Advertisment

উন্নাও বুঝিয়ে দিল, এনকাউন্টার সমাধান নয়

উন্নাও আমাদের কী শিক্ষা দিল? উন্নাওয়ের ঘটনা বুঝিয়ে দিল, একটা এনকাউন্টারে ভারতে ধর্ষণ সমস্যার সমাধান হবে না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Unnao Rape, Rape Encounter

অংলকরণ- অভিজিত বিশ্বাস

পুলিশি এনকাউন্টারে 'ধর্ষণে' অভিযুক্তদের গুলি করে দেওয়ার পক্ষে ভারতের প্রতিটি রাজ্যে দেখা যাচ্ছে গণ উল্লাসের ছবি। এক কথায় বলা যায়, গণ উন্মাদনা। টিভি চ্যানেলে কত মুখ, সবাই বলছেন, এটাই হওয়া উচিত। একেই বলা যায় ন্যায়।

Advertisment

এই ছবিটাই যখন প্রধান হয়ে উঠেছে, তখন এই ভিড়ের মনস্তত্ত্বে হারিয়ে গেছে একটি ছোট্ট বিবৃতি। সর্বভারতীয় প্রগতিশীল মহিলা সংগঠনের নেত্রী কবিতার বিবৃতি। তিনি বলেছেন, "না, আমাদের নাম করে হত্যা নয়। মহিলাদের নিরাপত্তার নামে পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টায়, বিচার ব্যবস্থাকে পাশ কাটানোর চেষ্টায় বিচার-বহির্ভূত হত্যাকে সমর্থন করা হবে না।"

সাধারণ নাগরিক, বিশিষ্টজন, এমনকি সাংসদদের একাংশ যখন হায়দরাবাদের ঘটনাকে ন্যায়বিচার বলে সমর্থন করেছেন, মিষ্টি খাইয়েছেন অথবা বাজি পুড়িয়েছেন, মহিলা আন্দোলনের নেত্রী অথবা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা সাফ জানিয়েছেন, এনকাউন্টারকে কখনও ন্যায়বিচার বলে অভিহিত করা যায় না।

আরও পড়ুন, হায়দরাবাদের এনকাউন্টার ও পরিতোষের বুলেট

পাঠককে মনে করিয়ে দিই, এর আগে দিল্লিতে নির্ভয়া গণধর্ষণের প্রতিবাদে ইন্ডিয়া গেটের সামনে রাজপথে যে মিছিল এবং আন্দোলন হয়েছিল, তাতে এই কবিতাই ছিলেন একদম প্রথম পংক্তিতে। তাহলে? এনকাউন্টারে ধর্ষকদের মৃত্যুর পর যদি বলি, ওদের হত্যা করা গর্হিত অপরাধ হয়েছে, তবে কি ধর্ষকদের ব্যাপারে নরম মনোভাব নেওয়া হয়ে যায়?

কিন্তু যখন হায়দারবাদের ঘটনার পরেও উত্তর প্রদেশের উন্নাওয়ের ধর্ষিতার অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়, তখন তো এ প্রশ্নটাই ওঠে, একটা এনকাউন্টারে কি ধর্ষণ নামক এই সামাজিক ব্যাধির চিকিৎসা হয়ে যাবে? নাকি ধর্ষকদের শাস্তি প্রদানের জন্য চাই শক্তিশালী প্রশাসন, দ্রুত নিষ্পত্তিকারী বিচার ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি, সামাজিক সচেতনতা?

