প্রথম মোদী সরকারের বাজেট পেশ করার সময়ে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি মনমোহন সরকারের সমালোচনায় বলেছিলেন দান বা ভর্তুকির রাজনীতি ভারতবাসীকে দিয়েছে এনটাইটেলমেন্ট। কোনও ক্ষমতায়ন বা এমপাওয়ারমেন্টের পথে হাঁটতে পারেনি। তাঁদের সরকার সে পথ দেখাবে দেশবাসীকে। কিন্তু তারপর জনমোহিনী রাজনীতির চাপে সেই একই কাজ বিগত মোদী সরকার বারংবার করেছে। বাড়ি, শৌচাগার, রান্নার গ্যাস সবকিছু তুলে দিয়েছে মানুষের হাতে। অথচ যে দুটি ব্যাপারে সর্বাধিক ক্ষমতায়ন সম্ভব- সে দুটিই রয়ে গিয়েছে আঁধারে। সমস্ত সরকারি কমিটির উপদেশ উপেক্ষা করে মোট জিডিপির ১.৫ শতাংশের বেশি অর্থ স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ করা গেল না। শিক্ষা খাতে ৩ শতাংশ। এই দুই হিসাব অনুযায়ী ভারত অন্য প্রায় সব উন্নত, উন্নয়নশীল, এমনকি দরিদ্র দেশগুলিরও পিছনে।
এই আবহে বিপুল জনমত নিয়ে এসে দ্বিতীয় মোদী সরকারের বাজেটে চ্যালেঞ্জ ছিল অনেকটাই। আশ্চর্যজনকভাবে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের বাজেট বক্তৃতায় স্বাস্থ্য নিয়ে বক্তব্য ছিল যৎসামান্য। অথচ পরে বাজেট নথি থেকে দেখা গেস স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮-১৯ এর বিনিয়োগ (রিভাইজড)এর তুলনায় ১৯ শতাংশ বেশি বরাদ্দ পেয়েছে স্বাস্থ্য, গত কয়েক বছরের তুলনায় দিশা পরিবর্তন করে। এর মধ্যে প্রায় ১৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে গ্রামীণ স্বাস্থ্য ও ভাল থাকার কেন্দ্র (ওয়েলনেস ক্লিনিক)-এর জন্য ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ শহরের জন্য। নিঃসন্দেহে এই জাতীয় বিনিয়োগ ভারতের স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামোকে অনেকটা উন্নত করতে পারবে- যদিও এই অর্থ পর্যাপ্ত কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় সরকার স্বয়ং স্বীকার করেছে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রভূত উন্নতির প্রয়োজন। যতক্ষণ সরকারি পরিষেবা অপ্রতুল তাকছে, সেখানকার গুণমানের উন্নতি দূরস্ত, ততক্ষণ আয়ুষ্মান ভারতের মত বিমা যোজনায় বিনিয়োগ বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ে প্রাণ সঞ্চার করবে, আসল স্বাস্থ্য উন্নতি অধরা রেখেই। তাই স্বাস্থ্য পরিষেবার বিনিয়োগের ধারা আগামী বছরগুলিতেও অব্যাহত না থাকলে বিমা য়োজনার সুফল থেকে সাধারণ ও গরিব মানুষ বঞ্চিত থেকে যাবেন।
এবারের বাজেটে টিয়ার ২ শহরে স্বাস্থ্য পরিষেবা বাড়ানোর একটা সম্ভাবনা ছিল। বর্তমানে মহকুমা হাসপাতাল ও জেলা হাসপাতালগুলিতে পরিকাঠামোর অভাবের কথা বারবার সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছে। যন্ত্র থাকলে যন্ত্রের চালক নেই, ডাক্তার থাকলে নার্স নেই, সর্বত্র চতুর্থ শ্রেণির সহায়কদের - এই চিত্র ভারতের প্রতিটি রাজ্যে। ফলত সমস্ত কঠিন রোগগ্রস্ত রোগিকে দেদার রেফার করা হচ্ছে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে। রোগীর চাপে তাদের নাভিশ্বাস আর তাবৎ রোগীরা সঠিক গুণমানের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। এমত অবস্থায় দ্বিতীয় স্তরের হাসপাতালগুলি, যেগুলি বিভিন্ন রাজ্যের মহকুমা ও জেলা শহরে অবস্হিত, সেখানে বিনিয়োগের অভাব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন আনার পথে অন্তরায় হবে নিঃসন্দেহে।
