প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে সংসদে বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, অথচ তাঁর একটানা বাক্যস্রোতে কোথাও নজরে পড়ল না গত আড়াই বছর ধরে ভারতীয় অর্থনীতিকে গ্রাস করেছে যে সঙ্কট, তার মোকাবিলা করার কোনও উল্লেখযোগ্য ভাবনাচিন্তা।
অর্থনীতির বর্তমান সঙ্কটের মূলে আছে চাহিদার তীব্র অধোগমন, খরচের দিক থেকে এবং বিনিয়োগের দিক থেকেও। গত বছরের কর্পোরেট ট্যাক্সে বা 'রেপো রেট'-এ ছাড় মূলত ছিল 'সাপ্লাই সাইড' বা সরবরাহ পক্ষে হস্তক্ষেপ। প্রত্যাশা ছিল, বাজেটে 'ডিম্যান্ড সাইড' বা চাহিদার পক্ষেও দেখা যাবে সরকারি হস্তক্ষেপ, আর্থিকভাবে কিছুটা সাবধানতা ত্যাগ করে হলেও। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বাজেটে এমন কিছুই রাখেন নি, যাতে উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়তে পারে চাহিদা। ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে সংশোধিত বরাদ্দ ছিল জিডিপি (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন)-র ৩.৮ শতাংশ রাজস্ব ঘাটতি (fiscal deficit), যা ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে ৩.৫ শতাংশ করা হবে বলে বলা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা স্রেফ অবাস্তবই নয়, কিছুটা অবাঞ্ছিতও। চাহিদা বাড়াতে প্রয়োজন সরকারের তরফে জোরকদমে ব্যয়।
বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে মানেই যে বাস্তবে খরচ হবে, এমনটা সবসময় নয়। খরচ হলে বরাদ্দ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। উদাহরণ স্বরূপ, ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে সেন্ট্রাল সেক্টর স্কিমে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৮.৭১ লক্ষ কোটি টাকা, এবং সেন্ট্রালি স্পনসরড স্কিমের খাতে বরাদ্দ ছিল ৩.৩২ লক্ষ কোটি টাকা। অথচ সংশোধিত বরাদ্দে দেখা গেল, বাস্তবে খরচ হবে যথাক্রমে ৭.৭৩ লক্ষ কোটি এবং ৩.১৭ লক্ষ কোটি টাকা। খাদ্য ভর্তুকির মতো সেন্ট্রাল সেক্টর স্কিমের খাতে ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে বরাদ্দ ছিল ১.৮৪ লক্ষ কোটি টাকা, কিন্তু সংশোধিত বরাদ্দ হলো ১.০৯ লক্ষ কোটি টাকা। অথচ মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার (MGNREGA, বা ১০০ দিনের কাজ) মতো সেন্ট্রালি স্পনসরড স্কিমের খাতে ২০১৯-২০ বর্ষে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় ৭১ হাজার কোটি টাকা। সেই প্রকল্পেই ২০২০-২১ বর্ষের জন্য বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে ৬১,৫০০ কোটি টাকা।
সরকারের আশা, ১০ শতাংশ হারে বাড়বে নামমাত্র জিডিপি, অথচ সেন্ট্রালি স্পনসরড স্কিমের অন্তর্গত মূল প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে ২০১৯-২০'র তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে সামান্যই। এমন কয়েকটি প্রকল্পের নমুনা হলো: প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা (২.৬ শতাংশ), প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা (৬.৪ শতাংশ), জাতীয় শিক্ষা মিশন (১.৬ শতাংশ), জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন (সংশোধিত বরাদ্দ অনুযায়ী -.৫ শতাংশ কমেছে), স্কুলে মিড-ডে মিলের জাতীয় প্রকল্প (একই আছে), সমন্বিত শিশু বিকাশ পরিষেবা (Umbrella Integrated Child Development Services বা ICDS, ৩.৫ শতাংশ), জাতীয় জীবিকা মিশন - আজীবিকা (২.৪ শতাংশ), চাকরি এবং দক্ষতা উন্নয়ন (-২৬ শতাংশ কমেছে), নগর পুনরুজ্জীবন মিশন: AMRUT এবং স্মার্ট সিটিজ মিশন (বাড়ে নি), প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা (রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা যোজনা সমেত, -১.৯ শতাংশ কমেছে)।
