আকারে বা প্রকারে বিশেষ রকমে সাজানো কিছু জলাশয়কে যেমন বলে সরোবর, নিত্যদিনের ব্যবহারের জল যেখানে জমা থাকে সে তেমনি পুকুর। সাধুভাষায় পুষ্করিণী। পুষ্কর হল মেঘ, সেই মেঘ যে বারিবর্ষণ করে। তার প্রসাদ জমা থাকে যে ধরিত্রীপাত্রে, তা্রই নাম পুষ্করিণী। সেই পুষ্করিণী বা পুকুরেরও রকমফের আছে। রাস্তার পাশে, পথিকের ব্যবহারের জন্য কিছু পুকুর থাকে। কিছু পুকুর তিনচারটে গ্রামের মধ্যে চলাচলের পথের মধ্যে কোনো জায়গায়। সাধারণত বড় বট বা অশত্থের গাছ থাকত তার আশপাশে। এগুলো ছিল গরমের দিনে চাষী বা রাখালছেলেদের আশ্রয়স্থল।
সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ির প্রবেশপথের কাছাকাছি সুন্দর সাজানো পুকুর থাকত, একদুটো বাঁধানো ঘাট, দু চারটে বড় ফুলগাছ। বিকেলে সন্ধ্যায় কখনো সেখানে বসা একটি সামাজিক ব্যসন। ভব্যতার একটি নিয়মের চর্চা আমাদের সব পরিবারে এখনও দেখা যায়- বাড়িতে আসা প্রিয়জনকে দরজার বাইরে কিছুদূর পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া। শকুন্তলার উপাখ্যানে দেখি কালিদাস একে বলছেন ‘সরস্তীর’ করা অর্থাৎ গৃহের নিকটস্থ সরসীর তীর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসা। কে জানে প্রতিসন্ধ্যায় মহারাজ বিক্রমাদিত্য কিংবা তাঁর বেতাল কালিদাসকে সরস্তীর করে আসতেন কি না? তবে এটা সহজেই বোঝা যায় যে গৃহস্থ বাড়ির সীমানাপ্রান্তে একটি, কোথাও হয়ত একাধিকও, পুকুর থাকত।
এমন ভাবার দরকার নেই যে মেয়েদের নিজেদের পুকুর ছিল না, সদরেই মুখ লুকিয়ে কাজ সারতে হত তাঁদের! একেবারেই নয়। বরং তাঁদের থাকত একাধিক পুকুর। বাসন ধোয়া, কাপড়কাচার পুকুর যদি আলাদা, একটু আড়ালে শৌচকার্যের পুকুর ভিন্ন। জায়গা বিশেষে সেই ছোট পুকুরকে বলা হত গড়্যা। খিড়কি পুকুর আবার নামভেদে নাছপুকুরও, পেছনের দরজা যেমন নাছদুয়োর। রাতের বাসন পুকুরে ডুবিয়ে রেখে এসে পরদিন সকালে গিয়ে মাজা- এটা মোটেই অপ্রচল ছিল না বরং সেই এঁটো-কাটায় মাছদের ভোজের ব্যবস্থা হত বলা যায়। পানীয় জল যেহেতু মেয়ে-বৌরাই সংগ্রহ করতেন আর প্রতিটিবাড়িতে পানীয়জলের ভিন্ন পুকুর রাখা সম্ভব ছিল না কাজেই ‘যমুনা পুলিন’ ছাড়াও আরো নানা জায়গায় কলসি কাঁখে নায়িকা অমিল নয় সে যুগের সাহিত্যে। ময়মনসিংহগীতিকা-র মলুয়াকে মনে করুন, আরো অনেককে মনে পড়বে।
