Advertisment

ধনকড় কি রাজ্যপাল পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হবেন?

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের আগে কার্যত লড়াইটা সংবাদমাধ্যম পড়লে মনে হচ্ছে, এটি মমতা বনাম রাজ্যপাল। মোদী বনাম মমতা নয়। মমতা বনাম বিজেপি নয়। বিজেপির একাংশ রাজ্যপালের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

বাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়

রবীন্দ্রনাথের সাধের শান্তিনিকেতনের হলটা কী? প্রয়াত উপাচার্য বলেছিলেন, শিক্ষার ভগ্ননীড়। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। এ আজ হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সমস্যা তো নয়। কিন্তু শিক্ষার পরিস্থিতি নিয়ে তো আমরা অনেক আলোচনা করেছি, আরো অনেক আলোচনা করব, কিন্তু এই যে কথায় কথায় রাজ্যের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের বিবৃতি, ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাওয়া, এই সব দেখে শুনে আমি যুগপৎ বিস্ময় ও হর্ষ অনুভব করছি। কেন হর্ষ আর কেন বিস্ময় তা বলি। হর্ষ কারণ, এহেন এন্টারটেইনিং রাজ্যপাল কদাচও দেখিনি। পুরনো হিন্দি ছবিতে এহেন কৌতুকাভিনেতা দেখা যেত। কিশোর কুমারের 'হাফ টিকিট' বা 'দিল্লি কা ঠগ', এ ধরনের ছবিতে। কী করছেন, কেন করছেন, নিজেই জানেন না। সুকুমার রায়ের হেড অফিসের বড়বাবুর মত ‘নন-সেন্স’ সাহিত্য। আবার বিস্মিত হচ্ছি কারণ, আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কেন সমগ্র ভারতবর্ষে এহেন সবাক রাজ্যপাল আমি দেখিনি।

Advertisment

রাজ্যপালের চেয়ারে বসে শাসক দলের বিরুদ্ধে রাজনীতি করা, ষড়যন্ত্র করাটা নতুন কিছু নয়। সত্যি কথা বলতে কি রাজ্যপাল বনাম মুখ্যমন্ত্রীর বিবাদ নেহেরুর আমল থেকেই হচ্ছে। রাজনৈতিক নিয়োগের শুরুও সেই সময় থেকেই। ইন্দিরার সময়ে এই বিবাদ বেড়ে যায়, কারণ দৃষ্টিকটুভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাজ্যপালকে ব্যবহার করার সংস্কৃতি সেই সময় থেকেই বেড়ে যায়। কূটনীতিক লেখক, অধুনা রাজনৈতিক নেতা, পবন ভর্মা লিখেছেন, ইন্দিরার সময়কেই বলা হয় “End of Innocence,” রাজনীতির নিরাপরাধ অধ্যায়ের অবসান হল।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাতও নতুন নয়। ১৯৬৭ সালের ২১ শে নভেম্বর তৎকালীন রাজ্যপাল ধরমববীর যেভাবে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে সে সময় ভেঙে দেন, তা কিন্তু অভূতপূর্ব। ১৯৬৯ সালে অবশ্য আবার যুক্তফ্রন্ট সরকার নব কলেবরে ফিরে আসে। ১৯৭৭ সালে আবার বিরোধ বাধে। ত্রিভুবন নারায়ন সিংহ রাজ্যপাল। ক্ষমতায় এলো বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট সরকার তো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিডি পান্ডেকেই আক্রমণ করে। আমার মনে হয়, ধরমবীরের ভূমিকার স্মৃতি যেহেতু তখন খুবই জ্বলজ্বলে, তাই বোধ হয় বামপন্থীরা ৭৭ সালের প্রথম দিন থেকেই রাজ্যপাল নিয়ে বেশ শঙ্কার মধ্যে ছিল। তাই শুরু থেকেই রাজ্যপাল নিয়ে সন্দেহও ছিল তীব্র। ১৯৮১-তে রাজ্যপাল হন ভৈরব দত্ত পান্ডে। ১৯৮৪ সালে অনন্ত প্রসাদ শর্মা রাজ্যপাল হলেও এ সংঘাত ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি রাজ্য সরকারের সুপারিশ মানতে রাজি ছিলেন না। ২০০৭ সালে গোপালকৃষ্ণ গান্ধী রাজ্যপাল হলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে তার যথেষ্ট মতপার্থক্য হয়।

