/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/03/pesticide.jpg)
ড্রোন ব্যবহার করে কীটনাশক ছড়ানো হচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশে (ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)
মঙ্গলবার গড়িয়া থেকে মহুয়া ফোনে বলল, ওদের পাড়ার আমগাছগুলোর পাতায় একটা তেলতেলে ভাব দেখা যাচ্ছে। মানে চোখে পড়ার মত বেশি করেই দেখা যাচ্ছে। ওদিকের আরো কয়েকটা এলাকাতেও এটা হয়েছে। কী কারণ হতে পারে? আমার বুদ্ধিবিবেচনার বাইরের প্রশ্ন। পরদিন সকালে পুরোন বন্ধু অধ্যাপককে নিবেদন করলাম। এ বাবদে তার বিষয়গত জ্ঞান ছাড়াও প্রেমপ্রীতি আছে।
করোনার ভালোমন্দ, কার কার পৌষমাস?
সে দূর থেকেই হাসল। বলল, তার কাছে আরেকটা খবরও আছে- আমপাতার গায়ে নাকি আরবি ভাষায় কীসব লেখা দেখা যাচ্ছে, নিশ্চয়ই কোরাণের সুরা। অবধারিত ভাবেই মনে পড়েছে ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’ এর শুরুটা- গাছের পাতায় যেখানে গানহিবাবার নাম লেখা দেখা যাচ্ছিল। অধ্যাপক তাকে জিগেস করেছে,
-আপনি কি আরবি জানেন?
-না
-তাহলে কেন মনে হল যে আরবি? ব্রাহ্মীলিপিও তো হতে পারে?
এই ধাঁধার মুখে ফেলে দিয়ে পুলক বলল অন্যকথা। বলল,
- সম্ভবত এখানে অপরিচিত কোন পতঙ্গ ওই পাতাগুলোয় ডিম পেড়েছে, যেগুলো গোল নয়। তার লাইনগুলোই আরবি বা ব্রাহ্মী হয়ে উঠেছে। সেই ডিমগুলো থেকে কোনো তরল বেরুচ্ছে। কিংবা অনেকসময় গাছ নিজের ডিফেন্সে কিছু মেকানিজম তৈরি...ইত্যাদি।
পোকাপতঙ্গ থাকতেই পারে, কবে না থাকে! মানুষ এ পৃথিবীতে এসেছে তাদের অনেক পরে, তারা বর্তমান থাকা অবস্থাতেই। অথচ একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে কীভাবে যেন এই সহবাসীদের সম্পর্কে কিছু কিছু মানুষের চিত্তে বিরাগ, বিরাগ থেকে ভয় জন্ম নিল। অতি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ভয়, আহ্লাদ, ঘৃণা, পছন্দ বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করার কৃৎকৌশলের আরেক নাম আধুনিকতা। অন্যরকম পোকা পাখি গাছ- সকলকে সরিয়ে পৃথিবীকে একেবারে নিজেদের ছকমত সাজিয়ে নেবার চেষ্টা বেড়েছে। বাড়তে বাড়তে ঘৃণা ও বিরাগের বাজারমূল্য তৈরি হয়েছে। নিধনযজ্ঞের হাতিয়ারগুলি ‘আবিষ্কারে’র সম্মান পেয়েছে। ‘আবিষ্কার’ হয়েছে কীটনাশক, আগাছানাশক। ভিন্ন সংস্কৃতিনাশকও। কিন্তু সেকথা থাক।আমরা কথা বলছিলাম গাছে পোকার বাসা সম্পর্কে।
অশ্লীলতার দায় বড় দায়, বিশেষত এ রাজ্যে
‘১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যে সবুজ রঙের একটি বিশেষ গুবরে পোকা দেখা যায়। সেদেশে ‘জাপানি বীটল’ নামে অভিহিত এই পতঙ্গটি আমাদের কাছে পরিচিত কাচপোকা নামে। এই পোকাগুলো যে খুব ক্ষতিকারক এমন কোন প্রমাণ তখনও পাওয়া যায় নি কিন্তু এরা ছিল ঐ অঞ্চলে অপরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিদফতর ও ইলিনয় রাজ্য কৃষিদফতর মিলে সিদ্ধান্ত নেয় ইলিনয়কে এই পতঙ্গমুক্ত করার। ’৫৪ সালে প্রথমবার আকাশ থেকে ১৪০০ একর জমিতে ডিয়েলড্রিন বর্ষণ করে এই নির্মূলীকরণের কাজ শুরু হয়।’ বলছেন রাচেল কারসন, কীটনাশক প্রয়োগে প্রাকৃতিক শৃঙ্খলাধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রথম স্বর। কারসন বলছেন, ‘পরের বছর ১৯৫৫ সালে আরো ২৬০০ একর জমি এই বিষবর্ষণের আওতায় আসে ও ধরে নেওয়া হয় যে জাপানি গুবরে নির্মূল হয়েছে। কিন্তু প্রতি বছর নতুন নতুন এলাকা থেকে এই কাজের ডাক আসতে থাকে, ১৯৬১ সাল শেষ হবার আগেই কীটনাশকগ্রস্ত জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩,১০০০ একর।’ এরপর পাতার পর পাতা জুড়ে রাচেল বিবরণ দিয়ে চলেন সেই কীটনাশকের বিষে মরা পোকা, সেই পোকা খেয়ে মরে যাওয়া ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, আকাশ থেকে ঘাসের ওপরে পড়া বিষে মৃত হাজার হাজার গৃহপালিত পশু, ছটফট করে মরে পড়ে থাকা সংখ্যাতীত কাঠবেড়ালি আর ভেড়াদের। শতকরা নব্বইভাগ বেড়ালের মরে যাওয়ার কথা। অথচ অন্যদিকে, রাচেল দেখান দেশের ন্যাচারাল হিস্ট্রি সার্ভের বিজ্ঞানীরা যখন প্রাণী ও পতঙ্গজগতের ওপর এই কীটনাশকের প্রভাব নিয়ে ফিল্ড সার্ভে করতে চান, তার জন্য সরকারি দফতর থেকে টাকা আসে মোট ৬০০০ ডলার, দুবছরে। যদিও ‘পোকা মারা’র খাতে ফেডারেল সরকারই দিয়েছিলেন তিনলক্ষ পঁচাত্তর হাজার ডলার। আরো বেশি এসেছিল রাজ্য সরকারের কাছ থেকে। ঠিক জানি না কতো আর্থিক লাভ করেছিল কীটনাশক প্রস্তুতকারী সংস্থা বা হেলিকপ্টার ভাড়া দেওয়া সংস্থাগুলো। তবে এটুকু জানা যাচ্ছে যে এই কর্মকাণ্ডের ফলে সেই ‘জাপানি গুবরে’ লোপ পায়নি। অল্পদিনের মধ্যেই আবার ফিরে আসে।
রাচেলের আপ্রাণ লড়াইয়ের ফলে (সত্যিই আপ্রান। ১৯৬৪ সালে ‘নীরব বসন্ত’ প্রকাশিত হবার পর যখন বিজ্ঞানীদের জমায়েতে বিবৃতি দিচ্ছেন রাচেল, তখন ক্যান্সারে কেমোথেরাপি চলছে তাঁর)মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিডিটি জাতীয় কীটনাশকের প্রয়োগ বন্ধ হয়। এ জয় ছিল সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা রাচেলের অসংখ্য বন্ধু ও সমর্থক - মার্কিনদেশের পক্ষীতত্ত্ববিদ থেকে পাখি দেখতে ভালোবাসা গৃহিণী থেকে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পর্যন্ত সকলের। যদিও সেই দেশের অতিবৃহৎ রাসায়নিক নির্মাণকারী বহুজাতিক সংস্থাগুলো পরবর্তী কালে এমন সব ‘কীটনাশক’ থেকে ‘আগাছানাশক’ বানিয়েছে যা কিনা এক একটা দেশের জঙ্গল থেকে দুব্বোঘাস পর্যন্ত মুছে ফেলতে পারে। বানাতেই পারে। যাদের পেশা বিষ ‘আবিষ্কার’ করা, তারা সেই ব্যবসা করবে তাতে আশ্চর্যের কী। কিন্তু যেটা অবাক হয়ে দেখবার যে কীভাবে সেই দেশগুলোর এক বড়োসংখ্যায় মানুষ, শিক্ষিত মানুষেরা সেই প্রচার শুনে বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে যান।
দিল্লির অন্ধকার: আমাদের শাসকরা নির্মমতা, বিভাজন, ভয় আর হিংসা ভরা রাষ্ট্র চান
অন্ধ বিশ্বাস উৎপাদন করা বোধহয় ক্ষমতার হাতের সূক্ষ্মতম অস্ত্র। একবার যদি এই শক্তি পাওয়া যায়, তাহলে বাস্তব কিংবা ধারণা- যে কোনো ক্ষেত্রে যে কোন জিনিসকে ‘ভয়ের কারণ, সুতরাং ধ্বংসের যোগ্য’ বলে দাগিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট। তারপর আর সম্ভব-অসম্ভবের বিচার ওঠে না। একসময়ে যারা বিচার করতে যাবে, ‘ভয়ের কারণ...’বলে চিহ্নিত হতে পারে তারাও। অথচ প্রাকৃতিকভাবে মানুষ তার গুরুমস্তিষ্ক, মানে বিচারক্ষমতার অধিকারী।
বিচার করে দেখার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে রাখা ভালো, বেশি দেরি হয়ে যাবার আগে...
(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে