বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী ঊর্মিমালা বসুকে 'যৌনদাসী' বলার মধ্য দিয়ে হৈ হৈ করে শুরু হয়ে গেল বাঙালির মাতৃপক্ষ উদযাপন। তার আগে পরে অবশ্য বাঙালি পুরুষকে অর্ধোলঙ্গ অবস্থায় গঙ্গার ঘাটে তর্পণরত দেখা গেছে। সেখানেও নিয়ম, পিতাস্বর্গ আগে গত হয়ে থাকলে তবেই মা জননীর প্রেতযোনির জন্য কোশাকুশি বাহিত জলধারা সন্তানের দ্বারা প্রেরিত হবে। আর মা গত, বাবা জীবিত, এই অবস্থা হলে মায়ের আত্মাকে সন্তানের উৎসর্গ করা জলধারায় তৃষ্ণা মেটানোর জন্য স্বামীর মৃত্যু অবধি অপেক্ষা করতে হবে। এই অর্থহীন অপমানজনক আচার জেনেশুনে পালন করা হাজার হাজার লোককে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, বরিষ্ঠ ঊর্মিমালাকে এই কুৎসিত গালি দেওয়ার নিন্দা তাঁরা করেন কিনা, আমি নিশ্চিত নানা তানানানা'র মধ্যে এটাও থাকবে, যে যাদবপুরের ছেলেমেয়েরা গাঁজা খায়। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে!
নারীবিদ্বেষের ক্ষেত্রে অন্যান্য ভারতীয়দের তুলনায় বাঙালি একটু বেশিই ছুপা রুস্তম। তাই সরাসরি সমর্থন বা প্রতিবাদে না গিয়ে কেউ কেউ বলছেন, বাচিক শিল্পী তো শিল্প নিয়ে থাকলেই পারেন। সব ব্যাপারে ফোড়ন কাটার দরকার কী! যেন শিল্পজগত সমাজ, রাজনীতি, মানুষ বর্জিত কোন গজদন্ত মিনার। সব শিল্পীরা সেখানে বসে শাহজাহান স্টাইলে গোলাপ শুঁকবেন এবং নীচের পৃথিবীর মল্লযুদ্ধ, হনন, পরিবেশ ধ্বংস, নারী নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় অত্যাচার, ইত্যাদি যাবতীয় জ্বলন্ত সমস্যা থেকে চোখ তুলে শারদীয় মেঘের ফাঁকে আকাশের শোভা নিরীক্ষণ করবেন।
আরও পড়ুন: যাদবপুরে বাবুল সুপ্রিয় ও নতুন বাম নেতার সন্ধান
অথচ যাদবপুরে বহিরাগতদের তাণ্ডবের বিরুদ্ধে ঊর্মিমালার প্রতিক্রিয়া ছিল একজন সচেতন প্রাক্তনী হিসেবে। তিনি বলেছিলেন, যাঁকে কেন্দ্র করে এই অনর্থ, সেই বাবুল সুপ্রিয়র ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি প্রাক্তনী, তার ছাত্রছাত্রীরা অত্যন্ত কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে থাকা এই দেশে আজও যে প্রতিবাদের স্পর্ধা রাখে, এইজন্য আরো অনেকের মতো তিনিও গর্বিত। এই অনুভব প্রকাশ করাকে তিনি সঙ্গতভাবেই তাঁর অধিকার বলে মনে করেন।
এই মতের অনুসারী অনেক স্বক্ষেত্রে উজ্জ্বল পুরুষও একথা বলেছেন বা লিখেছেন। তাঁদের কাউকে যৌনতার অনুষঙ্গ মিশিয়ে বানানো মিমে কুৎসিত আক্রমণ করা হয়েছে, এরকমটা চোখে পড়েনি। তাঁদের বক্তব্যের রাজনৈতিক মোকাবিলা করা হয়েছে বা কটু গালিগালাজ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অপমান করা হয়েছে, কিন্তু ভেবেচিন্তে অশালীন অসম্মানের নোংরা কাদার বালতি উপুড় করে দেওয়া হয় নি। তাহলে ঊর্মিমালা বসুর অধিক দোষের কথা কি এই যে তিনি একজন নারী?
যাদবপুরের প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যারা, সেই রাজনৈতিক দলটির রেকর্ড ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যাবে, এই আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়। না, যাদবপুর ললনারা কী ব্যবসা করে তা জানতে চেয়ে মহামান্য ঘোষমশাইয়ের সোনাবাঁধানো উক্তিটিই শুধু আমি মনে করিয়ে দিতে চাইছি না। এসব তো অতি ফালতু উক্তি।
আমি মনে করিয়ে দিতে চাইছি দিলীপ, সায়ন্তন, বাবুলের কুলগুরুর কথা, যাঁর বিবেচনায় চূড়ান্ত নারীলাঞ্ছনা এবং জঘন্যতম অপরাধ ধর্ষণ রাজনৈতিক 'পাওয়ার গেম'-এর একটি ন্যায্য হাতিয়ার। 'Six Glorious Epochs of Indian History'-তে এই বীরশ্রেষ্ঠ সাভারকর বিস্তারিত দেখিয়েছেন, কেন আলাদা ধর্মের নারীদের ধর্ষণ করাই জায়েজ। আগে থেকে হিন্দুরা যদি এই পথে চলত তাহলে আজ সমগ্র হিন্দুজাতির এই দুর্দশা হতো না। তার মানে সমস্ত অঘটন অধঃপতনের কারণ বেজাতের নারী, আর স্বর্গসমান উচ্চতা উন্নতির একমাত্র উপায় সেই নারীর চূড়ান্ত শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনা।
আরও পড়ুন: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন ও শিক্ষকরা
আমি আরও মনে করাতে চাইছি যে যৌনদাসীর সংজ্ঞা হলো সেই দাসত্ব, যাতে নিজের শরীর-মন অন্যের আদেশে চলে। নিজের যৌনতাও নিজের বশে নয়। না থাকে চলাফেরার স্বাধীনতা, না আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। কাউকে জোর করে এই অবস্থায় রেখে দেওয়া ভয়ানক অপরাধ, দেশীয় হোক বা আন্তর্জাতিক আইনে। আর সেই অপরাধে পৃথিবীর মধ্যে এক নম্বরে আমার দেশ। কারণ যৌনদাসত্বের পহেলা নম্বর প্রকাশ 'হিউম্যান ট্র্যাফিকিং'-এ প্রথম হওয়ার শিরোপা ভারতের। অবিশ্বাস্য লাগলেও যুদ্ধদীর্ণ আফগানিস্তান এবং সিরিয়া আছে যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে। আরও কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য এই যে যুগ্মভাবে তৃতীয় পুরস্কারের দাবিদার আমেরিকা। এই তথ্য আবার কোনো 'কামপন্থী'র দেওয়া নয়, পৃথিবীখ্যাত টমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন ৫৫০ জন নারীদের ইস্যু নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞের সাহায্যে এই র্যাংকিং জানিয়েছে।
আমার মনে করিয়ে দেওয়ার তালিকায় রাখতে চাইছি এই তথ্যও যে এই সেদিন হিন্দুত্ববাদীদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে ১০০ জনের বেশি অন্যধর্মে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ মানুষের নাম প্রকাশ করা হয়েছিল এবং নারীপুরুষ নির্বিশেষে তাঁদের নির্যাতন করবার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছিল।
প্রত্যেক ঘন্টায় চারটি করে ধর্ষণের দেশ এই ভারতে মেয়েদের থাকতে হয় পিতৃতন্ত্রের অভিভাবকত্বে, রক্ষক যেখানে ভক্ষক। স্বাভাবিক, বয়স, সম্মান, মাতৃত্ব - কোনকিছুই বিচার্য হবে না যদি নারীকে অপমান করার ইচ্ছা প্রবল হয়। যে দেশ নাকি দ্রুততম অর্থনৈতিক বিকাশের এবং স্পেস টেকনোলজিতে পুরোধার সম্মানের যোগ্য বলে মনে করে নিজেকে, সে দেশে মহিলাদের হেনস্থা করবার এই অত্যুৎসাহ এবং বাস্তবে অহরহ ঘটে যাওয়া নারীলাঞ্ছনার বৈপরীত্যকে কিভাবে মেলানো যায় জানি না।
মনে হয়, প্রতিবাদই একমাত্র রাস্তা। শুধু ঊর্মিমালা নন, যাদবপুরকাণ্ডে অন্তর্জালে একাধিক নারীকে অপমান করবার তীব্র প্রতিবাদ হোক। সব রাজনৈতিক দলগুলিই সতর্ক থাকুক, মেয়েরা তাঁদের অপমান মেনে নেবেন না।