এ প্রসঙ্গে বলা দরকার প্রথম মোদী সরকারের ফ্ল্যাগশিপ প্রেগ্রাম স্বচ্ছ ভারত মিশনে বিনিয়োগ অনেকটা কমেছে এ বছর। মহাত্মা গান্ধীর নামাঙ্কিত গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টির মত স্বচ্ছ ভারতে বরাদ্দ এক লাফে অনেকটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ বাজেট ভাষণে বলা হল, শৌচালয় তৈরিতে অভূতপূর্ব সাফল্যের পর এই মিশন জঞ্জাল মুক্তি বা সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের কাজেও ব্যবহার করা হবে। অর্থাৎ কার পরিসর সম্প্রসারিত হল। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা ভাল যে শৌচালয় তৈরি হলেও সেগুলির পূর্ণ ব্যবহার দূরস্ত থেকে গেছে মূলত শৌচালয় জলের অভাবে। তাই শৌচালয় নির্মাণ ও উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্ম করা বন্ধ একসঙ্গে হয়নি। তাই এই বিশাল প্রকল্পের বিনিয়োগ হ্রাস ও জল সরবরাহ সম্পর্কে কোনও উল্লেখের অভাব- সঙ্গে লোকসভায় এই প্রকল্পের জয়গান- মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
শেষে শিক্ষা প্রসঙ্গ। টাকার হিসেবে শিক্ষায় বিনিয়োগ বেড়েছে সন্দেহ নেইষ বৃদ্ধরি হার ১৩ শতাংশ। মোট বাজেটে বিদ্যালয় শিক্ষায় গিয়েছে ৬৫ শতাংশ, বেড়েছে মিড ডে মিলের বরাদ্দ। অন্য সমস্ত পরিকল্পনাকে একসঙ্গে করে সমগ্র শিক্ষা অভিযান শুরু করা হল। কিন্তু কমিয়ে দেওয়া হল শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও প্রধানমন্ত্রী নামাঙ্কিত ছাত্রবৃত্তিতে অনুদান। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় জাতীয় গবেষণা কোষ (ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন) তৈরি ও আই আই টির মতো শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলিতে আরও বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত স্বাগত জানানোর মতই। বাড়ছে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অনুদানও। কমছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি-র মত কেন্দ্রীয় সংস্থার গুরুত্ব- যা রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে (কলকাতা-যাদবপুরের মত) গবেষণার জন্য অনেক অনুদান দিয়ে থাকে। ফলত তেলা মাথায় তেল দেওয়ার এই পদ্ধতিতে শিক্ষাগত বৈষম্য বাড়বে নিঃসন্দেহে।
শেষ করব একটি পরিসংখ্যান দিয়ে। মোট কেন্দ্রীয় বাজেটের ৯ শতাংশ অনুদান গেল প্রতিরক্ষা খাতে এবং স্বাস্থ্যে ও শিক্ষায় যথাক্রমে ২.৩ ও ৩.৪ শতাংশ। অর্থাৎ সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য-শিক্ষা মিলে ৫.৭ শতাংশ খরচ হবে, আর প্রতিরক্ষা খাতে তার চেয়ে অনেক বেশি। মনে রাখতে হবে এই চিত্র ভারত কেন, কোনও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অর্থনীতির সুস্বাস্থ্যের প্রতিফলন ঘটায় না। ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রকে আরও বিস্তারিত, গভীর ও সাম্যমূলক না করতে পারলে অর্থনীতির আকার ষষ্ঠ বৃহত্তম হতে পারে, কিন্তু ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের কাছাকাছিও আসবে কিনা তাতে সন্দেহ থেকেই যায়!
(অরিজিতা দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক)