“যার বিরুদ্ধে নালিশ করছি সে যদি জানতে পারে, এবং আমাদের সঙ্গেও যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তখন কী হবে?”...!
পটভূমি উত্তরপ্রদেশের বারাবাঁকির একটি স্কুল। প্রেক্ষিত 'বালিকা সুরক্ষা জাগরুকতা অভিযান' শীর্ষক অনুষ্ঠান। বক্তব্য রাখছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) আর এস গৌতম।
তাঁকে প্রশ্নটি করেছে স্কুলেরই এক ছাত্রী। উল্লেখে উন্নাও ধর্ষণকাণ্ড।
সাম্প্রতিক কালের আর একটি ধর্ষণকাণ্ড, যা নিছক ধর্ষণের কুখ্যাতি-সীমা ছাড়িয়ে বিস্তৃতি পেয়েছে ঘটনা পরম্পরার ভিন্ন গুরুত্বে। গুরুত্বের এই ভিন্নতা রয়েছে ওই বালিকার প্রশ্নের মধ্যেই! পাঠক জানেন সব। তবু উল্লেখ প্রয়োজন, এখানে ধর্ষণকারী একজন বিধায়ক, অর্থাৎ 'পাবলিক সার্ভেন্ট'। ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি এই ব্যক্তি। প্রতিবাদ করায়, প্রতিকার চাওয়ায় মেয়েটি ও তার পরিবারের লোকজনকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এক ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় ভিকটিম মেয়েটি ও তার উকিল গুরুতর আহত হয়, মারা যান দুই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া।
ঘটনার গতি অনেকদূর এগিয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ ঘটেছে। এসবই প্রতিদিন খবরে আসছে ঘুরেফিরে। এই নিয়ে আর বিস্তারে যাব না। কেন না, উন্নাও-ধারার কাণ্ড তো এদেশে নতুন নয়। প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে গুরুতর অপরাধকে লঘু করাও ঘটে প্রায়ই। প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টাও আবহমানকাল দেখে আসছি আমরা। ধর্ষণ ও তার পরবর্তী আইন, প্রশাসনিক ইত্যকার বিষয় আমাদের এখন আর আলাদা করে ভাবায় না।
আরও পড়ুন: কাশ্মীরের ‘ভারতীয়ত্ব’ নয়, ভারতের ‘কাশ্মীরায়ণ’
আমাদের ভাবায় ওই ছোট্ট স্কুলছাত্রীর প্রশ্ন। বলা বাহুল্য, তার ওই মর্মভেদী প্রশ্নের জবাব পুলিশ সুপার দিতে পারেননি। আমাদের কারও কাছেই ওই বালিকার প্রশ্নের জবাব নেই। জবাব না থাকলেও প্রশ্ন থাকে। প্রশ্ন থেকেই যায়।
ধর্ষণকারী আইনের চোখে অপরাধী। ধর্ষিতা অপরাধের শিকার। এই হলো দুটি পক্ষের অবস্থান, আইনের ধারায় মাঝখানের লাইনটা খুব স্পষ্ট। অপরাধ করলে শাস্তি হবে। যদিও, এই স্পষ্টতার মাঝেও, কিছু বিতর্ক ও সংশয় আছে। কোন এলাকায় ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে, এলাকা অর্থাৎ কোন থানার অধীন? ভিকটিমের বাড়িটি ঠিক কোন থানার অন্তর্গত? এই সব নানা প্রশাসনিক টেকনিক্যাল প্রশ্নের চর্বিত চর্বনের মধ্যে একদিকে ধর্ষিতার পরিবারের লোকেদের হয়রানি। অন্যদিকে অপরাধীর পালিয়ে যাওয়ার, চিহ্ন অর্থাৎ প্রমান লোপের চেষ্টা বা সুবিধা পাওয়ার সুযোগ ঘটানো, এসবও আছে। মোদ্দা কথা, আইন ও প্রশাসনের দড়ি টানাটানি একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক, যেখানে 'বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে' যাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা থেকে যায়।
কিন্তু আমাদের প্রশ্নের ক্ষেত্রটা এর থেকেও বড়। সেটা হলো সমাজ! সমাজ কী বলবে? সমাজ ওই ধর্ষিতা মেয়েটিকে কীভাবে দেখবে? কীভাবে তাকে তুল্যেমূল্যে বিচার ও বিশ্লেষণ করবে? এক্ষেত্রে পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন থেকে কাছে-দূরের চেনা-অচেনারাও সচরাচর যেসব বক্তব্য বা প্রশ্ন পেশ করেন - "ওই মেয়েটা তো ওরকমই। বড্ড ছেলেদের গায়ে পড়া!", "জামাকাপড় দেখেছ?", "রাতবিরেতে বাইরে যাওয়ার দরকার কী বাপু!" ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে এসব কারণেই একজন ধর্ষণকারীর অধিকার জন্মে যায় এই ঘৃণ্য অপকর্মটি করার।
আরও পড়ুন: গণপ্রহার: আদৌ ওষুধ আছে এই সামাজিক রোগের?
