Advertisment

জ্যোতি বসু থেকে মমতা, রাজ্যপালদের লক্ষ্মণ রেখা

রাজ্যের শাসকদলের সঙ্গে অনেক সময়ই রাজ্যপালের সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায়, উপেন্দ্র কিশোরের টুনটুনির গল্পের রাজা আর টুনটুনির মতো।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Governor Dhankar, West Bengal Governor

যে ছবি নেহাৎই সৌজন্যের

এমন রাজ্যপাল, অন্তত এই রাজ্যে আগে কেউ কখনও দেখেনি। যাদবপুরে বিজেপির সাংসদ আটকে পড়েছেন, অরণ্যদেবের মতো প্রায় উড়ে গিয়ে উদ্ধার কাজে হাজির তিনি। এই অরণ্যদেবকে এই দেখা গেল উত্তরবঙ্গের কোনও গ্রামের আটচালায় তো ওই দেখা যাচ্ছে তিনি সিঙ্গুরের মাঠে হেঁটে চলেছেন। সিঙ্গুরের জের কাটতে না কাটতেই দেখা গেল তিনি ডোমকলে তবলা বাজাচ্ছেন। নিজের তবলা নিজের ঢাক পেটাতেই পারেন! কিন্তু তিনি যদি রাজ্যপাল হন? তাহলেও কি সে কাজ সমীচীন? তাই নিয়েই নিয়েই এই আলোচনা।

Advertisment

চিরকালই রাজ্যপাল পছন্দের মানুষ না হলে রাজ্যের শাসকদল বেজায় চটে যায়। কারণ, রাজ্যের শাসকদল আর দিল্লির শাসকদল আলাদা হলে, রাজ্যের শাসকদলের সঙ্গে অনেক সময়ই রাজ্যপালের সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায়,  উপেন্দ্র কিশোরের টুনটুনির গল্পের রাজা আর টুনটুনির মতো। রাজা যত রাগেন, টুনটুনি তত রাজভবনের ইলেকট্রিকের তারে বসে গাইতে থাকে, রাজার ঘরে যে ক্ষমতা আছে, আমার ঘরেও সে ক্ষমতা আছে। রাজা যত তাকে নাম না করে ধমকায়, কালো পতাকা দেখায়, দিল্লির টুনি ততই তারে বসে লেজ নাড়িয়ে লাফায়। এই খেলা আর শেষ হয় না। চলতেই থাকে। যখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ঘটছে, তখন তদানীন্তন টুনি রোজ এটা বলতেন সেটা বলতেন। তার পালক হিম করা সন্ত্রাসের, ভয়ের কথা ফ্যাক্স করে করে ছড়িয়ে দিতেন। এখন যে রাজা-রানিরা শাসন ক্ষমতায়, তখন কিন্তু তারা সেই টুনি-প্রেমে মশগুল ছিলেন।  টুনিকে রোজ পিঠে হাত বুলিয়ে ছোলা খেতে দিতেন। আর আলিমুদ্দিন তখন সেই টুনির পিতা-মাতার খোঁজ-খবর নিতে নিতে ঠেঙা নিয়ে ছুটতো টুনির পেছনে। এখন এক মাঘ চলে গিয়ে পরের মাঘ এসেছে। শীত কী আর অত তাড়াতাড়ি যায়!

আরও পড়ুন, জ্যোতি বোস থেকে দিলীপ ঘোষ: বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

