তিনটে প্রশ্ন। তিনটের উত্তরই এক।
শচীন তেন্ডুলকরের একশোটা আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির এভারেস্টে পা রাখা বিশ্বক্রিকেটে কার পক্ষে সম্ভব? কার আবার? বিরাট কোহলি। যাঁর কেরিয়ারে এখন মধ্যগগন এবং যিনি এখনই সত্তরটা আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির মালিক।
টেস্ট, ওয়ান-ডে এবং টি-টোয়েন্টি, তিনটে ফরম্যাটেই পঞ্চাশের উপর ব্যাটিং অ্যাভারেজ বিশ্বে একমাত্র কার আছে? বিরাট কোহলি, আবার কে! বিশ্বের সর্বকালীন 'গ্রেট' ব্যাটসম্যানদের কুলীন দুনিয়ায় যাঁর স্থান এখনই পাকাপাকি বরাদ্দ হয়ে গেছে।
ক্রিকেটমাঠে আবেগ এবং আগ্রাসনের যুগলবন্দিতে কোন তারকা বাকিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে? কেন, বিরাট কোহলি। উচ্ছ্বাস বা উৎকণ্ঠা, আনন্দ বা আশঙ্কা, কোনোটাই যিনি মাঠে সেভাবে লুকোতে চেষ্টা করেন না শরীরী ভাষায়।
আরও পড়ুন: অফ ফর্মের বিরাটের পাশে ইনজামাম, কপিল বলছেন ‘চোখের সমস্যা’
তিনটে হলো। চার নম্বর প্রশ্নটাও তাহলে করে ফেলি? বিশ্বক্রিকেটের কোন মহাতারকার এবার বোঝার সময় এসেছে, আত্মবিশ্বাস মানেই ঔদ্ধত্য নয়, আর আগ্রাসন মানেই নয় অসভ্যতা? এটারও একই উত্তর। বিরাট কোহলি। নিউজল্যান্ডের সঙ্গে সদ্য শেষ-হওয়া টেস্ট সিরিজের শেষ দিনে যাঁর বেয়াড়া আচার-আচরণ এই মুহূর্তে ক্রিকেট দুনিয়ায় মুখ্য আলোচ্য।
কেন আলোচ্য, আমরা জানি। বিরাট ঠিক কী করেছেন আমরা সবাই হয় টিভিতে দেখেছি, অথবা কাগজে পড়েছি। সংক্ষেপে তবু একটু ঝালিয়ে নিই।
জেতার জন্য প্রয়োজনীয় ১৩২ রান দ্বিতীয় ইনিংসে অনায়াসে তাড়া করছিলেন দুই কিউয়ি ওপেনার। নিজেদের টিম জিতছে, দর্শকরা আনন্দের হইহুল্লোড় করছিলেন। একশো পেরিয়ে প্রথম উইকেট পড়তেই কোহলি আচমকা তেড়েফুঁড়ে ওঠেন। গ্যালারির দিকে আঙ্গুল তুলে যা বলেন, তার ভদ্রতম বঙ্গানুবাদ হল, "ওরে ব্যাটারা, মুখ বন্ধ কর এবার।” সঙ্গে একটা চার অক্ষরের শব্দও ছিল, যেটা লেখার অযোগ্য। লিখছিও না। পাঠক বুদ্ধিমান, ঠিক বুঝে নেবেন।
এখানেই শেষ হলে তবু না হয় কোনোমতে উপেক্ষা করা যেত। বিরাট-বিক্রমের আরও বাকি ছিল। কিউয়ি অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন যখন বুমরার বলে আউট হলেন, স্লিপ থেকে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো বুমরার দিকে ছুটে গেলেন বিরাট। এবং প্যাভিলিয়নমুখী উইলিয়ামসনের সামনে গিয়ে বিকট-বিশ্রী মুখভঙ্গি করে বিদায়-সম্ভাষণ জানালেন।
