়ের ভয় এদের নেই। মানবাধিকার আন্দোলন সমীকরণের উপরে উঠে আদর্শগত ভাবে বিরোধিতা করে। করাও হল। বলা হল, এই দুটি সংশোধনীর মাধ্যমে একদিকে নিরাপত্তার অজুহাতে সংবিধানে অধিকার সংক্রান্ত সুরক্ষাকে সংকুচিত করা হল, অন্যদিকে আইনরক্ষকদের জন্য আইনি অব্যাহতির সংস্কৃতিকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হল। শুধুমাত্র জঙ্গি সন্দেহের বশে কাউকে গ্রেফতার করা অবাধ ক্ষমতা এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়া হল, কিন্তু কোথাও তার দায়বদ্ধতার কথা বলা হল না। সাইবার অপরাধ দেখভাল করার দায়িত্ব পেল এনআইএ, রাজ্যের পুলিশকে না-জানিয়ে যেকোনও সন্দেহজনক বাড়ি তল্লাশির ক্ষমতাও দেওয়া হল। বিদেশে গিয়ে তদন্ত করার ক্ষমতাও অর্পিত হল তাদের উপর।
আসলে, ব্যক্তিকেও জঙ্গি সন্দেহ করে গ্রেফতার করা যাবে - এ হেন ক্ষমতা দেওয়ার গূঢ় কারণ হল- সরকারের নানা কাজকর্মের সমালোচক, মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতার জঙ্গি সহায়ক তকমা দিয়ে। ভয়, সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করা যাতে প্রতিবাদ কেউ না করতে পারে।
আরও উদ্বেগের বিষয়, সংশোধনীর সপক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লিখিত যুক্তিগুলোর মধ্যে সারবত্তা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
অচ্ছে দিন আসুক বা না আসুক কুছ পরোয়া নেই শাসক দলগুলির, ডর লাগনা আচ্ছা হ্যায়- অন্ততপক্ষে এই উপলব্ধিটুকু নাগরিকের জীবনে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। প্রতিবাদের ক্ষীণ ধারাটুকুরও অবলুপ্তি ঘটবে। মৌনী গণতন্ত্রের পথে প্রবেশ করবে ভারত। কিন্তু যে কোনও সরকারের ন্যূনতম সাংবিধানিক দায়িত্ব নাগরিকের মন থেকে ভয় দূর করা। এখানে অবশ্য এখন সব উলটপুরাণ।
লক্ষ্যণীয় শাসক দলের পরস্পরবিরোধিতা। একদিকে নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সংসদে বিজয়ী সাংসদদের বললেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে ভয়-ভীতি-আতঙ্কের বাতাবরণ নির্মূল করতে হবে। অথচ অন্যদিকে আমরা দেখছি, পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের নানা স্থানে গণপিটুনির নৃশংস হত্যাকাণ্ড, সরকারি নিষ্ক্রিয়তা, গোরক্ষকদের হাতে নিহত মামলাগুলো ধ্বংস করে দেওয়া, ক্রমাগত সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আতঙ্কের পরিবেশকে আরও শক্তিশালী করছে। সঙ্গে যুক্ত হল এই নতুন সংশোধনীও যা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশ্চিতভাবে টার্গেট করবে।
সংসদে এই টার্গেটের প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, এই আইনের কোনও অপব্যবহার হবে না। কিন্তু কীভাবে! অপব্যবহার না হওয়ার রক্ষাকবচ কি মূল আইন বা সংশোধনী কোথাও রয়েছে! তা নিয়ে সরকারের কাছে কোনও উত্তর নেই।
আরও পড়ুন, এন আর সি ও আসামে ‘বিদেশি পাকড়াও’ করার নানা হাতিয়ার
নতুন সংশোধনী সংগঠন ছাড়াও যে কোনও ব্যক্তিকে জঙ্গি ঘোষণা করার ক্ষমতা এনআইএ-কে দিয়েছে। অর্থাৎ এনআইএ-র মনোগত ধারণার উপর ব্যক্তি স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে। প্রশ্ন হল- একদিকে বলা হচ্ছে, জঙ্গিদের নেটওয়ার্কিং ধরার ও ভাঙার জন্য তদন্ত সংস্থা অন্য দেশেও যাবে, আবার একই নিঃশ্বাসে বলা হচ্ছে, একজন ব্যক্তিও জঙ্গি হতে পারে - একাএকাই ষড়যন্ত্র করবে, ষড়যন্ত্রের নানা কাজ করবে ও তাকে কার্যে পরিণত করবে নেটওয়ার্কিং ছাড়াই! এমনতর জঙ্গি-র কোনও একটি উদাহরণও ভারত সরকার সংসদে পেশ করেনি।
নাগরিক তথা মানবাধিকার সংগঠন হিসাবে আমরা ইউএপিএ ও এনআইএ পুরোপুরি বাতিলের পক্ষে। কারণ আইনের মূল কাঠামোটাই ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এবং এর অপব্যবহার হতে বাধ্য। দায়বদ্ধতাহীন অবাধ ক্ষমতা কতখানি আইনরক্ষক সংস্থাদের দানবে পরিণত করে, তার দৃষ্টান্ত টাডা এবং পোটার সময়ে আমরা দেখেছি।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্যে এগোবো কোন পথে?