অর্থনীতির চাহিদা পক্ষে সরকারের সবচেয়ে বড় হস্তক্ষেপ এসেছিল গত বছরের ডিসেম্বরে, 'National Infrastructure Pipeline (NIP)'-এর অন্তর্গত কিছু পরিকাঠামো প্রকল্পে ১০৩ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ, যা কার্যকরী হবে পাঁচ বছর ধরে। সেই কথাই তাঁর বাজেট ভাষণে ফের টেনে আনলেন অর্থমন্ত্রী। NIP প্রকল্পের আওতায় পড়ছে ৬,৫০০-এর বেশি প্রকল্প, তাদের আয়তন এবং বিকাশের স্তর অনুযায়ী বিভক্ত। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেল মেনে চলবে এই প্রকল্পগুলি, যেখানে সরকারের অবদান হবে পাঁচ বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা। এতে আমাদের অর্থনীতি আদৌ কোনোরকম বৃদ্ধির পথে হাঁটবে কিনা, তা এখনও অজানা।
এই বাজেটে কি এমন কিছুই আছে, যা সাধারণ মধ্যবিত্তকে সরাসরি সুবিধা দেবে? আপাতদৃষ্টিতে মধ্যবিত্তের কল্যাণে তিনটি বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে - ১) লভ্যাংশ বিতরণ কর বা Dividend Distribution Tax (DDT)-এর অবসান; ২) ব্যক্তিগত আয়কর কাঠামোয় পরিবর্তন; ৩) ডিপোজিট ইনশিওরেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গ্যারান্টি কর্পোরেশনকে (DICGC) অনুমতি দেওয়া হয়েছে ব্যাঙ্কে জমার উপর বীমার পরিমাণ ১ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করার।
এক এক করে দেখা যাক।
লভ্যাংশ বিতরণ কর - বর্তমানে DDT'র হার ১৫ শতাংশ, সঙ্গে সারচার্জ। নতুন প্রস্তাব হলো, বিনিয়োগকারীর আয়ের পরিমাণ অনুযায়ী করের হার নির্ধারণ করা। বর্তমানে বিনিয়োগকারীর লভ্যাংশ ১০ লক্ষ টাকার কম হলে তার ওপর কর দিতে হয় না। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট নয়, এই কর ছাড় বজায় থাকবে কিনা। যদি থাকে, তবে সুবিধা হবে স্রেফ বিত্তবান শ্রেণীরই। মধ্যবিত্তের নিষ্পত্তিযোগ্য আয় (disposable income) প্রভাবিত হবে না। এমনিতেও মধ্যবিত্তের কাছে লভ্যাংশ থেকে আয় খুব সুলভ নয়।
ব্যক্তিগত আয়কর কাঠামো - কোন স্তরে কত কর, তা এতক্ষণে সকলেই জেনে গেছেন। অর্থমন্ত্রীর দাবি, এতে সরলীকরণ হবে আয়কর কাঠামোর। তবে এই পরিবর্তিত কাঠামোর সুবিধে নিতে গেলে বিভিন্ন প্রকারের ছাড় এবং অব্যাহতি বর্জন করতে হবে। এলআইসি, এনএসসি, বা পিপিএফ-এর সুবিধে আর থাকবে না। আগামী এক বছরের জন্য আপনি সুযোগ পাবেন বর্তমান এবং পরিবর্তিত আয়কর কাঠামোর মধ্যে কোনও একটি বেছে নেওয়ার। সোজা অঙ্কের হিসেব করে বুদ্ধি করে বাছবেন। কিন্তু এই ভাবনাটা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছে না যে ছোট আমানতকারীদের তাঁদের ছোটখাটো সঞ্চয় করা থেকে বিরত করতে চাইছে সরকার।
ব্যাঙ্কে জমার উপর বীমা - দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক, বিশেষ করে সিনিয়র সিটিজেনরা, নিজেদের সারাজীবনের পুঁজি রাখেন স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে বা ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিটে। সেখানে ব্যাঙ্কে জমার উপর বিমার পরিমাণ ১ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করায় ব্যাঙ্ক ফেল পড়ার ক্ষেত্রে আমাদের অনিশ্চয়তা কাটল কি?
পরিশেষে বলি, এটি প্রকৃত অর্থেই 'নাথিং বাজেট', যা কোনও ইতিবাচক দিশা দেখায় না আমাদের, বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলা করে না, কোনও আশা যোগায় না, বরং নেতিবাচক অনুভূতি জাগায়।
(লেখক অর্থনীতিবিদ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নোতর দাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)