Advertisment

গুটখা, স্বাস্থ্য ও রাজনীতি

দরিদ্র সাধারণের নেশা করার অধিকার খর্ব করা হচ্ছে বলে কেউ কেউ ব্যথিত। তাঁদের সাম্যবাদী মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি, ক্ষতিকর নেশায় উৎসাহ প্রদান বন্ধুসুলভ আচরণ নয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
west bengal gutkha ban

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

দীপাবলী পেরোতেই আলোচনার কেন্দ্রে গুটখা। কলকাতা শহরে কোনোকিছু আলোচনার কেন্দ্রে আসে সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক পথে। বর্তমানে গুটখা সংস্কৃতি ও গুটখা রাজনীতি… উভয়েই আলোচ্যমান, টগবগে, টালামাটাল, স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ। এই গুটখা সংস্কৃতি বিষয়ক ভাষ্য এবং গুটখা রাজনীতির অনেকগুলো দিক আছে, তবে কেন্দ্রে আছে ভাষা ও প্রাদেশিকতার রাজনীতি বনাম ধর্ম ও শ্রেণীর রাজনীতি।

Advertisment

এসব জটিল আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে গুটখার আরেকটি দিক। স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যের ওপর গুটখা, পান মশলা এবং তার বিভিন্ন তামাকের পেটের ভাইবোনের প্রভাব নিয়ে যুযুধান পক্ষগুলি উদাসীন। আমরা তাই রাজনীতি-কাব্যে উপেক্ষিতার দিকে নজর দেবো। এই দৃষ্টিক্ষেপ এই মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক, কারণ গুটখা আর পানমশলা নাগরিক আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে ২৫ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তরের জারি করা একটি নোটিসের কারণে, যেখানে জানানো হয়েছে যে আগামী ৭ নভেম্বর থেকে এই রাজ্যে ওই বস্তুগুলি বিক্রি করা নিষিদ্ধ।

বিবিধ নামে দোকানে দোকানে ঝুলে থাকে এরা। দু'টাকা ফেললেই কুচ করে প্যাকেট কেটে মুখে ফেলা যায়। অতঃপর চিবোতে চিবোতে গল্প করা যায়, মন ভালো হয়ে যায়, মুখে সুগন্ধ হয় এবং উৎপন্ন হয় রঙিন থুতু, যা ফেলার জন্য উপযুক্ত পরিচ্ছন্ন দেওয়াল খুঁজে বেড়ায় মন। এই পর্যন্ত বিষয়টা নিয়ে অনেকেই সচেতন। কারো সুখ, কারো বিরক্তির কারণ।

আরও পড়ুন: বর্ধমানে ডাক্তার ও তাঁর স্ত্রীর উপর হামলা: গভীর অসুখের বার্তা

এভাবেই পান, পানমশলা, খৈনি, নস্যি নেওয়া, ধূমপান ইত্যাদি যাবতীয় নেশাকে আমরা দেখি। যেটা সচরাচর ভুলে যাই, তা হলো সুগন্ধ বা মৌতাত ছাড়াও অনেক কিছু রেখে যায় এরা শরীরে। যেমন ক্যান্সার। সুখ আর অসুখের জন্ম দেয় একই ব্যক্তির দেহে। ভুলে যাই একথাও, যে বাঙালিরা উত্তর ভারতের কিছু প্রদেশের মানুষের তুলনায় গুটখা বা খৈনি কম ব্যবহার করেন ঠিকই, কিন্তু গুড়াকু বা নস্যির ব্যবহার আমাদের প্রদেশেই বেশি। জর্দা পানের ব্যবহারও আমাদের ঘরে ঘরে।

গুটখা বা পানমশলার বেশিরভাগে থাকে তামাক। তার সঙ্গে মেশানো থাকে অন্যান্য সুগন্ধী বা সুস্বাদু দ্রব্য, যাতে ক্রেতা পছন্দ অনুযায়ী স্বাদ ও গন্ধের মশলা ব্যবহার করতে পারেন। অন্যান্য জিনিস বা রঙের দ্বারা বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু মূল সমস্যা তামাক। গুড়াকু জাতীয় দাঁতের মাজন বা নস্যির মধ্যেও সেই তামাক। সিগারেট, হুঁকো, চুরুট বা পাইপের মধ্যেও তামাকে বহুরূপী নেশায় মানুষকে আচ্ছন্ন রেখেছে এই বস্তুটি। বিভিন্নরকম ব্যবহারের জন্য তামাকপাতাকে প্রস্তুত করার পদ্ধতি কিছু ভিন্ন, কিন্তু সবগুলোই আদতে নিকোটিন সেবন। দ্বারভাঙ্গা জেলা থেকে আসা কুলির ঠোঁটের পিছনে খৈনির ডেলা এবং কফি হাউজে বিরাজমান বাঙালি বুদ্ধিজীবীর আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট তাই চরিত্রগতভাবে এক।