ভারতে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটা মস্ত বড় ঘুণপোকা আছে। ঘুণপোকাটি কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের এই ব্যবস্থাকে। কিছুদিন আগে বলিউডে তৈরি একটি ছবি দেখেছিলাম। ছবিটার নাম 'আর্টিকল ফিফটিন'। অনুভব সিনহার এ ছবিতে আয়ুষ্মান খুরানা এক নবীন আইপিএস অফিসার। প্রথম পোস্টিং বিহারের এক গ্রামে। যেখানে দলিত স্কুলপড়ুয়া বালিকাদের ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। ওই সৎ অফিসার আপসহীন তাঁর তদন্তে, ব্যবস্থা গ্রহণে, কিন্তু তাঁর চারপাশে প্রশাসন, আইন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, দিল্লির রাজনীতি, ক্ষমতার অক্টোপাস। ছবিতে দেখা যায়, কী ভয়াবহভাবে ব্যবস্থার অক্টোপাসে জড়িয়ে পড়ছেন ওই অফিসার। আজ এই ধর্ষকদের এনকাউন্টার দেখে মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগে দেখা সেই ছবি।

উন্নাওতে কী হলো? ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ ধর্ষিতাই। গত বছর উন্নাওয়ের এক সতেরো বছরের কিশোরী উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনেই নিজের গায়ে আগুন দেন বিচার পাওয়ার আশায়। কয়েকদিন আগে আর এক ধর্ষিতা তরুণী আদালতে যাওয়ার পথে অগ্নিদগ্ধ হলেন অভিযুক্তদের হাতেই। প্রাণ বাঁচানোর আশায় প্রায় এক কিলোমিটার ছুটে পালানোর চেষ্টা করেন ওই তরুণী। এই ভয়ানক দৃশ্যটা একবার কল্পনা করুন। বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত। সেই ভারতে এহেন দৃশ্য কি ভাবা যায়?

অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ হোক, কিন্তু রাম রাজ্য বলতে কী বোঝায়? গান্ধীজিও তো রামরাজ্যের কথা বলেছিলেন। সে রামরাজ্য মানে ন্যায় ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। উন্নাও আমাদের কী শিক্ষা দিল? উন্নাওয়ের ঘটনা বুঝিয়ে দিল, একটা এনকাউন্টারে ভারতে ধর্ষণ সমস্যার সমাধান হবে না। ধর্ষণের মতো অপরাধের প্রতি দেশে প্রশ্রয়ের আবহ না থাকলে কী করে উন্নাওতে প্রকাশ্য দিবালোকে ফের এই একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হতে পারে?

আরও পড়ুন, ধর্ষণে মৃত্যুদণ্ড কিংবা গণপিটুনির দাবি: হাত ধুয়ে ফেলার রাজনৈতিক চেষ্টা

ধর্ষকের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আদালতে যাওয়ার পথে ধর্ষিতার ওপর আক্রমণ তো কেবল একটা অপরাধ নয়। সমগ্র নারীজাতির প্রতি একটা বার্তা। আমরা বুঝতে পারছি, রাষ্ট্র নির্যাতিতাকে রক্ষা করতে পারছে না। আমাদের শ্রেণিবিভক্ত সমাজ, যেখানে সামাজিক অসাম্য এক ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে, সেই সমাজে আইনের শাসন কোথায়? সংবিধানে তো মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আম্বেদকরের মূর্তিতে মাল্যদানের ঘটা কমেনি। কিন্তু মানবাধিকার-সচেতন সভ্যতার মৌলিক নীতিগুলির কী দুরবস্থা, তাও তো দেখতে পাচ্ছি।

এর পাশাপাশি আছে পুরুষতন্ত্রের ঔদ্ধত্য। তবে এখানে আজ এটাও খুব জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন, ধর্ষকদের শাস্তিবিধানকে 'জেন্ডার ইস্যু' হিসাবেও দেখা উচিত নয়। তাতে লিঙ্গ বৈষম্য এ দেশে, এ সমাজে, আরও বাড়বে। আমি একজন পুরুষ। কিন্তু এক্ষেত্রে ধর্ষণের মত এক জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তিপ্রদানের পক্ষে। কেবল নারীর অধিকার নয়, প্রতি নাগরিকের মর্যাদার সঙ্গে বাঁচবার অধিকার।