এটা ঠিক, অনেক রাষ্ট্রপতির নামই মানুষ মনে রাখে। যেমন রাধাকৃষ্ণণ, এপিজে আবদুল কালাম। প্রধানমন্ত্রীদের নাম তো মানুষ বেশ মনে রাখে। কিছু কিছু মুখ্যমন্ত্রীদের নামও মানুষ ভোলে না। কিন্তু রাজ্যপাল? রাজ্যপালদের নাম লোকজন মনে তো রাখেই না, উল্টে প্রায়ই বলতে শোনা যায় এই পদটা আছে কেন? এক সময়ে কংগ্রেস বাদে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই কেন্দ্রের মাতব্বরির এই পদটি বিলোপের কথা বলত। পরে তারা মত পাল্টায়। কারণ চিরকাল তো আর কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকবে না! এবং নেইও। আর সব দলই দেখল, কোনও ভাবে দিল্লিতে আসীন হলে, কেন্দ্রের হয়ে কল এবং কাঠি নাড়ার জন্য একজনকে চাই। তাছাড়া এটাও ঠিক, সারকারিয়া কমিশনও বলেনি, এই পদ তুলে দিতে। তিনি নাকি সাংবিধানিক প্রধান! তাহলে মুখ্যমন্ত্রীরা কী? অসাংবিধানিক প্রধান? না কি সাংবিধানিক উপপ্রধান? হয় কখনও! লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত সদস্য, পুরসভার কাউন্সিলর থেকে রাষ্ট্রপতি, সবাইকে ভোটে দাঁড়িয়ে জিততে হয়। শুধু রাজ্যপাল, কেন্দ্রের শাসকদলের পছন্দটাই যার অন্যতম শর্ত।

কেন্দ্র এবং রাজ্যে একই দলের সরকার না হলে তখনই  দেখা যায় রাজ্যপালেরা গুটি গুটি বেরিয়ে আসছেন রাজভবন থেকে। তখন পিছনে গান বেজে ওঠে, ‘কোন খেলা যে খেলব কখন, ভাবি বসে সেই কথাটাই...’। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। যতদিন কংগ্রেসের শাসন ছিল ততদিন সব গলায় গলায় ছিল। ১৯৬৭ সালে রাজ্যে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার তৈরি হল। নির্বাচনে সিপিএমের নেতৃত্বে ‘ইউএলএফ’ জোট হল। তারা প্রার্থী দিল ২৮০-র মধ্যে ২০১টি আসনে।  সিপিআই, বাংলা কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক মিলে তৈরি করেছিল পিইউএলএফ জোট। তারা প্রার্থী দিল ১৯২ আসনে। কংগ্রেস একাই লড়েছিল। ফল বেরোতে দেখা গেল কংগ্রেস ১২৭, সিপিএম জোট ৬৮, সিপিআই-বাংলা কংগ্রেসের জোট ৬৫ আসন পেয়েছে। রাজ্যপাল তখন ধরমবীর। কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও পক্ষই গেল না। কংগ্রেসকে বাইরে রেখে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হল প্রথম অকংগ্রেসি মন্ত্রিসভা। প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার নামেই যে সরকার বেশি পরিচিতি পেয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখোপাধ্যায়। জ্যোতি বসু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সরকারের বিভিন্ন দলের মধ্যে গোলমাল প্রথম থেকেই ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই  সরকার একবছরও টিকল না। কিন্তু টিকল যে না, তার প্রমাণ পাওয়া গেল না। কারণ সিপিআইয়ের নেতৃত্বাধীন ফ্রন্টের প্রফুল্ল ঘোষ সহ বেশ কিছু নেতা তখন কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। জ্যোতি বসুরা রাজ্যপালকে বলেছিলেন, সরকার সংখ্যা গরিষ্ঠতা হারিয়েছে কি না তা বিধানসভার ভিতরে আস্থা  ভোটে প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হোক।  রাজ্যপাল শুলেন না। বরখাস্ত করলেন প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারকে। তৈরি হল কংগ্রেসের সমর্থনে প্রফুল্ল ঘোষকে মুখ্যমন্ত্রী করে প্রগ্রেসিভ ডেমক্র্যাটিক ফ্রন্টের সরকার, বা পিডিএফ সরকার।