তামাক (tobacco) তৈরি হয় নিকোটিয়ানা গোত্রের কিছু উদ্ভিদের পাতা থেকে। এই গোত্রের অনেকগুলো প্রজাতির গাছ আছে, কিন্তু Nicotiana tabacum এবং Nicotiana rustica প্রজাতিগুলোর চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। নিশ্বাসের সঙ্গে এর ধোঁয়া টেনে নেওয়া, নাকে সরাসরি গুঁড়ো তামাকে টেনে নেওয়া অথবা চুষে বা চিবিয়ে তামাক খাওয়া দস্তুর। স্বাভাবিকভাবেই চিবিয়ে তামাক খাওয়া মানুষের প্রাচীনতম অভ্যাস। যখন আগুন জ্বালিয়ে এর ধোঁয়া নেওয়ার বুদ্ধি কারো মাথায় আসেনি, এমনকি তামাক পাতা শুকিয়ে, কেটে, গুঁড়ো করে নেওয়াও সম্ভব ছিল না, তখন থেকেই মানুষ তামাক চিবোনোর আমোদ টের পেয়েছে।

আরও পড়ুন: দীপাবলির সুখ ও অসুখ

তামাক পাতার মধ্যে থাকে বিভিন্ন অ্যাল্কালয়েড, যার মধ্যে একটির নাম নিকোটিন। আমাদের শরীরে বিভিন্ন স্নাতসন্ধি বা স্নায়ু ও পেশীর সংযোগস্থলে অ্যাসিটাইল কোলিন নামক একটি রাসায়নিক দূতের ভূমিকা পালন করে। সেই দূতের বার্তা গ্রহণ করার জন্য যে রিসেপ্টরগুলো কোষের পর্দায় থাকে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল নিকোটিনিক রিসেপ্টর। নিকোটিন এই গ্রাহকদের উত্তেজিত করতে সক্ষম। এভাবে নিকোটিন সরাসরি কিছু স্নায়বিক প্রবাহ বৃদ্ধি করতে সক্ষম।

তার ফলে চনমনে বা তাৎক্ষণিক ঝিমঝিম ভাব, পেশীর সাময়িক সতেজতা, একটু হাত কাঁপা, হৃদস্পন্দনের গতি ও রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার মতো শারীরিক পরিবর্তন হতে পারে। মস্তিষ্কে এর প্রভাব খুব জটিল। স্নায়ুসন্ধিতে নিকোটিনের প্রভাবের ফলে ডোপামিন, গ্লুটামেট, গামা অ্যামিনো বিউটিরিক অ্যাসিড ইত্যাদি রাসায়নিক নিঃসৃত হয়। নেশা এবং নিকোটিন-নির্ভরতার জন্য এগুলো অনেকাংশে দায়ী।

অর্থাৎ তামাকের মৌতাত নেশার জন্য দায়ী রাসায়নিকটি হল নিকোটিন। হৃদরোগ এবং সেই গোত্রের অন্যান্য রোগের জন্যও নিকোটিনকেই দায়ী করা যায়, কিন্তু তামাকজনিত সব রোগের জন্য এই রাসায়নিকটি একাই দায়ী নয়। যে রোগটি নিয়ে আমরা বিশেষভাবে চিন্তিত, যার কথা সিগারেটের প্যাকেটে লেখা থাকে, সেই ক্যান্সারের জন্য নিকোটিন আদৌ দায়ী কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল কদিন আগেও। অবশ্য তামাক যে ক্যান্সারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ, তা জানা আছে অনেকদিন ধরেই।

আরও পড়ুন: দূষণ রোধে প্রশাসনের সবচেয়ে বড় শত্রু কে? আমি, আপনি, আবার কে?

তামাকে শুধু নিকোটিন থাকে না। অন্যান্য অনেক যৌগের মধ্যে কিছু পলিসাইক্লিক হাইড্রোকার্বন, টোব্যাকো স্পেসিফিক এন-নাইট্রোস্যামাইন (TSNA) ইত্যাদি ক্যান্সারের প্রধান কারণ। গবেষণায় জানা গেছে যে নিকোটিনও ক্যান্সার সৃষ্টির কয়েকটি ধাপকে প্রভাবিত করতে সক্ষম এবং ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রেও কিছু বাধা সৃষ্টি করে। নিকোটিন শরীরে প্রবেশ করার পর বিক্রিয়ার ফলে TSNA-র জন্ম দেয়।

সব মিলিয়ে তামাক মানবদেহে অনেকরকম ক্যান্সারের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। গলা বা ফুসফসের পাশাপাশি পিত্তস্থলী এবং মূত্রস্থলীর ক্যান্সারেও তামাকের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। অর্থাৎ তামাকের ক্যান্সার সৃষ্টিকারী (carcinogenic) ভূমিকাটি সারা শরীরে ব্যাপ্ত। তবে কীভাবে তামাক ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে কিছু ক্যান্সার। গুটখা, পান-মশলা, খৈনি ইত্যাদি মুখের ক্যান্সারের প্রধান কারণ। অতিরিক্ত মদ্যপানের সঙ্গেও এই ক্যান্সারগুলির যোগ আছে।