যুক্তিটা এরকম, ধর্ষণের শিকার হয় তারাই, যারা নিজেরাই আসলে খারাপ চরিত্রের! অথবা তথাকথিত ভাবে সামাজিক অনুশাসন মেনে চলে না। অর্থাৎ তার প্রতি যে ভয়ানক অপরাধটা ঘটল, সেটা আলোচনায় স্থান পাবে অনেক পরে। আগেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায়, মেয়েটির নিজের দোষ বা ভুলেরই শাস্তি এই ঘটনা। এসবও ছাড়ুন। একজন ধর্ষকের পরিবার কী করে সেই ছেলেটির তথা সেই পুরুষটির পাশে দাঁড়ায়? উকিল নিয়োগ করে? প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে আইনের শাসন থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে, ভাবুন তো একবার? এমনকি নাবালক হলেও এটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আসলে এটাই তো মূল কথা। সামাজিক ভাবেই পুরো ছবিটা বড্ড গোলমেলে।
এই অগোছালো, অপরিণত সামাজিক অবস্থায় একটি মেয়ের ধর্ষিতা হওয়ার পরবর্তী দিনগুলি কীভাবে কাটে, বুঝতে অসুবিধা হয় না। নিজেদের প্রশ্ন করা দরকার, এই মেয়েটির প্রকৃত অবস্থা ভেবে ওঠার মতো সহমর্মী মন বা বিবেচনা আছে কি আমাদের? আমরা কি কল্পনা করতে পারি জীবনের বাকি মুহূর্তগুলি কোন যন্ত্রনা, গ্লানি, অপমান, চূড়ান্ত ক্ষোভ ও অন্তহীন আতঙ্কে কাটে তার? পারি না কল্পনা করতে। আমরা চেষ্টাই করি না। বরং উল্টোটাই করি। তাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। অথচ আমরা, সমাজের এই আমরাই চেষ্টা করতে পারতাম তাকে অনুভূতিগুলি থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে। চাইলেই পারতাম তাকে নতুন ভাবে বাঁচার প্রেরণা যোগাতে। সব লজ্জা ও গ্লানি কিন্তু আসলে পুরো সমাজের, ওই মেয়েটির নয়।
এই সেই সমাজ, যেখানে একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকন্যা থেকে এক মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধাও ধর্ষণের শিকার হতে পারে। এই সেই সমাজ, যেখানে গণধর্ষণ নিত্যদিন খবরের শিরোনামে উঠে আসে। এখানে একটি মেয়ে এমন কী তার নিকটতম আত্মীয় পুরুষটির কাছেও অনেক সময়ই নিরাপদ নয়। ঘরেবাইরে, পথঘাট, অফিসকাছারি সর্বত্র তার শরীর ও মনকে আগলে রেখে বাঁচতে হয়। এখানে ধর্ষণের পর সেই এক বা একাধিক অপরাধী পুরুষকে সমাজ, সামাজিক ভাবে একঘরে করবে না, এটাই বোধহয় স্বাভাবিক। তারা ওই ভিকটিম মেয়েটিকেই ব্রাত্যজ্ঞান করবে, এটা দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা।
ভাবনাটা বদলানো দরকার। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। আইন ও প্রশাসন তার ভূমিকা পালন করছে ও করবে। সেখানকার ফাঁকগুলো নিশ্চয়ই বন্ধ হওয়া অতি প্রয়োজনীয়। মিডিয়া ও সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সচেতনতা অনেকটাই বেড়েছে। সর্বস্তরে আলোচনা, জন আন্দোলন, বিক্ষোভ ইত্যাদিও অপরাধীদের শাস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক ভূমিকা নিচ্ছে। কিন্তু সমাজ? সমাজ মানে আমরা! আমরা কী করছি? আমরা আমাদের ভূমিকার ক্ষেত্রে কোন অবস্থানে আছি? আমাদের মনের অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করছি কি আমরা?
আরও পড়ুন: জন ও স্বাস্থ্য: স্ত্রীরোগ এবং আমাদের সমাজ
ধর্ষণ কি শুধু শারীরিক ভাবে হয়? ধর্ষণ, নির্যাতন, মেয়েদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা ইত্যাদি হঠাৎ এক সকালে ঘটে যায় না। এরও এক পরম্পরাগত প্রক্রিয়া থাকে। সেই প্রক্রিয়া চলাকালীনই পুরুষকে নিজের মন ও মুখ আয়নায় দেখতে হবে। এ এক ভয়ংকর অসুখ, যার আসু চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা সম্ভবও। নাবালকের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে অভিভাবককে। সমাজের ধারক ও বাহকরূপী সব মানুষকে যেন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে ওই স্কুলের বালিকা, "প্রতিবাদ করলে আমি কি বিচার পাব?"
আর আমাদের শেষ প্রশ্ন, একজন ধর্ষিতার আর্ত কান্না কি শুনবে সমাজ? তার অপমানকে কি সমগ্র মানবাত্মার অপমান হিসেবে দেখা হবে? যদি এটা না হয়, তাহলে সমাজের এই রক্তপাত বন্ধ হবে না। অপরাধ করার পরও একজন ধর্ষণকারী বীরের মতো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে। আর এই ঘৃণ্য অপরাধের শিকার যারা, তাদের সুস্থ জীবনে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। দিনের শেষে এই অবস্থাটা সমাজেরই চরম ব্যর্থতা বলে গণ্য হবে না কি?!