Ubuntu একটা আফ্রিকান শব্দ। এর মানে আমরা আছি তাই আমি আছি। আই অ্যাম বিকজ উই আর। এই শব্দটার প্রসঙ্গে আমাকে একটা গল্প বলেছিলেন একজন বন্ধু, কীভাবে আফ্রিকার কোন এক জায়গায় একদল বাচ্চাকে একটা প্রতিযোগিতায় দৌড়ে প্রথম হলে একটা পুরস্কার পাবার কথা বলা হয় আর সেই বাচ্চারা সক্কলে একসঙ্গে দৌড়য়। ‘কেন এরকম করলে’ তার উত্তরে সেই বাচ্চারা সমস্বরে এই কথাটা বলেছিল-আই অ্যাম বিকজ উই আর। কথাটা আমার ভারি ভালো লেগেছিল। আমিও অনেককে বলেছি। পরে ফেসবুকে, হোয়াটস্যাপেও কথাটা দেখেছি। বেশ সুন্দর একটা চিন্তা – ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’-এর সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তার উলটো।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা কি ইয়েচুরিকে বাছবে?
জানিনা এটা আফ্রিকার কোন অঞ্চলের ভাষা। ভেবেছি এমনও হতে পারে যে এটা একটা গল্পই। কিন্তু তাতেই বা কী! ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কতো সুন্দর সুন্দর গল্প আমরা শুনেছি, নাহয় এটা আরেকটাই হল। কিন্তু, যদি গল্পও হয়, যে বানিয়েছে তার চিন্তা প্রকাশের আধারটি ভারি সুন্দর। ব্যক্তিগত সাফল্যের উঁচু চূড়ায় একলা ওঠার অলীক আর হতাশাজনক গল্পের বাইরে এই সম্মেলক বোধের ভাবনা তো আজ ভাবছে পৃথিবীর বহু মানুষ। বিশেষ করে তরুণরা, যাদের দৌড় করিয়ে মারা হয় ‘উচ্চতম সাফল্যে’র দিকে। সমাজকে, অন্য সকলকে বাদ দিয়ে যে একা বাঁচার কোন পথ নেই, মানুষকে শেষ পর্যন্ত তার শেকড়ের কাছেই থাকার চেষ্টা করতে হয়- এসব কথা ক্রমশ বেশি বেশি করে ধ্বনিত হচ্ছে। প্রাচীন সমাজের দেশ থেকে,এমনকি ‘সফল’ মানুষদের দেশ থেকেও। বিশেষ ভাবে তরুণদের মধ্যে থেকে উঠে আসছে নানান ভাবনা। হতেও পারে তাদেরই মধ্যে কেউ রচনা করেছেন এই কাহিনি। কিংবা এটা হয়ত সত্যই। সত্য তো কতো সময়েই হয় গল্পের চেয়েও সুন্দর, হয় না কি?
এবারে কলকাতায় এসে একটা রেস্তরাঁ দেখলাম সেটার নাম ওই শব্দটা- উবুন্তু। বেশ ভালো লাগল। তাহলে এই শব্দ ভালো লেগেছে আরো অনেকেরও। এই ছোট্ট খাবার জায়গাটার নিজেরও আছে একটা পরিচিতি। সেটাই আমার কাছে বড়। নানারকম ‘অন্য চিন্তা’র বন্ধুরা মিলে এটা বানিয়েছেন। প্রথমত এখানে পাওয়া যায় সেইসব খাবার যেগুলোতে কোন প্রাণীর দেহজাত কিছু ব্যবহার করা হয় না। অর্থাৎ কেবল মাছ-মাংস-ডিম নয়, দুধ বা দুগ্ধজাত খাবারও বর্জিত। অনেকেই মনে করেন দুধ সেই প্রাণীদের শাবকদের জন্য, তাদের বঞ্চিত করে মানুষ ব্যবসা করার জন্য কৃত্রিম ভাবে দুধ তৈরি করে নিজেরা ব্যবহার করবে, এটা বিধেয় নয়। এটাও একরকম নিষ্ঠুরতা। যাঁরা এরকম ভাবেন, তাঁদের সঙ্গে আমার মতে মিলতে পারে, নাও পারে। কিন্তু তাঁদের অবশ্যই অধিকার আছে এই চিন্তা প্রকাশ করার, অন্য কাউকে আঘাত বা ক্ষতিগ্রস্ত না করে এই আচরণ অভ্যাস করার। সেই স্বাধীনতা প্রকাশের জায়গা আমার কাছে একটি আনন্দভূমি। শুধু খাদ্যাভ্যাস নয়, জায়গাটা আরো নানা দিক থেকে ‘অপর’ বলে চিহ্নিতদের নিজেদের সাড়া দেওয়ারও পরিসর, যেখানে দেওয়ালের ছবি এঁকেছে অটিস্টিক বাচ্চারা, ভেতরের হালকা সুন্দর চেয়ারটেবিল, দেওয়ালের রঙ, খুশি মনে গানবাজনা করতে থাকা গরু ভেড়াদের ছবি, ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে তৈরি ভারি চমৎকার সব গৃহসজ্জা, সবকিছুর ভেতর দিয়েই একটি অস্মিতার আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছে। রান্না, পরিবেশন, উপস্থিতিতে যাদের দেখা গেল তাঁরা অনেকেই রূপান্তরকামী।
