যে কোনও বাচ্চাকে যদি জিগেস করি, জল থাকে কিসে? নিশ্চিত বলবে বোতলে। তার বেশি জল? জেরিকেনে, ফিলটারে, আরো বেশি হলে কর্পোরেশানের ট্যাংকারও বলতে পারে হয়ত, কিন্তু কুঁজো কলসি বলার সম্ভাবনা খুব কম। তার সহজ কারণ এই যে জল রাখার আরো বড় পাত্র ক্রমশ অমিল হয়ে গেছে। একবার ব্যবহার-যোগ্য প্লাস্টিকের বিরোধিতা যতোই বেশি প্রচার পাক না কেন, কার্যক্ষেত্রে যখন প্লাস্টিক বোতল ছিল না সেই আমলের কোন অভ্যাস আর বাস্তব বাজারে সুতরাং মানুষের সামাজিক চলনে পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে ‘তিনভাগ জল’ থাকা সত্ত্বেও দৈনন্দিন ব্যবহারের জল জমা করে রাখার কোন সুস্থায়ী, ভালো ব্যবস্থা্র প্রচলন উঠে গেছে, একথা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।
ওভারহেড ট্যাংকের কথা অনেক পাঠকের মুখে উঠে আসছে জানি, কিন্তু প্রণিধান করুন, ট্যাংক এমন জলাধার যা নিজে থেকে, প্রাকৃতিকভাবে, জল সংগ্রহ করে রাখতে অক্ষম। সেখানে বাইরে থেকে জল এনে ভরতে হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের পরিচিত সমস্ত ওভারহেড ট্যাংকে ভরা হয় মাটির তলার জল, পাম্প করে তুলে। অথচ, প্রকৃতি নিজে বাইরের ব্যবহারের জন্য জল জমা করে রাখেন, তাঁকে দেখে মানুষও অভ্যাস করেছিল সবচেয়ে কম আয়াসে সবচেয়ে স্থায়ী বৃহৎ জলপাত্র তৈরি করা, সে ছিল তার জলাশয়গুলো। তার ছোটবড় পুকুর।
কত রকমের যে পুকুর আর কী বিচিত্র তার শাস্ত্র!
প্রথম যখন খুঁজতে শুরু করেছিলাম- পুকুর কেমন করে কাটা হয়, কোথাও তার কোন হদিশ পাইনা- না কোন বই, না প্রবাদ, না গল্প। পুকুর নিয়ে হাজার গল্প আছে, এমনকি কমলাদীঘির মত করুণ গল্পও আছে নানা ভাষায় যেখানে কাটা পুকুরে জল ওঠেনা যতক্ষণ না রানি স্বয়ং সেখানে নেমে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে কৃতসংকল্প হন। কিন্তু কেমন করে কাটা হত সেই পুকুর, কী ছিল তার নিয়মাবলী, সেকথা কোথাও নেই।
আস্তে আস্তে বোঝা গেল তার একটি সম্ভাব্য কারণ। পুরোন কোনও রান্নার বইয়ে, সে ‘পাক রাজেশ্বর’ হোক কি প্রজ্ঞাসুন্দরীর সুখ্যাত রন্ধনপ্রণালীর বই ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’, কোথাও ভাত রান্না শেখানো নেই। বাঙালিঘরে ভাত রান্না শেখানোর কোন প্রয়োজন আলাদা করে অনুভূত হয়নি কারণ প্রতিটি পরিবারে প্রতিদিন ওই কাজটি ‘সংসার’ শব্দের সমার্থক ছিল।
ঠিক সেরকমই পুকুর কাটা, পুকুর কাটানো, পুকুর ব্যবহারের নিয়মাবলী, পুকুরের পরিচর্যার বিধি কোথাও লিখে রাখার প্রয়োজন হয় নি, এটা এত স্বাভাবিক ও নিত্য অভ্যস্ত ছিল। বরং পঞ্চাশ বছরের পুরোন পঞ্জিকাতেও দেখা যায় ‘পুকুর প্রতিষ্ঠা’র নির্দিষ্ট তিথি। সাধারণত, এই ‘প্রতিষ্ঠিত’ পুকুরগুলি ছিল পানীয় জলের পুকুর। সেগুলোকে স্নান বা অন্য কোন কাজে ব্যবহারের বিধি ছিল না। পরে হয়ত যে কোন সামাজিক বিধির মত সেই নিয়মও আর ঠিকমত পালিত হয় নি।
তবে কিনা বড়োরা বলেন ‘মন দিয়ে খুঁজলে পাওয়া যায়’, ঘুরতে ঘুরতে দু-একজন লোক জোটে যারা প্রশ্নের উত্তর কিছুটা জানে। প্রাথমিক অক্ষর পরিচয়ের পর বাকি আর একটু পুকুররা নিজেরাই বলে দিয়েছে। এখন আরো মন দিয়ে, আরো বেশি করে খোঁজা বাকি।
