Advertisment

জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্য

এর আগে গ্রামাঞ্চলে কাজ করলে এমবিবিএস ডাক্তারদের এমডি বা এমএস পড়ার ক্ষেত্রে 'শহুরে' ডাক্তারদের তুলনায় কিছু বাড়তি সুবিধে দেওয়া হতো, যা মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার নির্দেশে এখন আর দেওয়া যায় না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
west bengal doctor crisis

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাবা গুরুতর অসুস্থ। অবিলম্বে পেসমেকার বসানো জরুরি। বেসরকারি হাসপাতালে যার খরচ নিদেনপক্ষে ২ লক্ষ টাকা, বা তারও কিছু বেশি। অতএব সরকারি হাসপাতালের দোরে দোরে ঘোরা ছাড়া গতি নেই। মুশকিল হলো, এখন পর্যন্ত বেড পাওয়া যায় নি শহরের কোনও বড় সরকারি হাসপাতালের কারডিওলজি বিভাগে। সময় দিতে পারেন নি ডাক্তারও। গত সাতদিন ধরে বন্ধু এবং তার পরিবারের উদভ্রান্ত অবস্থা দেখে কিছু কথা মনে হলো।

Advertisment

সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত এ বছরের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভে বলছে, ভারতে গড়ে ১১,০৮২ রুগী পিছু রয়েছেন একজন সরকারি ডাক্তার। বাংলায় সেই অনুপাত দাঁড়ায় ১০,৪১১ রুগী পিছু একজন ডাক্তার। জাতীয় অনুপাতের তুলনায় যা যথাযথ মনে হতে পারে, এবং বিহারের ২৮,৩৯১ রুগী পিছু একজন ডাক্তারের তুলনায় রীতিমত ভালো। সমস্যা একটাই, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন দ্বারা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা হলো ১,০০০ রুগী পিছু একজন ডাক্তার। এবং পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যার ঘনত্ব ভারতে সর্বোচ্চ, অতএব দেশের বড় রাজ্যগুলির মধ্যে তালিকার একেবারে তলার দিকেই বাংলা।

কাশ্মীরের কাপ ও প্রাকৃত শিল্প

এবছরের জুন মাসে কলকাতার এনআরএস হাসপাতালে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে, সেই ছবি কিন্তু এরাজ্যে বহুদিন ধরেই পরিচিত। বেশ কিছু ঘটনার সংযোগের ফলে এনআরএস কাণ্ড বিপুল আকার ধারণ করে, এবং জনমানসে গেঁথে যায় ঠিকই, কিন্তু রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে, বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালে, দীর্ঘদিন ধরেই ফাটল ধরেছে ডাক্তার-রুগীর সম্পর্কে।

মাস দুয়েক আগে কলকাতার নামজাদা সরকারি হাসপাতালের এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় জানতে পারি, সেই হাসপাতালের বিভিন্ন আউট পেশেন্ট বিভাগে স্রেফ অগাস্ট মাসেই দেখা হয়েছে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার রুগী! এই প্রেক্ষিতে কীভাবে উন্নতমানের পরিষেবা দেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা খুবই সঙ্গত। এবং পরিষেবায় গাফিলতির অভিযোগ উঠলেই ভাংচুর, মারধর, ইত্যাদির সম্ভাবনা দেখা দেয়।

ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকা ডাক্তারের সংখ্যা নিয়ে যে রাজ্য সরকারও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন, তার আভাস পাওয়া যায় মুখ্যমন্ত্রীর এক সাম্প্রতিক ভাষণে, যেখানে তিনি স্বীকার করেন, প্রায় ৬ হাজার ডাক্তারের ঘাটতি রয়েছে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে। যেহেতু তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বটে, তাঁর বক্তব্য নিশ্চয়ই বাড়তি গুরুত্ব পায়। তিনি বলেন, ১০ হাজার সরকারি ডাক্তারের শূন্যপদ পূরণ করার জন্য এক বিজ্ঞপ্তি জারি হয়, তাতে সাড়া দেন স্রেফ ৪ হাজার ডাক্তার। অতএব তাঁর আবেদনের সারমর্ম ছিল, "আরও বেশি করে ডাক্তারি পড়ুন, রাজ্যে বেশি ডাক্তার তৈরি হোক।"

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল: উদ্বাস্তুরা প্রতারিত হলেন

কিন্তু অবস্থা এতটাই গুরুতর যে অন্যান্য রাজ্য থেকে ডাক্তার 'আমদানি' করার কথাও ভেবেছে সরকার। ডাক্তারি পড়লেই যে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অংশ হতে চাইবেন কেউ, এমনটা নয়। রাজ্যে যে যথেষ্ট পরিমাণ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নেই, সেকথা এখন সর্বজনবিদিত। আর সরকারি মেডিক্যাল কলেজে একজন এমবিবিএস ডাক্তার তৈরি করতে খরচ হয় আনুমানিক ৩০ লক্ষ টাকা, এমন তথ্য কান পাতলে শোনা যায়, যদিও একথা যাচাই করেন নি কেউ। সেই হিসেবে এমএস তৈরি করতে খরচ হয় ৫০ লক্ষ টাকা, এবং হার্ট সার্জন তৈরি করতে কোটি খানেক।

এই টাকা 'উসুল' হবে কী করে? সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারদের এমডি/এমএস পাস করে বাধ্যত রাজ্য স্বাস্থ্য পরিষেবায় যোগ দিতে হবে, নামমাত্র বেতনের বিনিময়ে। যোগ না দিলে সেই বাবদ অর্থ দান করতে হবে সরকারকে। ২০১৪ সালে সরকারের তরফে বলা হয়, হেলথ সার্ভিসে অন্তত এক বছরের বাধ্যতামূলক সেবা, তা নাহলে ১০ লক্ষ টাকা দিতে হবে। ২০১৭ সালে তা বদলে যায় তিন বছরের সেবা অথবা ৩০ লক্ষ টাকায়, যে নিয়ম এখনও বহাল রয়েছে।

এছাড়াও রয়েছে 'কোটা' ব্যবস্থার অবসান। এর আগে গ্রামাঞ্চলে কাজ করলে এমবিবিএস ডাক্তারদের এমডি বা এমএস পড়ার ক্ষেত্রে 'শহুরে' ডাক্তারদের তুলনায় কিছু বাড়তি সুবিধে দেওয়া হতো, যা মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার নির্দেশে এখন আর দেওয়া যায় না। অতএব ইংরেজিতে যাকে বলে 'ইন্সেন্টিভ', সেটাও আর নেই। তার ওপর রয়েছে নানা ধরনের রাজনৈতিক এবং অন্যান্য প্রকারের চাপ।

গুরুগিরি: বাঙালি ও ভারতীয়দের ঐতিহ্য

এই পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরি করতে খুব বেশি সংখ্যক ডাক্তার এগিয়ে আসবেন বলে মনে হয় না। অতএব নানাবিধ পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও উন্নততর হবে না সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা। কাজেই বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া গতি নেই, সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেই বা। স্বাভাবিকভাবেই এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্পেশ্যালিটি বা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালগুলি।

'জনস্বার্থে' তো অনেক কিছুই করেন আমাদের নেতারা। এদিকে জনস্বাস্থ্য যে ওষ্ঠাগত।

Advertisment