অভিজাতদের বাড়িতে আবার মেয়েদের পুষ্করিণীর আভিজাত্যও আলাদা। মহিষাদল রাজবাড়ির আর্থিক অবস্থা, অন্য পাঁচটা রাজবাড়ির মতই, পরটিতে কিন্তু সেখালের মত আজও তাঁদের সীমানার মধ্যে দড়-মাঝারি পুকুরের সংখ্যা ঊনষাট। অন্দরমহলের জরাজীর্ণ অবস্থার মধ্যেও বজায় আছে রঙ্গদীঘি- রানিদের নৌকাবিহারের নিজস্ব বড় পুকুর। অন্য সম্পদ ক্ষয় হতে পারে কিন্তু জলের তো ক্ষয় নেই। সে তো প্রতিবছরই নতুন করে পাত্র ভরে দেয়, জলাশয়টি যতদিন থাকে। জলাশয় থাকত, সমাজ নিজেই নানা উৎসব তৈরি করত দীঘি-পুকুরএর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, গৃহস্বামী বা প্রতিষ্ঠাতা না থাকলেও।
না করবে কেন? কাটানো যারই হোক, জল তো সকলেরই! অন্তত এরকমই ভাবনা ছিল চল্লিশবছর আগে পর্যন্ত- যতক্ষণ না ‘জমিহাঙর’দের দাপটে বাংলার জলমাটি মাঠ বনের হিসাব গুলিয়ে যায়। বেশ পুরোন পঞ্জিকায় এখনো দেখা যায় বিয়ের, অন্নপ্রাশনের, গৃহপ্রবেশের শুভদিনের সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া থাকে দীঘি-জলাশয় শুরু করার, পুকুর-প্রতিষ্ঠার শুভদিনও। অর্থাৎ সমাজে এই কাজগুলো নিয়মিত আচরণের মধ্যেই পড়ত। আর, পাঁজিপুঁথি দেখে ভদ্রলোক বা সম্পন্ন লোকেদের কাজের পাশাপাশি খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষজন যে অন্যান্য কাজের মতই অনেক বেশি সংখ্যায় পুকুর কাটা কিংবা নিদেনপক্ষে পুকুর পরিষ্কারের কাজ করে নিতেন, সে কথা বোঝবার জন্য খড়ি পাততে হয় না। এখনও যাঁদের বয়স সত্তর-আশি সেই গ্রামীণরা স্মৃতি থেকে অনায়াসেই বলতে পারবেন।
বস্তুতপক্ষে, এই একটা অসম্ভব জরুরি কাজ আমাদের না-করা পড়ে আছে। ইতিহাস বইয়ের বাইরে ছড়িয়ে থাকা যে সকল ঐতিহাসিক উপাদান, সেগুলো যত্ন করে জড়ো করা হয় নি, হচ্ছে না। ইতিহাস বইয়ে দেখি, সপ্তদশ, অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের জন্য প্রাচীন দুর্গ প্রাসাদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ বারি, তার দেওয়ালে আঁকা ছবি, প্রাচীন পোষাকের ছবি ইত্যাদির সাহায্য নেওয়া হয়। এমনকি, ক্যামেরা যখন ছিল না, অজন্তা, ইলোরা, বাঘ-এইসব গুহার ছবি, পুরোন গয়না, অস্ত্র এইসব জিনিসের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে ইতিহাস লেখা হয়েছে। প্রায়ই দুঃখ করে বলা হয় যে ভারতীয়রা নিজেদের ইতিহাস কখনো লিখে রাখতে জানতো না। কিন্তু এখন তো আমরা অনেকেই লিখতে জানি, ভালোভাবেই।
আমাদের আশপাশে নিজেদের সংস্কৃতির যে অসংখ্য চিহ্ন এখনও ছড়ানো আছে- সেগুলো কেন তবে খুঁজে দেখি না? লিখে রাখিনা কেন? ইতিহাসের আসল ধারা হল মানুষের সমাজের ইতিহাস। কীভাবে তার সমাজ প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিজের সুবিধামত বাস করেছে, কেমন ছিল আলাদা আলাদা সমাজের অগ্রগমনের ধারা- সেটাই আসলে মানুষের ইতিহাস। রাজারাজড়ার ইতিহাস তো তার একটা ওপরের