২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন মুখ্যমন্ত্রী হন তখন রাজ্যপাল নারায়ণন। পরে কেশরী নাথ ত্রিপাঠী রাজ্যপাল হন। তিনি আইনবিদ। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার স্পিকারও হন। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও নানা ব্যাপারে মমতা সরকারের সংঘাত বাধে। তবুও সম্পর্কটা ছিল অম্লমধুর। কিন্তু ধানকড়ের সময় এখন যা হচ্ছে, তা এর আগে কখনো দেখিনি। বিশ্বভারতীতে বৈঠকে যোগ দিতে রাজ্যপাল শুধু যাচ্ছেন তাই নয়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছেন। যদিও এটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক বিষয়ের বাইরে ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে পৌষ মেলা করা না করা নিয়ে উপাচার্যের বিরোধ হয়। প্রস্তাবিত গেট করে বেড়া দেওয়ার বিরুদ্ধে যখন তৃণমূল ছাত্র কর্মীরা চড়াও হয়, তখন রাজ্যপাল যদি ওখানে বিবৃতি না দিতেন তবে হয়ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হত। রাজ্যপাল এক্ষেত্রে তৃণমূল বিরোধী প্রকাশ্য অবস্থান নিচ্ছেন কেন? রাজ্যপাল নিজে বিশ্বাস করেন যে রাজ্যে রাজ্যপালের সংবিধান অনুসারেই এক স্বাধীন সৃজনশীল প্রশাসনিক Proactive হওয়ার বৈধতা আছে। এই সাংবিধানিক বৈধতা আছে বলেই তিনি যাদবপুরের ছুটে যাচ্ছেন।

ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে যে, ক্যাবিনেট যা বলবে তা রাষ্ট্রপতি মেনে নিতে বাধ্য। বড়জোর তিনি ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য একবার ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু ক্যাবিনেট যদি আবার তা ফেরত পাঠায়, তবে তা মানতেও রাষ্ট্রপতি বাধ্য। রাজ্যপালের ভূমিকা রাষ্টপতির মতোই নয় কি? জগদীপ ধনকড় মনে করেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে তো কোন রাজ্য বা রাজ্য সরকার নেই। তবে ৩৫৬ ধারা তো কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হয় না। রাজ্যপাল তো তা নয়। রাজ্যপালের শাসন হয় কার্যত ৩৫৬ ধারা জারি হলে। রাজ্যপালের একজন না দুজন উপদেষ্টা থাকে। তিনি তাদের উপদেশ মেনে রাজ্য চালান। ধনকড় সাহেব নিজে আইনজীবী। তিনি বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন সংসদীয় মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এটা নিয়ে যদি আইনি বিতর্ক হয়, সংবিধান নিয়ে তর্ক চলে, তবে তাতেও ধনকড়ের রাজনৈতিক লাভ।

আমার যেমন সাধারণ সাংবাদিক হিসেবে মনে হয় রাজ্যপালও ব্রিটেনের রাণীর মতই। জাঁকজমক পূর্ণ সাক্ষীগোপাল। রাজভবন চালানোর খরচও তো আসে রাজ্য সরকারের বাজেট থেকেই। রাজ্যপালকে দেখা যাবে, শোনা যাবে, এই ব্রিটিশ কনভেনশন অনুসরণ করেই ভারতের সংবিধানে রাজ্যপালের হাত-পা বাঁধা। এ অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে ভোটের আগে কার্যত লড়াইটা সংবাদমাধ্যম পড়লে মনে হচ্ছে, এটি মমতা বনাম রাজ্যপাল। মোদী বনাম মমতা নয়। মমতা বনাম বিজেপি নয়। বিজেপির একাংশ রাজ্যপালের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, যেদিন নাড্ডা দলের সভাপতি হয়ে প্রথম কলকাতায় এলেন সভা করতে, সেদিন রাজ্যপাল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে ধরনার নাটক করে মিডিয়ার হেডলাইন পেলেন। প্রশ্ন উঠছে তবে কি ভোটের আগে রাজ্যপাল পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হবেন? আর যাই হোক বিশ্বভারতীর ঘটনাকে সমর্থন না করলেও রাজ্যপালের এই অতি সক্রিয় ভূমিকা সমর্থন যোগ্য নয়।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Mamata Banerjee Delhi Theke Bolchi Jagdeep Dhankhar
Advertisment