Advertisment

জল জমা আর জল জমানো

‘জলই জীবন’ একথাকে আগে হয়ত আলঙ্কারিক মনে হত। জলের স্বাভাবিক প্রাচুর্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওকথার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয়কে বোঝা যেত না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Waterbody, Environment

আমরা বিনা চেষ্টায় নিয়মিত ভাবে যে প্রচুর জল প্রতি বছর পেয়ে থাকি, তার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাগুলোকে আজও অবহেলা করা হয়

ইতিমধ্যেই আমাদের এই রাজ্যে এবছর ‘কম বৃষ্টি হওয়ার জন্য’ শাকসবজির বাজারে গৃহস্থের হাত পুড়ে যাওয়ার জোগাড়। অথচ ছ’মাসও হয়নি নানা অঞ্চল জল জমে যাওয়া, স্থানীয় বন্যা ইত্যাদিতে বিপন্ন হয়েছিল। স্বাভাবিক নিকাশি ব্যবস্থা নেই বলে দুঘন্টা বৃষ্টি হলে শহরে, এমনকি বর্ধিষ্ণু গ্রামেও আজকাল জল জমে জীবনযাত্রা স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। গোড়ার গলদ, মানে কন্সট্রাকশানের আগে বৃষ্টিজল বয়ে যাবার পথ খোলা না-রাখার ব্যধি সারাবার বদলে হাতে করে তৈরি আমাদের এই সংকটের গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে ‘আরবান ফ্লাড’। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টিংয়ের ভাষা দেখলে মাঝে মাঝে সন্দেহ হতে পারে যে বৃষ্টি বলে ব্যাপারটা কোনো শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্র, আমাদের বিপদ বাড়াবার জন্যই যার আসা।

Advertisment

জল, অথবা শুধু জল কেন, যে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদেরই সামাজিক ব্যবহার, অর্থাৎ পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে যা ব্যবহার করতে হয় তেমন জিনিসের প্রতি যত্ন বা দায়িত্ববোধ বিষয়ে নাগরিক শিক্ষা খুব একটা থাকে না, মনে হয়। একবার ‘শিক্ষিত’ হয়ে গেলে অন্য কারো কাছে কিছু শিখতে একটা অনিচ্ছা দেখা যায়। এমনকি, পাঠক্রমে যে বিষয় নিয়ে আমার কিছু শেখা হয়ে ওঠেনি, যেমন ডাল রান্না বা জামার হাতায় বোতাম বসানো কিংবা লাইব্রেরিতে বই গুছিয়ে রাখার নিয়ম, সেসব সম্পর্কেও অন্য কারো কাছ থেকে কিছু শেখার আছে বলে আর মনে হয়না। বরং মনে হতে থাকে- যে কাজগুলো আমি জানি না, সেগুলো কোনো কাজের নয়। তার ফলে, নিয়মিত যত্ন ব্যতিরেকে আমাদের সম্পদগুলি ক্রমশ নষ্ট হতে থাকে। যেমন, আমাদের জন্মসূত্রে পাওয়া অঢেল জল বা তাকে যত্নে রক্ষা করার বিদ্যা।

আরও পড়ুন, ওরে, আমার পেঁয়াজ গিয়েছে চুরি!

‘সাতসমুদ্র তেরো নদী’র এই দেশে যতো জল আকাশ হাত উপুড় করে ঢেলে দেয়, ততো জল ঢেউ খেলিয়ে বয়ে নিয়ে যায় মাটি। নদীজপমালাধৃত প্রান্তর। কবে থেকে কবে সেই জল আকাশ থেকে নামবে, একটু এধার-ওধার হলেও তার দিনক্ষণ মোটামুটি স্থির আছে। বাড়িতে অতিথি আসবার কথা থাকলে সুগৃহিণী যেমন রাঁধাবাড়ার সব আয়োজন আগে থেকে গুছিয়ে রাখেন, এদেশের মানুষরা ঠিক তেমনভাবেই বর্ষার জল করার এবং সেই জল দিয়ে নিজেদের কাজ-অকাজ সব পুরো করার জন্য তৈরি থাকতেন।

Waterbody, Environment ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের সামনের পুকুর (ছবি- লেখক)

কিন্তু প্রাকৃতিক মূল শক্তি-সম্পদের অবহেলা, তার বেহিসাব অপচয়, প্রকৃতির নিয়মকে মাত্রাহীন লঙ্ঘন, প্রাকৃতিক শৃঙ্খলায় স্বাভাবিক নয়। নিয়মের ব্যত্যয় যতোখানি হবে, তার প্রতিক্রিয়াও হবে ঠিক ততোখানি। সেই প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। নিয়মলঙ্ঘনকারীরা যতোই একে ‘আকস্মিক দুর্ঘটনা’ ‘প্রকৃতির খেয়াল’ বলে চালানোর চেষ্টা করুন, এই প্রতিক্রিয়া এক বৈজ্ঞানিক সত্য।