ভারতে চিবিয়ে তামাক খাওয়ার বা ঠোঁটের ফাঁকে খৈনি রাখার চল খুব এবং মুখগহবরের বিভিন্ন ক্যান্সারের হারও সবচেয়ে বেশি। এই ক্যান্সার জিভে, ঠোঁটে, গালের ভেতর দিকে, মুখের তালুতে বা টন্সিলে হতে পারে। ভারতকে বলা হয় পৃথিবীর মুখের ক্যান্সারের রাজধানী। প্রতি বছর দশ লক্ষাধিক ভারতীয় শুধু এই ধরণের ক্যান্সারেই আক্রান্ত হন। এই ক্যান্সারে প্রাণহানি হতে পারে। যদি অপারেশন এবং অন্যান্য থেরাপির মাধ্যমে প্রাণ বাঁচানো সম্ভবও হয়, তাহলেও মুখের যে গঠনগত পরিবর্তন হয়ে যায়, তা এক কথায় বীভৎস এবং পরবর্তী জীবনে খাওয়া, কথা বলা ইত্যাদি কষ্টকর হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন: রাগের আমি, রাগের তুমি, রাগ দিয়ে যায় চেনা?

ভারতের ঊনত্রিশটি জনভিত্তিক রেজিস্ট্রি থেকে তামাক চিবোনো এবং মুখের ক্যান্সারের তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। দেখা গেছে, বয়সের সঙ্গে মুখের ক্যান্সারের সংখ্যা বাড়ে। ভারতের তথাকথিত মূল ভূখণ্ডে পুরুষদের মধ্যে এই ক্যান্সার বেশি, কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতে মহিলাদের মধ্যে এর তীব্র প্রাদুর্ভাব, যার জন্য হয়ত জিনগত ভিন্নতা দায়ী হতে পারে। পুরুষদের মধ্যে টন্সিলের ক্যান্সার আর মহিলাদের মধ্যে ঠোঁটের ক্যান্সারের হার বেশি। অবশ্য উত্তর-পূর্ব ভারতের বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে ঠোঁটের ক্যান্সার বেশি। উত্তর ভারতের ষাট থেকে সত্তর বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে জিভের ক্যান্সার অনেক।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (GATS) ভারতে সংগঠিত হয় ২০০৯-১০ সালে। তাতে দেখা যায়, গুটখা বা তামাক ও সুপুরিওয়ালা পানমশলার ব্যবহার মধ্যপ্রদেশে সবচেয়ে বেশি। তার পরেই আছে গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও দিল্লি। বিহার প্রথম চারে নেই, যদিও কলকাতার একেবারে সাম্প্রতিক গুটখা চর্চার কেন্দ্রে বিহার। দারিদ্র্য এবং অশিক্ষার সঙ্গে তামাক চিবোনোর সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছিল। এইসব তথ্য পরবর্তী প্রকল্পের পরিকল্পনায় কাজে লাগে।

২০০৬ সালের Food Safety and Standards Act-এর ৯২ নম্বর ধারা অনুসারে, ২০১১ সালে ভারত সরকার একটি খাদ্য নিরাপত্তা ও গুণমান সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করে, যাতে তামাক ও নিকোটিন মেশানো খাদ্যবস্তু বিক্রি করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। যেহেতু গুটখা ও পানমশলা এই গোত্রের মধ্যে পড়ে, তাই এগুলির ওপর জাতীয় পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা আগেই ছিল। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করতে উদ্যোগী হয়েছে। চিকিৎসক হিসেবে এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই।

আরও পড়ুন: বেশি বুঝলেই সমস্যা

নাগরিক সমাজের একাংশ থেকে এর বিরোধিতা হয়েছে ইতোমধ্যে। দরিদ্র সাধারণের নেশা করার অধিকার খর্ব করা হচ্ছে বলে কেউ কেউ ব্যথিত। তাঁদের সাম্যবাদী মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি, ক্ষতিকর নেশায় উৎসাহ প্রদান বন্ধুসুলভ আচরণ নয়। দরিদ্র মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তাঁদের জীবিকা ও জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ব্যক্তিবিশেষের লিউকেমিয়ার চিকিৎসা বা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের খরচ তোলার জন্য যেমন সোশাল মিডিয়ায় ও রাস্তায় চাঁদা তোলা হয়, কারো মুখের ক্যান্সারের চিকিৎসার খাতিরে তেমন উদ্যোগ আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। সুতরাং দরিদ্রের 'স্বার্থে' গুটখাকে চিরঞ্জীব করার এই বৌদ্ধিক রাজনীতি না করলেও চলবে।

গুটখা বা পান-মশলা খাদ্যদ্রব্য বলে খাদ্য আইনে তাদের নিষিদ্ধ করা সম্ভব হলো। কিন্তু অন্যান্য ধরনের তামাক, যা খাদ্য নয়, তাদের এই আইনে নিষিদ্ধ করা যায়নি। সেগুলোকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, তা নিয়ে প্রবল বিতর্ক। সেই বিষয়টি স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে, যা পরবর্তী পর্বের জন্য তোলা রইল।

Advertisment