অংশ। আমাদের দেশে এখনও সব জায়গাতেই এরকম মানুষরা আছেন যাঁরা পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা বলতে পারেন। কেউ কেউ এমনও আছেন যাঁরা দেশের স্বাধীনতার কথা, তারমানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কিছু কিছু কথা মনে করে বলতে পারবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এজন্য যে সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষদের ইতিহাসে এ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দীর্ঘকালীন দুর্ভাগ্য। এর পরে প্রায় কিছুই আর তেমন রইল না, আগে যেমন ছিল।
সেই সময়ে আমাদের দেশ ছিল পরাধীন, আমাদের সমাজের মানুষদের যে কিসের মধ্যে দিয়ে চলতে হয়েছিল তার ভেতরের কথা প্রায় কিছুই লিখে রাখা হয় নি। কিংবা বলা যায়, যা লেখা হয়েছে, তার চেয়ে আরো অনেক অনেক বেশি, অনেক প্রয়োজনীয় কথা কথাও হিসেব রাখা হয় নি। যাঁরা সেগুলোর মধ্যে দিয়ে পার হয়েছিলেন, তাঁরা হয়ত লিখতে পারেন নি বা লেখার অবস্থায় ছিলেন না। আরো বেশি সম্ভব যে তাঁরা বুঝতেও পারেন নি যে তাঁদের সময়কার খুব সাধারণ জিনিসও কিছুদিনের মধ্যে ভুলে যাবার অবস্থা এসে পড়বে। সেই রকমই এই জলের কথা।
কেমন ছিল এই বিরাট দেশের নানারকম প্রাকৃতিক অবস্থার জল পাবার ব্যবস্থা? যখন পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে গ্রামে গ্রামে কলের জল পৌঁছবার কথা হল, যেটা এই সত্তর বছর পরেও সম্ভব হয় নি, তার আগে কোথা থেকে জল খেত লোকেরা? যে দেশে সব ব্যাপারে এতরকম নিয়মবিধি, সেখানে কী ছিল জল নিয়ে নিয়ম? জলের শুদ্ধতা বজায় রাখার নিয়মই বা কি ছিল? এই যে আমার কৃষিসংস্কৃতির প্রাচীন দেশ, জলের হিসাব ছাড়া তো কৃষি হয় না, কীরকম ছিল সেই জলব্যবস্থা যাতে সোনার ভারত ধান-পাটের সোনা ফলাত? নানা গল্প, স্মৃতি, প্রবাদে এখনও সেইসব কথা কিছু কিছু মনে করে বলার লোক এক দুজন নিশ্চয়ই আছেন। যাঁরা জানেন তাঁদের সময়কার রীতিনিয়মের কথা, ধরনধারণের কথা- যা আমাদের এই সমাজের শিকড়ের গল্প।
সেই মানুষদের জ্ঞান সংগ্রহ করে নেওয়ার, যত্ন করে মনোযোগ দিয়ে শুনে লিখে রাখার কাজ আমরা এখনও মন দিয়ে শুরু করিনি। এঁরা আমাদের সামাজিক ইতিহাসের জীবন্ত লাইব্রেরি, এদের একজনের চলে যাওয়া মানে একটা দারুণ লাইব্রেরির দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। নিজেদের কাছাকাছির এই পুরোন মানুষদের যত্ন করে এঁদের কথা মন দিয়ে শোনা, লিপিবদ্ধ করে রাখার সময় রোজদিনই একটু করে চলে যাচ্ছে। আমরা নিজেদের ইতিহাসের সাক্ষ্য হারিয়ে ফেলছি।
এই সিরিজটির সব লেখা একসঙ্গে পড়ুন এই লিংকে