এর পর যে ঘটনা ঘটেছিল, তা সারা ভারতের বিধানসভার ইতিহাসে ‘বিজয় ব্যানার্জির রুলিং’ হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে। বিজয় ব্যানার্জি রাসবিহারী কেন্দ্র থেকে বামেদের সমর্থনে নির্দল হিসেবে জয়ী হয়ে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের স্পিকার নির্বাচিত হন। রাজ্যপাল ধরমবীর নতুন সরকারকে শপথ বাক্য পাঠ করালেও, স্পিকার বললেন, বিধানসভা অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতুবি রাখা হল। প্রায় তিন মাস চেষ্টা করেও স্পিকারকে রাজি করানো যায়নি বিধানসভার অধিবেশন ডাকতে। এবং স্পিকার ছাড়া বিধানসভার অধিবেশন কেউ ডাকতেও পারেন না। রাজ্যপাল পারেন। একবার ডাকেলেনও। কিন্তু শুরুতেই স্পিকারের ঘোষণা, যে পরিস্থিতিতে তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য বিধানসভা মুলতুবি করেছিলেন, সেই পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন না হওয়ায়, তিনি পুনরায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিধানসভা মুলতুবি করে দিচ্ছেন। প্রায় তিন মাস এই ভাবে চলার পর, নিরুপায় হয়ে প্রফুল্ল ঘোষের পিডিএফ সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হল। ফের রাষ্ট্রপতি শাসন শুরু হল বাংলায়। বিধানসভায় তালা, চাবি বিজয় ব্যানার্জির কাছে। এই নিয়ে তখন অনেক কার্টুন, লেখালেখি হয়েছিল।

আরও পড়ুন, রাজনীতির ‘অবেদনে’ গণতন্ত্র অজ্ঞান

ফের ভোট হল ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সিপিএমের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের আসন এবার বেড়ে হল ২১৪টি। কংগ্রেসের আসন ১২৭ থেকে কমে হল ৫৫। যুক্তফ্রন্টের আসন বৃদ্ধির কারণ, সিপিএমের পুরোনো ফ্রন্টের সঙ্গে সিপিআই, বাংলা কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক সবাই মিলে একটাই কংগ্রেস বিরোধী ফ্রন্ট গঠন। সিপিএমের অর্ধেক আসন পেয়েও এবারও মুখ্যমন্ত্রী হলেন বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখোপাধ্যায়। ফ্রন্টকে শক্তিশালী করতেই বাংলা কংগ্রেসের দাবি জ্যোতি বসুরা মেনে নিলেন। ক্লাস এইট পর্যন্ত বিনামূল্যে লেখা পড়া করার নিয়ম ছাড়াও এই সরকার বেশ কিছু ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবু গোলমাল বাধল নিজেদের মধ্যে। গোলমালের মূল কারণ সিপিএমের রাজনীতির সঙ্গে বাকিদের বনিবনা না হওয়া। নানা ধরনের অশান্তি লেগেই থাকত। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে অভিযোগ এতদূর গড়ালো যে মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় নিজের সরকারকে ‘বর্বর সরকার’ ঘোষণা করে নিজেই প্রতিবাদে অনশনে বসে গেলেন। কোনও মুখ্যমন্ত্রী নিজের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অনশন করছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। তার আগে একটা চক্রান্ত হয় জ্যোতি বসুর উপর পুলিশ দিয়ে হামলা করানোর। যদিও যে বিক্ষুব্ধ পুলিশরা হামলা করতে বিধানসভায় জবরদস্তি জ্যোতি বসুর ঘরে ঢুকেছিল, তারা দেওয়ালে একটা ফুলদানি ছুড়ে মারার পরই জ্যোতিবাবুর কঠিন ব্যক্তিত্বের সামনে মিইয়ে যায়। সিবিআইএর প্রাক্তন ডিরেক্টর অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, তাঁর লেখা ‘আননোন ফ্যাক্টস অফ রাজীব গান্ধী, জ্যোতি বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত’ বইয়ে এই চক্রান্তের বিস্তারিত বিবরণ লিখেছেন। এই ঘটনা যখন ঘটে তখন তিনি রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগের (আইবি) প্রধান ছিলেন।

যাই হোক, দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট পতনেও রাজ্যপালের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল। প্রথমে পদত্যাগ করলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, এসইউসি-ও জানালো তারা থাকবে না যুক্তফ্রন্টে জ্যোতি বসুদের সঙ্গে। রাজ্যপালকে জ্যোতি বসু চিঠি দিয়ে বললেন সিপিএম একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। তাকে নতুন করে সরকার গড়ার সুযোগ দেওয়া হোক, বিধানসভার ভিতরে শক্তি পরীক্ষা হোক, বাইরে নয়। রাজ্যপাল শান্তিস্বরূপ ধাওয়ান সে কথায় কান না দিয়ে সরকারকে বরখাস্ত করে দিলেন। জ্যোতি বসুদের ডাকলেন না। ১৩ মাসের মধ্যে শেষ হয়ে গেল দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট। এই সময় একটি বড় ঘটনা ঘটে। জ্যোতি বসু পটনা গিয়েছিলেন দলের কাজে। তাঁকে স্টেশন আনতে যান এলআইসি-র এক নেতা আলি ইমাম। স্টেশনেই জ্যোতি বসুকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় সন্ত্রাসবাদীরা। গুলিতে মারা যান জ্যোতিবাবুর পাশে থাকা আলি ইমাম। জ্যোতিবাবুর আঙুলে গুলি লেগেছিল। এত বড় একটা ঘটনার নিন্দে না করে নকশালপন্থী নেতা সরোজ দত্ত দেশব্রতীতে লিখলেন, ‘কড়ে আঙুল ছড়ে যাওয়া হাফ শহিদ জ্যোতি বসু’। তখন আমরা যারা খুবই কম বয়সে একটু অতি বাম রাজনীতির সমর্থক ছিলাম, বেজায় মজা পেয়েছিলাম ‘শশাঙ্ক’ ছদ্মনামে লেখা সরোজ দত্তের ওই প্রতিবেদনে। পরে বয়স বাড়লে মনে হয়েছে, সন্ত্রাসবাদী হামলা নিয়ে এই ধরনের মন্তব্য অসৌজন্য তো বটেই, এক অর্থে আক্রমণকারীদের উস্কানি দেওয়া। পরে মুখ্যমন্ত্রিত্বে এসে খোঁজ খবর নিয়ে জ্যোতিবাবু ওই আক্রমণের জন্য আনন্দমার্গীদের দায়ী করেছিলেন। আনন্দমর্গীরা অবশ্য সরাসরি ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছিল।

আরও পড়ুন, আর এনআরসি নয়

একটা কথা মনে রাখতে হবে, ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৩, পশ্চিমবঙ্গ বিধ্বস্ত ছিল খুনের রাজনীতিতে। খুনের রাজনীতির বিপরীতে ছিল পুলিশের গুলিতে শত শত যুবকের মৃত্যু। কাশীপুর বরাহনগর হত্যাকাণ্ড, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোপাল সেন হত্যা, হেমন্ত বসুর মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতাকে খুন, এসব তখনই ঘটেছিল। আর অলিতে গলিতে নিয়মিত পাওয়া যেত গুলিবিদ্ধ যুবকদের লাশ। এমনই পরিস্থিতে হল ফের নির্বাচন। নির্বাচনের দিন দশ জনের মৃত্যু হল। সিপিএমের নেতৃত্বে জোট-১২৩, সিপিএম একক দল হিসেবে পেল ১১১টি আসন। কংগ্রেস-১০৫, সিপিআইয়ের নেতৃত্বাধীন জোট ২৩টি আসন পেল। বাংলা কংগ্রেস এবং আরএসপি একা লড়ে যথাক্রমে আসন পেল, ৫ এবং ৩টি। বাকিটা অন্যান্য। জ্যোতি বসু রাজ্যপালকে চিঠি দিলেন, একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তাঁকে যেন ডাকা হয়। কিন্তু রাজ্যপাল শান্তিস্বরূপ ধাওয়ান তা করলেন না। দেখা গেল কংগ্রেসের সমর্থনে পাঁচ বিধায়ক নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। সমর্থন জানালো সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, মুসলিম লিগ। মুসলিম লিগ পেয়েছিল ৭টি আসন। দিল্লিতে তখন ইন্দিরা গান্ধীর শাসন। এই সরকারও টেকেনি। ফের ভোট হল ৭২ সালে।

