ভারতের আর্থিক মন্দা যে ঠিক কতটা তীব্র, তা প্রকাশ পেয়েছিল কেন্দ্রীয় বাজেটের প্রাক্কালে পেশ করা অর্থনৈতিক সমীক্ষা বা ইকনমিক সার্ভের দৌলতেই। ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশে, যা কিনা ২০০৮-০৯ সালের বিশ্বব্যাপী মন্দার পর থেকে সর্বনিম্ন। শিল্প, পরিষেবা, এবং কৃষি - অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রেই চোখে পড়ছে মন্দা। বিনিয়োগের হার গত বছরের তুলনায় কমেছে জিডিপি'র ১.২ শতাংশ পর্যন্ত। ব্যাঙ্কের দেওয়া ঋণের বৃদ্ধি কমেছে শিল্প এবং পরিষেবার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মাঝারি, ক্ষুদ্র এবং অতিক্ষুদ্র উদ্যোগ মন্ত্রকের ক্ষেত্রে।
এই অর্থনৈতিক অবনতির প্রেক্ষিতে পেশ করা হলো কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২০-২১, যাতে প্রকাশ পেল ২০১৯-২০ সালের বাজেট বরাদ্দের তুলনায় মোট কর রাজস্বে (gross tax revenue) ২.৯৭ লক্ষ কোটি টাকার অবিশ্বাস্য ঘাটতি। মোট কর রাজস্বে এই পতন, যা কিনা ২০১৯-২০ (সংশোধিত বরাদ্দ, অর্থাৎ revised estimate বা RE)-তে ছিল জিডিপি'র ১০.৫ শতাংশ, ২০১৪-১৫ বর্ষের পর সর্বনিম্ন। মনে রাখবেন, ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে ঘোষিত হয় কর্পোরেট করের উপর উল্লেখযোগ্য ছাড়, যার ফলে বর্তমানে ভারতে কর্পোরেট ট্যাক্সের হার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া অথবা ফিলিপিনসের মতো ASEAN দেশগুলির চেয়ে কম। অর্থনীতির এই 'ট্রিকল ডাউন' তত্ত্বই অনুসরণ করে এবারের বাজেটে হ্রাস পেয়েছে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয়ের উপর কর, কোম্পানির ক্ষেত্রে লোপ পেয়েছে লভ্যাংশ বিতরণ কর বা dividend distribution tax। যৌথভাবে এই দুইয়ে মিলে বছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লোকসান ঘটাবে বলে অনুমান।
অর্থমন্ত্রী স্পষ্টতই মনে করেন যে বড় সংস্থা এবং বিত্তবান শ্রেণীর জন্য এই ধরনের ট্যাক্স ছাড় পরিণত হবে আরও বেশি বিনিয়োগ এবং ভোগের চাহিদায়, যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলবে। মুশকিল হলো, এই 'ট্রিকল ডাউন' তত্ত্বের না কোনও যুক্তিযুক্ত অর্থনৈতিক ভিত আছে, না আছে পরীক্ষামূলক প্রমাণ। আর্থিক মন্দার প্রেক্ষাপটে বিত্তবান শ্রেণী সাধারণভাবে তাদের সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়াতে চাইবে সরাসরি কর ছাড়ের কারণে হওয়া অতিরিক্ত আয় দিয়ে, বিনিয়োগ বা খরচ না করে। সুতরাং কর ছাড় না দিয়ে যদি সমাজকল্যাণ প্রকল্পে বা নির্দিষ্ট পরিকাঠামো গড়তে সরকারি খাতে ব্যয় করা হতো, তবে সেই অর্থ পৌঁছত সমাজের দরিদ্রতর শ্রেণীর কাছে, যাদের খরচ করার প্রবণতা বেশি।
কিন্তু বাজেট হেঁটেছে উল্টোদিকে, ২০১৯-২০ (RE)-র খাদ্য ভর্তুকি বিল থেকে ৭৫,৫৩২ কোটি, এবং মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা (MGNREGA) থেকে ২০২০-২১ (বাজেট বরাদ্দ বা BE) বর্ষে ৯,৫০২ কোটি টাকা কমিয়ে। আগামী পাঁচ বছরে পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, তাকে পরিহাসে পরিণত করে বাজেটে মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে পরিকাঠামো অর্থায়ন সংস্থাগুলির জন্য।
সুতরাং এই বাজেট থেকে কোনোরকম কার্যকরী আর্থিক প্রাণসঞ্চারের প্রত্যাশা থেকে থাকলে তা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর দাবির বিপরীতে গিয়ে রাজস্ব ঘাটতিতে সামান্য বৃদ্ধির দ্বারা উপকৃত হবেন বিশেষ কিছু ধনবান মানুষ, বাড়তি মূলধন ব্যয় বা কর্মসংস্থান হবে না। তাছাড়া, ২০২০-২১ বর্ষে বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়বে, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়ায় ফের একবার বাজেট বরাদ্দের কমই হতে পারে সরাসরি কর এবং জিএসটি থেকে আদায় হওয়া রাজস্ব। এর ফলে প্রয়োজন পড়বে আরও ব্যয় সঙ্কোচনের, যদি এই তীব্র মন্দার বাজারে সরকার রাজকোষ একত্রীকরণের (fiscal consolidation) পরিকল্পনা ত্যাগ না করে।
অর্থক্ষেত্রের পরিস্থিতি নিয়েও বিভ্রান্ত করে এই বাজেট। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি প্রকাশিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিকতম আর্থিক স্থিতিশীলতা রিপোর্ট ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে যে, নথিভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কে ইদানীং নন-পারফর্মিং অ্যাসেট চিহ্নিত করার প্রবণতা যে কমে আসছিল, তা ফের ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে। ২০১৬ সালে লাগু হওয়া দেউলিয়া বিধি (Insolvency and Bankruptcy Code) যে শুধুমাত্র ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় ভারগ্রস্ত সম্পদের (stressed assets) সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, নন-ব্যাঙ্কিং ফিনানশিয়াল সংস্থার ক্ষেত্রে 'credit bubble'-এর বিস্ফোরণের ফলে নতুন সমস্যার আমদানি হয়েছে। রেকর্ড সৃষ্টি করেছে ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনাও; ২০১৯-২০'র প্রথম ছ'মাসেই ১.১৩ লক্ষ কোটি টাকা উধাও হয়েছে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা থেকে।
কর্পোরেট ক্ষেত্রে এই অপরাধমনস্কতার দিকে নজর না দিয়ে সরকার উঠেপড়ে লেগেছে জনসম্পদ বেচে দিতে, যার ফলে নজিরবিহীন ভাবে ২০২০-২১ বর্ষে বিলগ্নিকরণ থেকে আয় বরাদ্দ করা হয়েছে ২.১ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং এলআইসি থেকে আসা আনুমানিক ৯০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্বের ঘাটতি মেটাতে এই মন্দার বাজারে রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সম্পদ নিয়ে এই যে জুয়া খেলা, তা এই চরম হতাশাজনক বাজেটের সবচেয়ে বড় অধঃপতনের পরিচয়।
(লেখক অর্থনীতিবিদ এবং আহ্বায়ক, নাগরিকপঞ্জি বিরোধী যুক্তমঞ্চ। মতামত ব্যক্তিগত)