মহাভারতে পাণ্ডবদের বারো বছর বনবাসের শেষদিকে নৈমিষারণ্যে গিয়ে ধর্মবকের কাছে গিয়ে তাদের জীবন সম্পর্কে নানা রকম বোধের যে পরীক্ষা দিতে হয়, তাতে উদ্ধত চার ভাই ডাহা ফেল করে মারা পড়ার পর যুধিষ্ঠির যান আর ঠিকমত উত্তরে বককে সন্তুষ্ট করে ভাইদের প্রাণ ফিরিয়ে এনে সপরিবারে রক্ষা পান। এই মহাজ্ঞানী পক্ষী, অচিরেই যাঁকে পাঠক জানতে পারেন স্বয়ং ধর্ম বলে, তিনি কেন এত পাখি থাকতে, এমনকি কার্তিকের ময়ূর বা স্বয়ং সরস্বতীর হাঁসও না হয়ে নিছক এক বক রূপে আবির্ভুত হলেন, এটা একটু ভাবনায় ফেলে দেয়। সেটা কি এজন্য যে বক থাকেন পুকুরে? অর্থাৎ পুকুর বা জলাশয়ের গভীরতা যতোটা কেবল জলবিষয়ক, সেকালের মানুষদের কাছে তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল?
জ্ঞান যুক্ত থাকত পুকুর বা পুষ্করিণীর অস্তিত্বের সংগে? মণিপুরের আদি দেবতা পাখাম্বা। অর্ধ- সরীসৃপ দেহরূপের এই দেবতার বাসস্থান হিসাবে নির্দিষ্ট জলাশয়টির নাম নুংজেম পোখরি। ইম্ফলের কাংলা দুর্গের মধ্যে এই নুংজেম পোখরি ছিল নিতান্ত সাধারণ দেখতে একটি ঘাসে ঘেরা পবিত্র পুকুর। এখন যদিও তার পাড়ে ঘাট বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই পবিত্র পুকুরে কেউ নামেন না। মণিপুরীরা বিশ্বাস করতেন ওই পুকুরটার তলা নেই, ওখান দিয়ে পাখাম্বা সমস্ত পৃথিবীতে যাতায়াত করেন আর ওর মধ্যে তিনি বাস করেন।
পুকুর বিষয়ক এরকম আরো অনেক কাহিনি আমাদের দেশের নানা জায়গায় আছে। পুকুরকে এই যে দৈবীশক্তির আধার ভাবা, এর পেছনে সমাজের কী ভাবনা থাকতে পারে? একটা কথা তো বেশ স্পষ্ট যে সাধারণ ভাবে লোকেরা পুকুরের গুরুত্ব ভালো করে জানতেন। ধর্মীয় বিশ্বাসে বা অনুশাসনে তারই ছায়া দেখা যেত। কঠোপনিষদে দেখি পুণ্যফল বলতে বোঝানো হচ্ছে যজ্ঞকর্ম এবং (জলাশয়)খনন করা। জৈমিনী মহাভারত বলছে ‘অপুণ্য’ হল সেই গ্রাম যেখানে জলাশয় সমূহ সংস্কার হয় না।
দেখি আর ভাবি, এত শিক্ষা, এত পথনির্দেশ ছিল জ্ঞানবুদ্ধির চারপাশে, তবু আমরা রয়ে গেলাম উদাসীন অশিক্ষিত। তবুও আকাশ থেকে নিয়মিতভাবে হরে পড়া যে অকৃপণ বিশুদ্ধতম জলধারা তার যত্ন ভুলেছি। পুরোন মানুষরা কত যত্নে শিখিয়েছিলেন নির্দিষ্ট বর্ষামাসের দেশে কতো সুশৃঙ্খল ভাবে জল ধরে ভরে রাখা যায় সারাবছরের জন্য। কত নাম সেই জলক্ষেত্রের! কত তার আদর। ভূপৃষ্ঠের যে সব জায়গা আপনিই নিচু, জল গড়িয়ে গিয়ে যেখানে আপনিই জমা হয়, তার নাম হ্রদ, দহ। যে জমি নিচু বটে কিন্তু ততটা নয়, বরং অনেকখানি ছড়ানো সে হল বিল ঝিল হাওড়। এরা কেউ কারো প্রতিশব্দ নয়, প্রত্যেকেই নিজের বৈশিষ্ট্যে স্বকীয়। আবার প্রকৃতির কাজ দেখে মানুষও চেষ্টা করেছে। কতকাল ধরে কতরকমের জলাশয় তৈরি শিখেছে সে। শিখতে শিখতে করেছে, শিখেছে করতে করতে। দেখেছে মাটি খুঁড়ে স্বয়ং পৃথিবীকেই বানানো হয় জলাধার।
কিন্তু জলাশয় তৈরির সময় মাটি কাটাই প্রধান, সবচেয়ে জরুরি জ্ঞান হলজল গড়িয়ে আসার পথটি সযত্নে নজর করা। সেই গড়িয়ে আসা জল যেখানে সবচেয়ে বেশি জমে সেটাই হল কাটার সঠিক জায়গা। কাটা মাটি তুলে তৈরি হবে জলাশয়ের পাড়। যেখানে যেমন মাটির স্বভাব, যতখানি বৃষ্টিপাত, প্রত্যেক জায়গায় সেইমত খনিত হয় জলাশয়। কোথাও পাড় হবে এমন যেন চারপাশ থেকে গড়িয়ে আসা জল সহজে গড়িয়ে পুকুরে নামে। সাধারণত সেগুলো চাষের পুকুর। কোথাও মাত্র এক বা দুদিক ত্থেকেই পরিষ্কার জমির ওপর দিয়ে গড়িয়ে আসা জল পুকুরে এসে ঢুকবে, আবার কোথাও পাড়ের কাজ বাইরের গড়িয়ে আসা জল থেকে পুকুরকে রক্ষা করা। কেবল বৃষ্টির পরিষ্কার জলই পানীয় জলের পুকুরে থাকবে।
জলাশয়েরও রকমফের আছে। সম্পদশালীর দায়িত্বে যে বিরাট জলাধার, যার চারিদিকে নানা ফুলফলের গাছ, বাঁধানো ঘাটে যা সুসজ্জিত, সে হল সরোবর। এত বাহারি সাজ নেই কিন্তু আয়তনে বড়ো আর গভীর, তার নাম দীঘি। স্পষ্টতই দীর্ঘিকা অর্থাৎ অনেকখানি লম্বা হবার কথা এর আয়তন। বাংলার প্রায় প্রতিটি পুরোন শহরের ছিল নিজস্ব একাধিক দীঘি। বালুরঘাটের এপার ওপার দেখা যায় না চেহারার মহিপাল দীঘি, সাগরের মত কোচবিহারের সাগরদীঘি জলপাইগুরির রাজবাড়ি দীঘি ছাড়াও কতো যে অসংখ্য লাল দীঘি, সোনাই দীঘি, কমলাদীঘি- সে গুণে শেষ করা যাবে না এখনও।
এই সিরিজটির সব লেখা একসঙ্গে পড়ুন এই লিংকে