পুকুর বলব না কি জলাশয়? সাধারণভাবে জলাশয় বলাই বোধহয় ভালো, তাতে ছোট ডোবা কি পা ধোবার গড়্যা থেকে সুবিশাল হ্রদ কিংবা মহীপাল দীঘি- সবই বোঝায়। তো ভারতবর্ষে এই সব জলাশয়ের ব্যাপারই আলাদা। এরা কেবল যে মাটির ওপরে বসে শুয়ে থাকে, এমন নয়। ইতিহাসে থাকে, কাহিনীতে, পুরাণে মহাকাব্যে।
কথায় বলে ‘যা নাই ভারতে তা নাই ভারতে’। তো সেই ভারতকথা মহাভারতেরই দেখি দু প্রান্তেই আছে জল। শুধু জল নয়, দুই প্রান্তে দুটি দ্বীপের গোপন আড়াল। ব্যাসের জন্মকে যদি ধরি মহাভারতের সূত্রপাত বলে, ঋষি পরাশরের মিলনে গর্ভধারিণী পদ্মগন্ধা সত্যবতী পুত্র প্রসব করলেন গঙ্গার এক দ্বীপে প্রচ্ছন্ন থেকে। সেই পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস একটু বড় হলে তার পিতা এসে তাকে শাস্ত্রশিক্ষার জন্য নিয়ে গেলেন। মাতা সত্যবতী পুনরায় ফিরে গেলেন নিজের ধীবর পিতার কাছে। সেইখানে তাঁকে পরম আগ্রহে বিয়ে করলেন মহারাজ শান্তনু, যে পুত্রের জন্য প্রিয়তমা গঙ্গাকেও ত্যাগ করেছিলেন, সেই প্রিয়পুত্র দেবব্রতকে ত্যাগ করে সত্যবতীর ভাবী পুত্রকে সিংহাসন দানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। কুরুবংশের পত্তন হল।
আরও পড়ুন, কলকাতা যদি সত্যিই সাইকেল বান্ধব হয়ে ওঠে!
অষ্টাদশপর্ব পরে, বহু অনর্থের শেষে যে বিশাল অবসান, তার অন্তিম বিন্দু যদি বলি দুর্যোধনের পতনকে, তারও আধার এক দ্বীপের গোপনীয়তা। সমস্ত ভাইদের মৃত্যুর শেষে পাণ্ডবশিবিরে ঘুমন্ত পাণ্ডবপুত্রদের মাথা কেটে নিয়ে দুর্যোধনের কাছে নিয়ে আসে অশ্বত্থামা। বংশের শেষ সন্ততিদের ধনে একেবারে ভেঙে পড়েন দুর্যোধন। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সঞ্জয়কেও দেখতে পাননা অশ্রুপূর্ণ চোখে। তারপর প্রচ্ছন্ন হয়ে যান। কোথায়? দ্বৈপায়ন হ্রদে, বলছেন মহাভারতকার। কেমন সে দ্বৈপায়ন হ্রদ? জানিনা কী আছে মূল সংস্কৃত মহাভারতে। বাংলায় সম্পূর্ণ অনুবাদে কালীপ্রসন্ন বললেন, হ্রদের জলের নিচে লুক্কায়িত একটি প্রাসাদে দুর্যোধন লুকিয়ে আছেন। থাকতেই পারেন, কিন্তু সে প্রাসাদের কথা কি জানতেন না কুরুপাঞ্চাল বংশের অন্যরা কেউ?
যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে কুরুরাজের খোঁজ করতে ভীম গুপ্তচর পাঠিয়েছেন চারিদিকে। ভীমের জন্য বন থেকে প্রচুর মাংস শিকার করে আনে যে নিষাদ, তার সঙ্গে কথাচ্ছলে গুপ্তচর জানতে পারছে ওই বিরাট হ্রদেও মাংস যাচ্ছে গত কয়েকদিন ধরে। কোন অভিজাত পুরুষ লুকিয়ে আছেন ওইখানে। এই সূত্র থেকে ধরা পড়েন ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠপুত্র। আমার মনে হয় সেই হ্রদ যেন চিনি আমি। যেন স্বপ্নে দেখেছি কখনো। জলের মধ্যে ডোবানো প্রাসাদ নয়, দ্বৈপায়ন হ্রদ মানে যেন যে হ্রদে দ্বীপ আছে। সে কেমন, যে হ্রদে থাকবে দ্বীপ? থাকে তো।
বিশাল জলাশয়, সুবিস্তারী হ্রদ কাটবার সময় মাঝখানে বেশ কিছুটা মাটি না-কেটে ছেড়ে রাখতে হয়। জলের চাপ যে কতো বেশি তা জানেন জলবিজ্ঞানীরা। আমাদের কাছে তা কল্পনার অতীত। সেই বিশাল জলরাশির চাপ যেন বর্ষার কালে পাড়ের ওপর চাপ না দেয়, বড় জলাশয়ে তাই মাঝখানে দ্বীপের মত করে মাটি ছাড়া থাকত, তা কাটা হত না। স্বভাবতই সেখানে প্রথমে ঝোপঝাড় তারপর ঘন জঙ্গল হয়ে যেত। খুব কি অসম্ভব যে দ্বৈপায়ন হ্রদের তেমনই এক দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন কুরুপতি, যেখান থেকে, না, ধরে আনতে হয় নি যুধিষ্ঠিরের ‘পরুষবাক্যে’ আহত হয়ে দুর্যোধন বেরিয়ে আসেন এবং যুধিষ্ঠিরকে মিনতি করেন পাঁচটিমাত্র গ্রাম দিয়ে দিলে তিনি রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন। একা দিন বাহিত করবেন। তারপর সেই গদাযুদ্ধের উপাখ্যান। যুদ্ধের অবসানে স্বজনদের শ্মশানভূমির শান্তিকল্যাণ। কিন্তু ভাবি, মহাভারত রচয়িতারা কি সচেতনে মহাকাব্যের দুই প্রান্তকে বেঁধেছিলেন দুটি জলক্ষেত্রের সীমানায়? জলের মত কী আর এমন রহস্যময়!
আরও পড়ুন, চিকিৎসা এবং মানবিকতার মাঝে দাঁড়িয়ে যে দেওয়াল, তার নাম বিজ্ঞান
ব্যাসদেব ভেবেছিলেন কিনা কে জানে, পিটার ব্রুক কিন্তু ভেবেছিলেন। প্যারির ভারত উৎসবে, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে যখন প্রথম ভারত উৎসব উদযাপিত হয়, পিটার ব্রুক সেই দর্শকদের সামনে অভিনয় করান তাঁর বহু বছরের গবেষণা ও কল্পনায় নির্মিত এক পরম মহাভারত। সে প্রযোজনার কথা পরে কখনো হবে কিন্তু ব্রুকের মনে হয়েছিল পঞ্চভূত ছাড়া আর কোনও সেট হতে পারে না এই আখ্যানের। একটি পরিত্যক্ত খনির উঁচু মাঠে অভিনীত হয় নাটক। ইতস্তত জ্বলন্ত কিছু অগ্নিকুণ্ড কখনও যুদ্ধের মাঠ হচ্ছিল, কখনও রাজগৃহ। সেইখান দিয়ে প্রবাহিত ছিল এক স্রোতধারা আর একটু নিচে, দর্শকাসনের কাছে একটি স্থির জলের বিস্তার। পরিচালকের ব্যাখা ছিল এরকম- ওই ভূমি ক্ষিতি, অগ্নি তে্জ, জলকে দেখালেন দুই রূপে – যেখানে দর্শক আছেন সেই স্থির জল হল বর্তমান আর কুরুক্ষেত্র দিয়ে বয়ে চলা ধারা হল প্রবহমান কাল।
জলধারার সঙ্গে কালকে অভিন্ন করে দেখার এই চোখ আমরা হারিয়ে ফেলছি, ভয় হয় বড়ো আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি।
(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)
পরিবেশ সংক্রান্ত এই সিরিজটির সব লেখা একসঙ্গে পড়ুন এই লিংকে