হায়দরাবাদ ধর্ষণকাণ্ড থেকে উদ্ভূত দেশজোড়া আলোড়ন, এবং শুক্রবার সকালে ধর্ষণে অভিযুক্ত চারজনেরই মৃত্যুর খবরাখবরের ভিড়ে চোখে পড়ল একটা ছোট্ট তথ্য, যা হয়তো নজর এড়িয়ে যাবে অনেকেরই। অথচ এই তথ্যের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আমাদের সমাজে ব্যাপক হারে নারী নির্যাতন এবং নারীবিরোধী হিংসার বীজ।
ব্যাপারটা হলো, ভারতে বিগত আন্দাজ ৩০ বছর ধরে স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের উদ্যোগে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (NFHS) শীর্ষক একটি সমীক্ষা হয়ে আসছে। শেষবার হয় ২০১৫-১৬ সালে, পরের সমীক্ষার ফলাফল সম্ভবত আগামী জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হবে।
তো সে যাই হোক, ২০১৫-১৬ সালে এই সমীক্ষার আওতায় আসে প্রায় ৬ লক্ষ ৩০ হাজার পরিবার। এবং ফলাফল বলছে, সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মহিলাই মনে করেন, তাঁরা যদি ঘরকন্না, বা সন্তান, বা শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের, 'অবহেলা' বা 'অপমান' করেন, তবে তাঁদের স্বামীদের পূর্ণ অধিকার রয়েছে তাঁদের গায়ে হাত তোলার। এবং এই গার্হস্থ্য হিংসা বা 'ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স' সবচেয়ে বেশি মাত্রায় - ৫৪.৮ শতাংশ - সমর্থন করেন ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মহিলারা।
এই পরিসংখ্যান আসলে কী বলছে, একটু ভেবে দেখুন। তলিয়ে ভাবুন।
যে দেশের বিপুল সংখ্যক মহিলাই মনে করেন যে তাঁদের কোনও ভুলত্রুটি হলে স্বামীর হাতে মার খাওয়াটা যুক্তিসঙ্গত, সে দেশে মহিলাদের সম্মানরক্ষা হবে কী করে? আরও বেশি করে ভাবুন ওই ৪০ থেকে ৪৯ বয়সী মহিলাদের কথা, যাঁরা এই মুহূর্তে হয়তো ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী পুরুষদের মা। কী শিক্ষা দিচ্ছেন তাঁরা তাঁদের পুরুষ সন্তানদের? এইসব পুরুষ কি কোনোদিনই নারীদের সম্মান করতে শিখবেন? বা এইসব মহিলারাই কি পরবর্তীকালে তাঁদের পুত্রদের আস্কারা দেবেন না, স্ত্রীকে দু'ঘা বসিয়ে দিতে?
নারীবিরোধী হিংসার কথা সবিস্তারে এই কারণেই বলা যে, ধর্ষণও কিন্তু হিংসারই আরেক রূপ। এখানে যৌনতার তাগিদ যত না আছে, প্রায় সমপরিমাণ আছে উগ্র শারীরিক ক্ষমতা প্রদর্শনের তাগিদ। একজন সাধারণ পুরুষের তুলনায় একজন সাধারণ নারী শারীরিকভাবে দুর্বল হবেন। এটা প্রকৃতির নিয়ম। কাজেই অন্য কোনওভাবে টক্কর দিতে না পারলেও, শারীরিক নির্যাতনের পথ তো সবসময় খোলা। এবং এই আপেক্ষিক শারীরিক দুর্বলতাকে ভিত হিসেবে ব্যবহার করে অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীদের 'পিছিয়ে রাখা'র প্রচেষ্টা আগাগোড়াই হয়ে এসেছে, হবেও।
হায়দরাবাদ ধর্ষণকাণ্ডের কথাই ধরুন। যে মহিলা ধর্ষিত এবং নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন, তিনি বৌদ্ধিক, আর্থিক, বা সামাজিকভাবে তাঁর ধর্ষকদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। অতএব তাঁকে 'শিক্ষা দেওয়ার' একমাত্র উপায় তাঁর ওপর শারীরিক বলপ্রয়োগ করা। কথাটা শুনতে অবাস্তব মনে হলেও, ভেবে দেখলে বুঝবেন এর সারবত্তা। ইতিহাসও সাক্ষী, যুগ যুগ ধরে বিজয়ী সেনাবাহিনী, সে যে দেশেরই হোক, পরাজিত দেশের নারীদের ধর্ষণ করে তাদের ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে এসেছে। আজও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সেই প্রথা বজায় রয়েছে অমলিন। এক কথায়, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের রূপান্তর।
এই মানসিকতার অজস্র উদাহরণ পাবেন সোশ্যাল মিডিয়াতেও। দেখবেন, কোনোরকম বচসা বা বাগবিতণ্ডার ক্ষেত্রে কোনও মহিলাকে 'শায়েস্তা' করার প্রকৃষ্টতম উপায় হয়ে দাঁড়ায় শারীরিক নির্যাতন বা সরাসরি ধর্ষণের প্রসঙ্গ তুলে আনা। কখনও কখনও কদর্য যৌন হুমকিও।
কিন্তু দুর্বল নিজেও যদি ভাবতে শুরু করে যে, সবলের অধিকার রয়েছে তার ওপর অত্যাচার করার, তবে তো লড়াইটাই শেষ হয়ে যায়। যে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় মহিলা মনে করেন যে তাঁদের ওপর শারীরিক অত্যাচার ন্যায়সঙ্গত, তাঁরা কি কোনোদিনও তাঁদের ছেলেদের শেখাবেন যে শুধু মহিলা কেন, কারোর সঙ্গেই স্রেফ গায়ের জোরের ভিত্তিতে 'জেতা' যায় না?
যে কোনও কিছুই শেখা যতটা কষ্টসাধ্য, শেখানোও ততটাই। সুতরাং সম্মান করতে শেখানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু এই কষ্টটা স্বীকার না করলে আমাদের সমাজ ধর্ষকাম থেকেই যাবে। এবং এটা শেখানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আগে মহিলাদের বুঝতে হবে, গায়ে হাত তোলার মধ্যে কোনও ন্যায় নেই, এই হিংসা মুখ বুজে সহ্য করা সহনশীলতার পরিচয় নয়, বা একে স্বাভাবিক ভাবাটা নিজেরই অস্বাভাবিকতার লক্ষণ।
ধর্ষণের বা অন্য কোনও হিংসার ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দোষীদের যত কঠিন শাস্তিই দেওয়া হোক, তাতে কিন্তু অপরাধ কমে না। মুশকিল এটাই, ভয়ের একটা নির্দিষ্ট আয়ু আছে। ভয় দেখিয়ে কাউকেই বেশিদিন দমিয়ে রাখা যায় না। ভয় পেতে পেতে একসময় ভয় শেষ হয়ে যায়। বিশেষ করে ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশে, যেখানে অপরাধ করা মানেই ধরা পড়া নয়। বা ধরা পড়লেও শাস্তি পাওয়া নয়। বরং পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশি।
সবশেষে, মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসাকে স্রেফ 'অপরাধের' দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে ভুল করবেন। অপরাধের শাস্তি হয়, তার বিরুদ্ধে আইন আনা যায়। কিন্তু মানসিকতার কি শাস্তি হয়? নাকি আইন করে বন্ধ করা যায়? 'কেন সৌদি আরবে তো আকছার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, হাত কেটে ফেলা হয়, তাই সেখানে অপরাধ হয় না' বলে না বুঝেই যাঁরা হৈহৈ করেন, তাঁদের অনুরোধ করব, একটু গুগল করে দেখুন, কী ধরনের অমানুষিক অপরাধের শিকার হন সেদেশের মহিলারা, বাচ্চা মেয়েরাও। ওই যে বললাম, ভয় চিরকাল থাকে না। মজ্জাগত প্রবৃত্তি অনেক ক্ষেত্রেই তাকে ছাপিয়ে যায়।
অতএব দিনের শেষে সেই সামাজিক বা পারিবারিক প্রভাবই ভরসা। সেখানে মহিলাদের অগ্রণী ভূমিকা থাকাটা যে অতি জরুরি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে কি?