১৯৯৪ সালের ২৪ অগাস্ট তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী রাজেশ পাইলট সংসদে বলেন, টাডা আইনে ধৃত ৬৭ হাজারের মধ্যে ৬০ হাজার মানুষ নির্দোষ ছিলেন। প্রায় ৮ হাজারের মত মানুষের বিচার হয়। তাতে ৭২৫ জন দোষী সাব্যস্ত হন। বলা বাহুল্য সেই ৭২৫ জনের বিচারও হয়েছিল যথাযথ বিচারপদ্ধতির মাধ্যমে নয়। যে গুজরাটে সন্ত্রাসের কোনও ইতিহাস ছিল না, সেখানেই সর্বাধিক সংখ্যক নিরীহ মানুষকে টাডায় বন্দি করা হয়েছিল। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত নাগরিকরাই মূলত আক্রান্ত হয়েছিলেন।
দু বছর ধরে চালু থাকা পোটার অবস্থাও ছিল করুণ। সরকারি রিভিউ কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ২৮৩টি পোটা মামলাতে ধৃত ১৫২৯-এর মধ্যে ১০০৬-এর বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযোগের কোনও তথ্য ছিল না। আবার পোটার ধৃত বন্দিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল মহিলা ও শিশু। মোট ধৃতদের দুই তৃতীয়াংশের উপর পোটা প্রয়োগ ছিল সম্পূর্ণভাবে ভুল।
ইউএপিএ বা এনআইএ-তে অপব্যবহার হচ্ছে কিনা তা বোঝার কোনও উপায় নেই। টাডা বা পোটাতে নিদেনপক্ষে তা বোঝা যেত। কারণ প্রতি পাঁচ বছরে সরকার বাধ্য থাকত ওই আইনগুলির কার্যকারিতা নিয়ে সংসদকে রিপোর্ট পেশ করতে। ইউএপিএ বা এনআইএ-তে এ ধরনের কোনও ধারা নেই। ফলে ২০০৮ সাল থেকে ইউএপিএ র অপব্যবহার নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে কিন্তু সামগ্রিকভাবে সরকারি রিপোর্ট আজ অবধি নেই।
দ্বিতীয়ত, এনআইএ-কে যতই নিরপেক্ষ বলা হোক না কেন, ২০১৪ সালের পর থেকে দেখা যাচ্ছে, এনআইএ পক্ষপাতদুষ্ট। শাসকদলের চাপে পড়েই মালেগাঁও বিস্ফোরণে অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সাংসদ সাধ্বী প্রজ্ঞা ঠাকুরকে নির্দোষ বলা, সোহরাবুদ্দিন মামলা ঠিকমত পরিচালনা না করে অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস করিয়ে দেওয়া, মুজফফরনগর (২০১৩) দাঙ্গায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়া, আখলাক, জুনাইদ, পেহলু খানদের মামলায় নানা আইনি স্যাবোট্যাজ করার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। এনআইএ শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনে চলবে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিপন্নতা আরও বাড়বে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক আবিষ্কার করেছে, পোটা থাকলে নাকি মুম্বই বিস্ফোরণ ঘটত না। আইনের ভয়ে ভীত হয়ে জঙ্গিরা নাকি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকত।
সমাজতত্ত্বের প্রাথমিক জ্ঞান থাকলে কেউ এ কথা বলতে পারতেন না। যারা নিজেদের শরীরকে মানববোমার মাধ্যমে উৎসর্গ করে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে, তাদের কাছে কোনও কঠোর আইনই যথেষ্ট নয়। বিষয় বা সমস্যাটা এখানে রাজনৈতিক, রাজনৈতিক ভাবেই তার সমাধান করতে হবে। সামরিক শক্তি বা কঠোর আইন দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যায় না।
এ ছাড়াও অমিত শাহ পোটার অনুপস্থিতির সঙ্গে মুম্বই বিস্ফোরণের কার্যকারণ সম্পর্ক বোঝাতে ব্যর্থ।
রাজনৈতিক সমস্যাকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসাবে না দেখে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে এগোক, যার মাধ্যম হতে পারে একমাত্র আলাপ-আলোচনাই।
(সুজাত ভদ্র মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক, মতামত ব্যক্তিগত)