Advertisment

একটি জলীয় অধিকারের ঘোষণাপত্র

পৃথিবীর সমস্ত সরকারকে অবিলম্বে ঘোষণা করতে হবে নিজেদের সীমানার মধ্যকার মিঠেজলের উৎসসমূহ সার্বজনীন সম্পত্তি এবং এই সেই অধিকার রক্ষার জন্য তাঁরা কী কী কঠোর নিয়মাবলী গঠন ও পালন করছেন, লিখছেন জয়া মিত্র।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Water Pollution

ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

‘জলের সঙ্গে সম্পর্ককে হয়ত খানিকটা মানবিক সম্পর্কের মতো ভাবে বর্ণনা করা যায়। বিশ্ব-বিস্তৃত সমস্ত জল যেন পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা মানবগোষ্ঠির মতো - সার্ব, রাশিয়ান, ভারতীয়, ডাচ, কোটি কোটি চাইনিজ - সক্কলে আছে তার মধ্যে। সবাই অল্পবিস্তর সমস্যাকুল, কেউ জানিনা কী করে সেসব সমস্যার সমাধান করা যাবে। নিজের এলাকার কাছাকাছির কথা ভাবলে যেন কিছুটা পারিবারিকতার মধ্যে মনে হয়। "বড় নদীগুলো যেন মা, একটু হাতের বাইরে। ছোট নদীরা ছোট বোন। দীঘি-সরোবরগুলো মাসতুতো-খুড়তুতো ভাইবোন, আর ছোট পুকুরগুলো তাদের ছেলেপুলে। আর, ইচ্ছেয় হোক কি অনিচ্ছেয়, সুখে কিংবা ব্যধিতে, ঘরের কলটি হলেন সংসারের সঙ্গী/ সঙ্গিনী।" ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় এমনই  অসাধারণ ভাবে জলের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বর্ণনা করছেন মাইকেল পারফিট।

Advertisment

আমরা অবশ্যি সাহেবকে বলতে পারতাম যে কলের জলের ঘরনী ছাড়াও আমাদের ছিল এক কিশোর বয়সের প্রেমিক/প্রেমিকা - সে ঐ পাড়ার কী জনপদের কাছাকাছি ছোট নদী কিংবা দীঘির নিরালা ঘাট। তার সঙ্গে বহু মধুর স্মৃতি লেগে আছে, কিন্তু সাংসারিকতা পরে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে নিত্যদিনের কলের জলের সঙ্গে।

কিন্তু যে প্রসঙ্গে এই অপূর্ব বিশ্লেষণটি পেশ করেছেন প্রতিবেদক, তা ঠিক এমন কৌতুকময় নয়।

আরও পড়ুন, আন্তর্জাতিক জলবায়ু ধর্মঘট আন্দোলন কী ও কেন?

আমাদের আশপাশে আমরা সাম্প্রতিক কালে হঠাৎ শুনতে পাচ্ছি, ব্যবহারযোগ্য মিঠে জল কমে আসার তীব্র সতর্কবার্তা। কখনো তার নির্দিষ্ট বিপদসীমা মাত্র একবছর, কখনো চার বছর, মোটের ওপর খুবই ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে তার নির্দেশ। এবং এই সতর্কবার্তা প্রচার করছে, কোনো পরিবেশবাদী জলসৈনিকদের দল নয়, স্বয়ং দেশের সরকার। অথচ বাস্তবে সেই সরকারি কর্মসূচিতে কোথাও এখনো সেই বিপন্নতাকে আমল দেওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। একই রকমভাবে চলেছে নদী জুড়ে দেওয়া আর বাঁধের পর বাঁধ তৈরির প্রকল্প।

এমনকি অসমের গেরুকামুখ বাঁধ প্রকল্পে বিপন্ন মানুষদের সামনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ঘোষণা করে এসেছেন, "বাঁধ হবেই। দরকারে আর্মি দাঁড় করিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা চলবে।" মুখে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করার কথা বলে চললেও কাজ চলছে ‘বাড়ি বাড়ি কলের জল’ পৌঁছে দেবার। তাতে যে হাজার হাজার মাইল ধাতব/ প্লাস্টিক কল, বিশাল জলাধার নির্মাণ এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের বিকট বাস্তব সমস্যা ছাড়াও অকল্পনীয় পরিমাণ জল পাম্প করে তুলতে হবে, সে কথার উল্লেখ কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

এই একই অবস্থা আরও অনেকগুলো দেশে। এ অবস্থার মধ্যে পৃথিবীর নানা দেশের উদ্বিগ্ন জলকর্মীরা যুক্তভাবে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন 'ওয়াটার ফর পিপল অ্যান্ড নেচার' বলে। ২০০১ সালে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে তাঁদের প্রথম সম্মেলন হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আটশ’ প্রতিনিধি জড়ো হয়েছিলেন সেখানে। এই সম্মেলনের পক্ষ থেকে একটি ঘোষণাপত্র তৈরি হয়েছিল। মড বার্লো এবং জেরেমি রিফকিনের লেখা এই সরল সুন্দর ঘোষণাপত্রে একমত হন উপস্থিত সমস্ত প্রতিনিধিরা। তার একটা বাংলা অনুবাদের চেষ্টা করা গেল।