পশ্চিমবঙ্গে মধ্যমগ্রামের সেই কিশোরীর কথা মনে পড়ছে, যে পুলিশের কাছে যখন অভিযোগ জানাতে যায়, তখন পুনরায় তাকে গণধর্ষণ করা হয়। এরপর আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার আগেই ধর্ষণে অভিযুক্তরা তার বাড়িতে ঢুকে তাকেই অগ্নিদগ্ধ করে মারে। সেটা ছিল ২০১৪ সাল। এরপর এই পাঁচ বছরে আরও কতজন শুধু বাংলা নয়, গোটা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, আর কতজন বিচারের বাণী পেয়েছেন, তার প্রকৃত হিসাব কি ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট থেকে পাওয়া যেতে পারে?

আর একটা কথাও বলা প্রয়োজন। রাজনৈতিক ব্যবস্থা যখন দুর্বল হয়ে যায়, এভাবে সেই ব্যবস্থার অবক্ষয় হয়, তখন বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। বিপ্লবের কাণ্ডারীদের যখন আর দেখতে পাওয়া যায় না, বিপ্লব হয়ে যায় প্রতি-বিপ্লব। ঠিক তখন সমাজে ভিড়তন্ত্র দেখা যায়। এই যে মাঝেমাঝে আমরা খবরের কাগজে পড়তাম, ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে এক ব্যক্তির মৃত্যু। এই যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া, সেও কিন্তু এক ভয়ঙ্কর সমস্যা।

হায়দরাবাদের এনকাউন্টারের পর ইন্দোরে আদালতের বাইরে অভিযুক্ত ধর্ষকদের উপর চড়াও হয়েছে আমজনতা। আওয়াজ উঠেছে, ধর ধর, মার মার। এও এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি। নির্ভয়ার মা আশা দেবী প্রশ্ন তুললেন, তেলেঙ্গানা পারল, তাহলে দিল্লি পুলিশ কেন পারেনি? আবার দিল্লি পুলিশ মানে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, নাকি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক? ঘটনাটি ঘটে সাত বছর আগে। এখন প্রশ্ন, তবে তো এটা নরেন্দ্র মোদী সরকারের দায় নয়। দায় ছিল মনমোহন সিংয়ের।

এ ধরণের বিতর্ক শুনলেও মন বিষাদগ্রস্ত হয়ে যায়। ধর্ষণ হলো ধর্ষণ। এক জঘন্য সামাজিক অপরাধ। এটা মোদী সরকারের দায় না মমতার নাকি কংগ্রেসের এই ক্ষুদ্র স্বার্থের উর্দ্ধে ওঠা বোধহয় আজ সবচেয়ে বেশি জরুরি।

দু-একটা দৃষ্টান্তমূলক এনকাউন্টারে কি এদেশের ধর্ষকরা সত্যি সত্যি ভয় পাবে? তার জন্য কি আমরা এ ধরনের এনকাউন্টারকে সমর্থন করতে প্রস্তুত?

আরও পড়ুন, নারীর ‘শত্রু’ যখন নারীই, ভবিতব্য অসম্মানই

তেলেঙ্গানা কাণ্ডে নাগরিক মনোভাব কার্যত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। হয়তো এই বিতর্কও গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো। যখন রাজীব গান্ধীর হত্যাকারী এলটিটিই জঙ্গি মহিলার মৃত্যুদণ্ড মকুবের আর্জি রাষ্ট্রপতির কাছে জানান স্বয়ং সোনিয়া গান্ধী, তখন তিনি যে উদারতা দেখান, সেই সময় তা উচিত ছিল, না ছিল না, তা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে।

ধর্ষণকারীদের নির্মম শাস্তি আমরা চাই, তবে দেশে আইনের শাসনের বদলে রাষ্ট্রতন্ত্র, বা আমজনতাই যদি নিজেদের হাতে আইন তুলে নিতে বাধ্য হন, তবে সে পরিস্থিতিও কাম্য বলে মনে হয় না।

Delhi Theke Bolchi
Advertisment