অধিকাংশ সাধারণ মানুষ একথা জানেন। নিজেদের সন্ততিদের ভবিষ্যত নিয়ে পৃথিবী জুড়ে বহু মানুষ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমাদের আশপাশেও। নিজেদের, পরের প্রজন্মের জন্য রেখে যাব এক জলহীন , স্নিগ্ধ বাতাসহীন ভবিষ্যত, এমন ভয়ংকর সম্ভাবনার দায়িত্ব আমরা অনেকেই নিতে চাই না। আমি দেখতে পাই, এই উদবিগ্ন, নিরাপদ-স্বাভাবিক-জীবন চাওয়া মানুষদের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। শিশু-কিশোরী-তরুণদের দল এসে দাঁড়াচ্ছে প্রকৃতিকে রক্ষা করে নিজেরা রক্ষা পাবার চেষ্টায় অংশ নিতে। প্রকৃতির সুস্থতা ছাড়া অন্যকোনো নিরাপত্তা নেই, সিসিটিভি এক নিরাপত্তার বিভ্রম তৈরি করে কেবল। যদি অন্য মানুষদের জীবনযাপন থেকে বিপন্নতা, হিংসা, সরিয়ে নেওয়া না যায়, তাহলে অপরাধ কমানোর অন্য কোনো শর্টকাট উপায় নেই- এ কথা ক্রমশ বেশি বেশি মানুষ স্পষ্ট বুঝতে পারছেন।

আরও পড়ুন, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও বিশ্বাস

প্রাকৃতিক সম্পদগুলো যত দ্রুত যতবেশি ক্ষয় হবে, মানুষের বিপন্নতা তত বাড়বে। ক্ষয়কারী বিলাসী ‘সভ্যতা’র চেয়ে প্রাকৃতিক সম্পদসমূহকে রক্ষা করার উপযোগী কম উপকরণে সহজ ও আনন্দময়, হিংসাবিহীন, পরশ্রীকাতরতা আর অকারণ প্রতিযোগিতাহীন, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার জীবন বহু মানুষের কাছে অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষার। বিশ্বজোড়া পরিবেশ-উদ্বাস্তু পরিবারদের মধ্যে আমরা থাকতে চাই না কিছুতেই। প্রাকৃতিক পরিবেশের যত্ন নিয়ে তাকে রক্ষা করা ছাড়া মানুষের রক্ষা পাবার কোনো ‘বৈজ্ঞানিক’ উপায় নেই কারণ প্রকৃতিই সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান। মানুষ সেই প্রকাণ্ড, জটিল, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলার মধ্যে এক অংশ। সবচেয়ে বড়ো পালোয়ানও নিজে বসে থাকা চেয়ারটা তুলতে পারে না, ঠিক তেমনই অসম্ভব মানুষের পক্ষে প্রকৃতির মূল নিয়মগুলোর বিরোধিতা করে ভালো থাকা।

‘জলই জীবন’ একথাকে আগে হয়ত আলঙ্কারিক মনে হত। জলের স্বাভাবিক প্রাচুর্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওকথার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয়কে বোঝা যেত না। এখন কিন্তু ‘বিশ্বের জলভাণ্ডারে টান পড়তে পারে’ এ কথার বাস্তব কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। অথচ আমরা বিনা চেষ্টায় নিয়মিত ভাবে যে প্রচুর জল প্রতি বছর পেয়ে থাকি, তার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাগুলোকে আজও অবহেলা করা হয়। আমাদের সারা দেশে বহুকাল থেকে নানারকমের অসংখ্য পুকুর বিল দীঘি সরোবর খানা ডোবা ছিল। বৃষ্টির সময়ে মাটির ওপর দিয়ে বয়ে চলে যাওয়া জলকে ধরে রাখার কাজ করত মানুষের যত্নে খোঁড়া কিংবা রক্ষা করা এই জলাধার গুলো। বিচিত্র এদের কৃৎকৌশল, বিচিত্র গঠনপ্রণালী, দীর্ঘ ইতিহাস। রামায়ণের পম্পা সরোবর থেকে মহাভারতের দ্বৈপায়ন হ্রদ, বেতালের গল্পের পুকুর থেকে রাজস্থানের সাতশ’ বছরের প্রাচীন এখনও জীবন্ত দীঘি- এই জলক্ষেত্রগুলো ভারতের সামাজিক ইতিহাসের এক সাক্ষ্য-আকর যেন।

যদি পাঠকরা আপত্তি না করেন, আগামী কয়েক সপ্তাহ আমরা কয়েকটা ‘সুন্দর পুকুর’এর গল্প শুনতে পারি। আমাদের জল জমানোর ইতিহাস আর শাস্ত্রকথা।

(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)

এই সিরিজের সব লেখা একত্রে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

environment Jol Mati
Advertisment