কথায় বলে ‘যা নাই ভারতে তা নাই ভারতে’। প্রথম ভারতটা মহাভারত অর্থে। একথাটা একেবারে মিছেও নয়। ঐ একটি মহাকাব্যে যে কতো সময়ের কতো মানুষের চিন্তা, অভিজ্ঞতা, কল্পনা, জ্ঞান-সন্নিহিত হয়েছিল! কী নেই তার মধ্যে! ‘জ্বরের উৎপত্তি’ থেকে চক্রব্যূহ পর্যন্ত! সে হেন মহাভারতের শেষাংশে আমরা একটি বিরাট জলাশয়ের কথা পাই, সর্বস্ব ধ্বংস হওয়া পরাজিত রাজপুত্র দুর্যোধন যেখানে আত্মগোপনের লজ্জা মাথায় করে লুকিয়ে আছেন – দ্বৈপায়ন হ্রদ।
এই নামটিই বলে দিচ্ছে যে এটি একটি দ্বীপ সংবলিত হ্রদ, অতি বৃহৎ জলাশয়। অতোবড় জলাশয় মানুষ খনন করুক বা প্রকৃতি, সেই জমি অবশ্যই বেশ খানিকটা নিচু, যেখানে আশপাশে ঝরে পড়া বৃষ্টিজল স্বাভাবিক ভাবে গড়িয়ে এসে ঢুকতে পারে। সেরকম জায়গাতেই জলাশয় বা অগভীর জলাভূমি তৈরি হয়। হতে পারে সেই হ্রদে প্রাকৃতিক ভাবেই মাঝখানে একটি উঁচু ভূখণ্ড ছিল, জল ভরে যাবার পর যেটি দ্বীপে পরিণত হয়েছে, অথবা হ্রদটি কাটানো হয়েছিল।
দ্বৈপায়ন হ্রদের মাপ না জানলেও আমরা অনেক বিশাল জলাশয় দেখেছি যেগুলোতে মাঝখানে কিছুটা মাটির অংশ ছাড়া থাকে, অর্থাৎ মাঝখানে একটি (বা একাধিকও) দ্বীপ থাকে। রবীন্দ্রসরোবরের চেহারাটা মনে করলেই ছবিটা খানিক স্পষ্ট হবে। অন্যান্য শহরেও তাই। জলের চাপ কিন্তু প্রকাণ্ড। একত্রে অনেকখানি জল, বিশেষত বর্ষার জলস্ফীতির সময়, পাড় ভেঙে দিতে পারে।
সে কারণে, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি খেয়াল রেখে জলাশয় তৈরির সময় এই দ্বীপ রাখার বিধি মানা হত। ঠিক যেমন থাকত অতিবর্ষায় যেন জলাশয় উপচে কোন বিপদ না ঘটায় সে জন্য বিপজ্জনক-ভাবে-অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাবার পথ, ইদানিংকার ভাষায় যাকে বলে স্পিল চ্যানেল। তার সংস্কৃত নাম ‘নেষ্টা’, অর্থাৎ ব্যবস্থাটি নতুন নয়।
উক্ত হ্রদমধ্যস্থ দ্বীপের আমাদের অঞ্চলে প্রচলিত একটি নাম হল ‘লাকেটা’। এই লাকেটাও দু-রকমের হত- তীরের সঙ্গে সংলগ্ন, মানে জলাশয়টি কাটবার সময় যে মাটি না কেটে ছেড়ে আসা হত, তা তীর থেকে জলাশয়ের ভেতর পর্যন্ত চলে এসে জলের চাপকে ভেঙে দিচ্ছে। অথবা, দ্বীপটি জলের মাঝখানে। উভয় ক্ষেত্রেই দ্বীপে গাছপালা ঝোপজঙ্গলের কোন অভাব থাকত না। পাখিও থাকত প্রচুর। পুরুলিয়া ও আদ্রার সাহেববাঁধ দেখা লোকেরা এই লাকেটাগুলির সংগে ঘনিষ্ঠ পরিচিত।
সুখ্যাত ‘ভূপাল তাল’ যার সম্পর্কে বলা হত ‘তাল তো তাল ভোপালতাল বাকি সব তলৈয়া’(যদি তাল, জলাশয়, বলতে হয় তো ভোপালের তাল, বাকি সব তো তুশ্চু খানাডোবা), অনেক ভরাট হয়ে গিয়ে তার লাকেটাগুলোর ওপর নানাবিধ অন্যকাজ হচ্ছে, কিন্তু পুরোন গল্পগাথায় তাদের অস্তিত্ব জানা যায়। এরকম লাকেটাগুলো ত্রিশচল্লিশ বছর আগেও শীতের পিকনিকের জায়গা হিসাবে লোভনীয় ছিল।
বহুকাল পূর্বে কোন পলাতক রাজপুরুষ সেই অলক্ষ্য জঙ্গলের মধ্যে কোন কুটিরে আত্মগোপন করে থাকতে পারেন কি না, সে বেদনাকথা ওই বিশাল জলের মধ্যেই ডুবে আছে হয়ত। সঙ্গে ডুবে আছে আমাদের জলাশয়দেরও বহু হারিয়ে যাওয়া ইতিবৃত্ত।
(জয়া মিত্র পরিবেশকর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)
এই সিরিজটির সব লেখা একসঙ্গে পড়ুন এই লিংকে