এত কথা বলার কারণ, দিল্লিতে কংগ্রেসের শাসন ছিল, এবং রাজ্যপালদের সিদ্ধান্তে প্রত্যেকবারই উপকৃত হয়েছিল কংগ্রেস, এটা খুবই স্পষ্ট। সেই ছবিটা আজও বদলায়নি। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনে জ্যোতি বসুরা রাজ্যপাল সংক্রান্ত রাজনীতিটা খুব সতর্ক ভাবে করেছেন। এবং অনেকটাই বিরোধ এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্যতিক্রম এপি শর্মা। এর বাইরেও কয়েকটি ঘটনা হয়তো ঘটেছিল। তবে সে সব ঘটনা তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি বঙ্গ রাজনীতিতে। রাজ্যপাল এ পি শর্মা ১৯৮৩ সালে বাম ফ্রন্ট সরকারের অপছন্দের ব্যক্তি সন্তোষ ভট্টাচার্যকে কলকাতা বিশ্বিদ্যালয়ের উপাচার্য করেছিলেন। তার বদলা নিতে সিপিএম সমর্থক কর্মচারী ইউনিয়ন সন্তোষ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দিনের পর দিন যে কুৎসিত আচরণ করে গিয়েছিল তা সিপিএমের ইতিহাসে আরও বেশ কিছু ঘটনার মতোই কালো অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে।

কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। সেটা হল, রাজ্যপাল যে সরকারের কথা না শুনে অন্য একজনকে উপাচার্য করে দিলেন, তাতে কার লাভ হল? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তো কোনও উপকারে এল না এই সিদ্ধান্ত! উল্টো দিকে এটাও ঠিক, সন্তোষ ভট্টাচার্যের যোগ্যতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না। তিনি সিপিআই ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এটাই তাঁর দোষ। এবং আমাদের রাজনীতিও এত অসহিষ্ণু, এবং সেই রাজনীতির পিছনে এতটাই জনসমর্থন যে, প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সন্তোষ ভযট্টাচার্যকে ধারাবাহিক ভাবে অপমান করে গিয়েছে রাজ্য সরকারের সমর্থনপুষ্ট কর্মী সংগঠনের লোকজনেরা, তাতে কিন্তু সিপিএমের ভোট কমেনি। বেড়েছে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সহ বেশ কিছু বিশিষ্ট মানুষ অবশ্য প্রতিবাদ করেছিলেন। তাতে কোনও কাজ হয়নি।

যাই হোক, সাধারণ ভাবে বলা যায়, খুব বড় কোনও ঘটনা না ঘটলে, খুব সঙ্কটজনক কোনও পরিস্থিতি না হলে, রাজ্যপালদের রাজ্য সরকারের সঙ্গে মানিয়ে চললে উভয় পক্ষেরই কাজের সুবিধে। রাজ্যপালের কোনও কাজে যদি মনে হয় এর ফলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে উপকৃত হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক দল, তাহলে তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই অন্য পক্ষ। তিনি নিরপেক্ষ, এটা আচরণে প্রকাশ না পেলে তার দায়িত্ব রাজভবন-প্রধানকেই নিতে হবে। রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী যখন নন্দীগ্রাম নিয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেটা ছিল এক নজিরবিহীন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। ওই ধরনের পরিস্থিতির প্রতিবাদ সব সময়ই ন্যায় সঙ্গত। আজ কিন্তু সেই পরিস্থিতি নেই। রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় যতই লক্ষ্মণরেখার কথা বলুন আর যতই তবলা বাজান।

(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)

Bengal Line
Advertisment