আরও আছে। নিউজিল্যান্ড যখন জয়ের চৌকাঠে পা রেখে ফেলেছে প্রায়, তখন স্টাম্প মাইকে স্পষ্ট ধরা পড়ল বিরাট-বচন। সতীর্থদের বলছেন, "ইন লোগো কো ইন্ডিয়া আনে দো, তব দেখা দুঙ্গা।” মনে রাখুন, কোহলি এতসব কাণ্ড ঘটাচ্ছেন খেলার এমন একটা পর্যায়ে, যখন ভারতের হার স্রেফ সময়ের অপেক্ষা, ১৮ বছর পরে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্টে ভারতের 'হোয়াইটওয়াশ' ঘটতে চলেছে।
আরও পড়ুন: সিরিজ হেরে হতাশ বিরাট দুষলেন ব্যাটিংকেই
আর সিরিজে ভারতের ০-২ শেষকৃত্য ঘটে যাওয়ার পর? সাংবাদিক সম্মেলনে শুরুর দিকে বিরাটকে যথেষ্ট পরিণতমনস্ক শোনাচ্ছিল, "ভুলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকলে চলবে না আমাদের। ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কিন্তু এই হার নিয়ে বেশিদিন মুহ্যমান হয়ে থাকলে ভুলগুলো শুধরে সামনের দিকে এগোতে পারবো না।”
তাল কাটল এক কিউয়ি সাংবাদিকের প্রশ্নে, "মিস্টার কোহলি, উইলিয়ামসনের আউট হওয়ার পর যে ভাবভঙ্গি আপনি করলেন, তা কি ক্রিকেটের স্পিরিটের পরিপন্থী বলে মনে হয় না আপনার?" ব্যস, আগুনে যেন কয়েক মণ ঘি পড়ল! "মাঠে এরকম হতেই পারে আবেগের বশে, আমি আর কেন ওটা নিজেরা কথা বলে মিটিয়ে নেব" জাতীয় উত্তর দিয়ে কোথায় পাশ কাটিয়ে যাবেন, তা না, দৃশ্যতই ক্ষিপ্ত কোহলি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন রাগত স্বরে, "আপনার কী মনে হয়?" হতচকিত ওই সাংবাদিক বললেন, "আরে প্রশ্নটা তো আমি আপনাকে করেছি!" কোহলির চোখেমুখে তখন ঔদ্ধত্য ঠিকরোচ্ছে, "আমি উত্তরটা আপনার থেকেই চাইছি। ঘটনার অর্ধেকটা জেনে বা পুরোটা না জেনে আপনি এখানে এ ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন না। ম্যাচ রেফারির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এটা কোন ইস্যুই নয়। থ্যাঙ্ক ইউ।”
প্রিয় বিরাট, কী হচ্ছে এসব? সবাই জানে, আগ্রাসী 'প্যাশন' নিয়ে ক্রিকেটটা খেলেন আপনি। সবাই জানে, আবেগের আস্ফালনও আপনার অনেকটাই বেশি অন্যদের তুলনায়। সবাই জানে, আপনার জেতার খিদে অনন্ত। অন্য যে কোনও চ্যাম্পিয়নের মতোই হারতে ঘৃণা করেন আপনি। সে সব নিয়ে তো কোনও সমস্যা নেই। হারার জন্য কেউ মাঠে নামে না। আজকের পেশাদারি ক্রীড়াদুনিয়ায় আগ্রাসী মনোভাবে যে কোনও মূল্যে জিততে চাওয়ায় তো কোনও অন্যায় নেই। আবেগের প্রকাশভঙ্গিও একের তুলনায় অন্যের আলাদা হতেই পারে। তাতেও কোন চাপ নেই। চাপ আসলে প্রকাশভঙ্গির মাত্রা নিয়ে। আগ্রাসন আর অভব্যতার মধ্যবর্তী 'লাইন অফ কন্ট্রোল' নিয়ে। যে লক্ষনরেখা আপনি দ্বিতীয় টেস্টে একবার নয়, বারবার পেরিয়ে গেলেন 'যা করছি বেশ করছি' ভঙ্গিতে।
নিজের ক্যাপ্টেনসিতে টিম 'হোয়াইটওয়াশ' হওয়ার মুখে। অথচ বিপক্ষ ক্যাপ্টেনের আউট হওয়াতে 'সেলিব্রেশনের' নামে উৎকট অঙ্গভঙ্গি করে লোক হাসাচ্ছি। সাংবাদিকের সঙ্গত প্রশ্নে মেজাজ হারাচ্ছি 'তোর কথার উত্তর দেব না, চুলোয় যা' ভঙ্গিতে। এমন মস্তানোচিত তাচ্ছিল্যে 'ইন্ডিয়া আনে দো দেখ লুঙ্গা' বলছি, যেন অমুক সংঘের ক্যাপ্টেন বেপাড়ার মাঠে তমুক স্পোর্টিংয়ের কাছে ল্যাজেগোবরে হয়ে হতাশা উপুড় করে দিচ্ছে, "আয় না আমাদের মাঠে, দেখাচ্ছি কত ধানে কত চাল। পাড়ার কুত্তা পাড়ায় শের!"
আরও পড়ুন: নিউজিল্যান্ডের হেলায় ভারত বধ, সিরিজ সেরা সাউদি
প্রিয় কোহলি, খুব দরকার আছে এসবের? আপনি তো কোনও রামা-শ্যামা-অগা-বগা নন। আপনি চিরকালীন গ্রেটদের একজন। দেশে হোক বা বিদেশে, বর্তমান প্রজন্মের অগুনতি ক্রিকেট-শিক্ষার্থীদের পরম আরাধ্য রোল মডেল আপনি। কী জানেন, সাধারণ বা ভালো, এমনকি 'খুব ভালো'-দেরও দায় থাকে না নিজের আচরণকে ভব্যতার নিয়ন্ত্রণরেখায় বেঁধে রাখার। আপনার মতো গ্রেটদের সে দায় থাকে। আপনাদের মাথায় রাখতে হয়, আমি যেটা যখন যেভাবে করছি, সেটাকেই সাফল্যের অব্যর্থ 'রেসিপি' হিসাবে ধরে নেবে ভক্তকুল।
এতদিনের ঝলমলে আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের পর, টেস্টে ছয় বছর একশো পঁচিশ কোটির ক্রিকেটপাগল দেশের ক্যাপ্টেন্সি করার পর আপনাকে আর মানায় না ওই পাড়াক্রিকেটের হম্বিতম্বি, বড্ড দৃষ্টিকটু দেখায় ওই দাঁতমুখ খিঁচিয়ে 'হারেরেরে' ভঙ্গিতে তেড়ে যাওয়া। আগ্রাসন থাকুক, থাকুক আবেগও। ওটা স্বভাবজাত আপনার। থাকুক। তবে কালেভদ্রে একটু বিনয়ী হওয়ায় কিন্তু কোনও গ্লানি নেই। গোহারান হারার পরে তো আরওই নেই। দুই টেস্টের সিরিজে চারটে ইনিংসে নিজে মোট ৩৮ রান করার পর তো আরওই নেই।
প্রিয় বিরাট, আবার লিখি, আগ্রাসন মানে অসভ্যতা নয়। আত্মবিশ্বাস মানে ঔদ্ধত্য নয়। এবং সবচেয়ে জরুরি, মেজাজটাই কিন্তু সবসময় আসল রাজা নয়। বিশ্বাস করুন, আপনার হাবভাব দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে জনপ্রিয় গানের লাইন। যা সামান্য পাল্টে নিয়ে লিখতে লোভ হচ্ছে, "এসব তোরে মানাইছে না রে, ইক্কেবারে মানাইছে না রে!"