‘আমরা ঘোষণা করছি যে এই সত্যটি সার্বিক এবং অপরিবর্তনীয় যে,

‘পৃথিবীর সকল মিঠে জলের প্রকৃত মূল্য তার ব্যবহারিক ও বাণিজ্যিক মূল্যের চেয়ে অগ্রগণ্য। সুতরাং সমস্ত রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক সংগঠনকে তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং রক্ষণকারী হতে হবে,

‘পৃথিবীর সমস্ত মিঠে জল পৃথিবীর নিজস্ব, এবং সমস্ত প্রাণীর এতে অধিকার। কাজেই একে নিজস্ব বাণিজ্যিক সম্পত্তি হিসাবে কেনা, বিক্রি করা বা ব্যবসায়িক কাজে লাগানো চলবে না,

‘বিশ্বের সমস্ত মিঠে জল এক সার্বিক উত্তরাধিকার, পাবলিক ট্রাস্ট। এ এক প্রাথমিক মানবাধিকার, সুতরাং এর রক্ষণ এক সম্মেলক দায়িত্ব,

‘এবং

‘যেহেতু বিশ্বের সীমাবদ্ধ মিঠে জলের সঞ্চয় অতি দ্রুত এমনভাবে দূষিত, অন্যপথে চালিত বা (ভূমিগর্ভ থেকে) উত্তোলিত হচ্ছে যে কোটি কোটি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকুল জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জলের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে,

‘যেহেতু বিভিন্ন দেশের সরকার এই উত্তরাধিকারের অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে,

‘বিশ্বের দেশগুলি পৃথিবীর সমস্ত মিঠে জলকে এক সার্বজনীন সম্পদ বলে ঘোষণা করছে, যাকে রক্ষা ও যত্ন করার দায়িত্ব বিশ্বের সমস্ত লোকের, জনগোষ্ঠির, ও নানাস্তরের সরকারি সংগঠন সমূহের। ঘোষণা করতে হবে যে মিঠে জল কখনো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন, বাণিজ্যিক বস্তু হবে না এবং তা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আমদানি রপ্তানি করা চলবে না। ভবিষ্যতেও একে সমস্ত ধরণের আন্তর্জাতিক বা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বা পুঁজি নিয়োগ ক্ষেত্রের বাইরে রাখতে হবে।‘

*মিঠেজল বলতে বোঝানো হচ্ছে অ-লোনা, পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণব্যবস্থার উপযুক্ত যে জল। যার মূল উৎস বৃষ্টি। (অনুবাদক)

এই সম্মেলনে যোগদানকারীদের মধ্যে ভারতের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। কিন্তু সরকারি আইনের মতোই সবচেয়ে সুন্দর চিন্তা বা চেষ্টাও বাস্তবায়িত হয় না, যতক্ষণ সাধারণ চিন্তাশীল, পরিশ্রমী, নিঃস্বার্থ অনেক মানুষ তার সঙ্গে আন্তরিক ভাবে যুক্ত না হন। হয়ত এই নির্দিষ্ট সুন্দর সাংগঠনিক ঘোষণাটি অনেকের কাছ পর্যন্ত পৌঁছয় নি, তবু কিছু কিছু ভালোবাসার উদ্যোগ কিন্তু শুরু হয়েছে। শুনেছি নদীতে স্বাভাবিক বন্যা আসার আগে বন্যার প্রথম জলের ঢুকে পড়াটা অভিজ্ঞ স্নানার্থীরা বুঝতে পারতেন। তারপর জল বাড়ত। পলিমাটি আর জলের প্লাবন নদীকে আবার উজ্জীবিত করে দিত। নতুন জলের প্রথম কল্লোল শোনা যাচ্ছে... আরো বেশি মানুষের মনোযোগী যোগদানের অপেক্ষা কেবল...

এই ঘোষণায় স্বাক্ষরকারী বিভিন্ন দেশের বা আদিবাসীদের প্রতিনিধিরা এ বিষয়েও একমত যে পৃথিবীর জলসম্পদ হল এক সার্বজনীন সম্পত্তি। নিম্ন স্বাক্ষরকারীরা মেনে নিচ্ছেন যে প্রতিটি দেশ বা মাতৃভূমির সমস্ত মানুষের অধিকার আছে তাঁদের নিজেদের দেশের সীমাগত জল-উৎসগুলি কীভাবে সংরক্ষিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে, তার ওপর লক্ষ্য রাখার। পৃথিবীর সমস্ত সরকারকে অবিলম্বে ঘোষণা করতে হবে নিজেদের সীমানার মধ্যকার  মিঠেজলের উৎসসমূহ সার্বজনীন সম্পত্তি এবং এই সেই অধিকার রক্ষার জন্য তাঁরা কী কী কঠোর নিয়মাবলী গঠন ও পালন করছেন। যেহেতু বিশ্বের সমস্ত মিঠেজল এক বুনিয়াদি জীবনরক্ষাকারী সার্বিক সম্পত্তি, কোন সরকার, প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেশন বা ব্যক্তি তা লাভের জন্য বিক্রি করার অধিকারী হবে না।

এই সিরিজের সব লেখাগুলি পাওয়া যাবে এই লিংকে

Jol Mati
Advertisment