মায়ের পেট ইচ্ছেমত কেটে ফেলার জায়গা নয়
এই উপস্থিতি ব্যাপারটা আলাদা করে চোখে পড়ে। সবাই যে সর্বদা কিছু নির্দিষ্ট কাজ করছেন, এমনও দেখালাম না আমার সামান্য সময়টুকুর মধ্যে। অর্ডার নিয়ে যাওয়া, খাবার এনে দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন উপস্থিত আরো কয়েকজন। একজন ওইখানেই অন্য একটা টেবিলে বসে কিছু সেলাই করছেন। একটি কিশোরীপ্রায় ছাত্রী নেমে এল ওপর থেকে। শোনা গেল ওপরের কোনো একটা ঘরের কোনে বসে কম্পিউটারে পড়া তৈরি করছিল সে। রন্ধন-শিল্পীটি এসে খোঁজ নিয়ে গেল পছন্দ হয়েছে কী না তার তৈরি ভেজ ফিশফ্রাই। ‘অসাধারণ!’ শুনে জ্বলজ্বল করে উঠল তার চোখমুখ। কানের লম্বা দুলে দোলা তুলে অন্যদের দিকে তাকিয়ে এমন হাসল যেন ‘কেমন! বলেছিলাম না!’
ওইটুকু সময়ে মনে হচ্ছিল নিত্য প্রতিযোগিতায় টান হয়ে থাকা ক্লান্ত ক্লিষ্ট পরিপার্শ্বের বাইরে ‘নিজেদের মত’ থাকার এই জায়গাটুকু যদি ‘হেরো’ লোকেদের নিজস্ব হয় তো তাতে কার ক্ষতি? এই ছোট্ট জায়গাটা কতোদিন থাকবে, আমি জানি না। চাই যে এরকমভাবেই থাকুক যতোদিন পারে। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে যে একটা উঠে গেলেও তার জায়গা নিয়ে আরো দুটো গড়ে উঠবে, এটা নিশ্চিত।
সারাক্ষণ পরস্পরকে কনুয়ের গুঁতো মারতে মারতে আর হিংস্রতার মার খেতে খেতে ক্লান্ত লোকজন যদি আর না ছোটবার প্ল্যান করে? আর যদি ‘ফার্স্ট হতে’ না চায়? দিন যে পাল্টাচ্ছে, সে কথা সত্যি। আজ যারা দেখতে পাচ্ছে না, তারা কাল অবাক হবে।
‘আরো সফল হও, আরো বেশি জিনিস কেনো’ এই সাফল্যের বাইরে নিজের জীবনকে কিছুটা নিজের মত করে কাটানোর তৃষ্ণা লোকজনের মধ্যে বাড়ছে। আজ তাদের সংখ্যা কম, খুব কম। কিন্তু পনের বছর আগকার থেকে বেশি, দশ বছর আগেকার চেয়ে, এমনকি পাঁচবছর আগেও যত জন সহজ জীবনকেই সফল জীবন মনে করে, তাদের সংখ্যা বেড়েছে। কোনো পথ সরলরেখায় অনেকদূর চলে না।এই বাঁক পাল্টানোই নিয়ম, প্রকৃতির, মানুষের ভাবনা আর বোধেরও। সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তিরও মর্জিমত তাকে বেশিদিন চলতে দেখা যায় নি। কতোরকম করে যে বাঁচে সে! একটা বাঁধন নিগড় হয়ে উঠলেই কিছুজন তা থেকে বেরোবার কথা ভাবে। প্রতিবারই সে এক মুক্তিপ্রচেষ্টা। আর সব মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই তো সুন্দর। আবার যখন ধীরে ধীরে তারও ওপর জমতে থাকে ক্ষমতালাভের কালি তখন আবার...এক মোড় ফেরার মধ্যেই বুঝি আছি আমরা।
(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, পর্যবেক্ষণ ও মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে