আজকাল বহু মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই হয়তো হোয়াটসঅ্যাপও ব্যবহার করেন। এই হোয়াটসঅ্যাপ নিয়ে সম্প্রতি একটি বিতর্ক শুরু হয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপের মালিক এবং ফেসবুকের মালিক ঘটনাচক্রে একই ব্যক্তি, তাঁর নাম মার্ক জুকারবার্গ। সম্প্রতি এই কোম্পানি আমেরিকার আদালতে একটি মামলা করেছে, এক ইজরায়েলি সাইবার যুদ্ধব্যবসায়ী কোম্পানির বিরুদ্ধে। অভিযোগ, তারা পেগাসাস বলে একটি ভাইরাস কিছু ফোনে তাদের মালিকদের অজান্তে ইনস্টল করে দিয়েছে।
এই পেগাসাস ভাইরাস যদি আপনার ফোনে থাকে, তাহলে সেটি আপনার ফোনের ক্যামেরা থেকে আপনার অজান্তেই ছবি বা ভিডিও তুলতে পারবে। এছাড়াও আপনার কল লিস্ট, কন্ট্যাক্ট, ক্যালেন্ডার, কথাবার্তা, সবই রেকর্ড করতে পারবে। চাইলে নাকি কিছু ডকুমেন্ট আপনার ফোনে বসিয়েও দিতে পারবে। শুধু তাই নয়, এই ভাইরাস ফোন বন্ধ অবস্থায় থাকলেও আপনার গতিবিধির ওপরে নজর রাখতে সক্ষম। এই পেগাসাস তৈরি করেছে ইজরায়েলের যুদ্ধব্যবসায়ী এনএসও গ্রুপ।
আরও পড়ুন, কীভাবে আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করে কিছু “সরকার-সমর্থিত কুশীলব”
এরই পাশাপাশি আরও কয়েকটি খবর একসঙ্গে পড়তে হবে।
১। তামিলনাডু হাইকোর্টে একটি পিটিশনের শুনানির সময়ে অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল প্রস্তাব দিয়েছেন যে ফেক নিউজ আটকানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে আধার কার্ড যোগ করতে হবে।
২। ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে সারা দেশ জুড়ে, এবং এই প্রক্রিয়াতে বহু মানুষকে বলা হচ্ছে আধার দিয়ে এই মেলানোর কাজটা করতে, এবং বহু রাজনৈতিক দল বুঝে অথবা না বুঝে এই প্রক্রিয়াতে মানুষকে অংশগ্রহণ করাচ্ছে। এর পরের ধাপ হবে আধার দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করা।
৩। ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জুকারবার্গ বলেছেন যে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে যে মেসেজ আদানপ্রদান হয়, তা তাঁরা চাইলে পড়তে পারেন।
৪। ট্রাই (TRAI) নতুন নিয়ম লাগু করতে চলেছে, যার ফলে এরপর বাড়িতে টিভি দেখতে গেলেও আধার জমা করতে হবে।
অনেকেই বলতে পারেন, আবার সেই গরুর রচনার মতো আধারের প্রসঙ্গ এখানে টেনে আনা কেন? আধারের সঙ্গে তো হোয়াটসঅ্যাপের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁদের জন্যই একটা ছোট্ট খবর দেওয়া জরুরি। এই ইজরায়েলি সাইবার যুদ্ধব্যবসায়ী গ্রুপের মালিক ফ্রাঞ্চেস্কো পার্টনার্স। এদেরই আরেকটি কোম্পানি ক্রসম্যাচ, যাদের আধার কার্ড বানানোর চুক্তি দিয়েছে ভারত সরকার। যারা সমগ্র ভারতবাসীর আঙুলের ছাপ, রেটিনা, মুখের ছবির স্ক্যান ইত্যাদি অত্যন্ত ব্যক্তিগত তথ্যের অধিকারী। অর্থাৎ এই এনএসও গ্রুপ এবং ক্রসম্যাচ, যারা আমার আপনার আধার করিয়েছিল, তারা ঘটনাচক্রে একই মালিকানাধীন।
এখন এই পেগাসাস ভাইরাস সম্পর্কে শোনা যাচ্ছে যে ভারতবর্ষের বেশ কিছু সাংবাদিক, দলিত সমাজকর্মী ও পরিবেশ আন্দোলনের নেতানেত্রীদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে এটিকে কাজে লাগানো হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ বলতে পারেন, ''আমি তো আর এই সব বিষয়ে কাজ করিনি'। তাঁদের জন্যও কিছু কথা বলা জরুরী। আপনি নিজে হয়তো কিছু লেখেননি, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে কোনও পোস্ট আপনার পছন্দ সেটা জানিয়েছেন, তাহলেই হবে।
ধরা যাক, একদিন সকালে আপনি আপনার মেইলবক্স খুললেন, দেখলেন একটি মেইল এসেছে জিমেইল থেকে, তাতে লেখা, "We believe that your account may have been the target of government backed actors, which means that they could gain access to the information in your account." এটা পেয়ে আপনার কী মনে হবে? আপনার কি মনে হবে না যে আপনার প্রতিটি কথা সরকার শুনছে?
ঠিক এই রকম একটি বার্তা পেয়েছিলেন কলকাতার সুপরিচিত বিজ্ঞানকর্মী ও সমাজকর্মী পার্থসারথি রায়। পার্থবাবুকে অনেকেই হয়তো চেনেন নোনাডাঙা আন্দোলন দিয়ে, বিভিন্ন সময়ে দেশের নানা প্রান্তে নিপীড়িত মানুষদের কাছে পৌঁছে যেতেন তিনি। তাঁর সঙ্গে গৌরী লঙ্কেশেরও যোগাযোগ ছিল। তাই কি তাঁর মেইলকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল?
যদি খেয়াল করা যায়, তাহলে বোঝা যাবে যে যাঁদের ওপর এই নজরদারি চালানো হয়েছিল, তাঁরা কোনও না কোনওভাবে বর্তমান সরকারের বিরোধী। পার্থসারথি রায়কে কিন্তু সারা বিশ্ব চেনে তাঁর নিজের বিজ্ঞান গবেষণা দিয়ে, কিন্তু তাতে এই সরকারের কিছু আসে যায় না। তিনি যখনই তাঁর সরকার-বিরোধী অবস্থান রেখেছেন, তখনই সরকারের চক্ষুশূল হয়েছেন।
আরও পড়ুন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়: মোদী-শাহের রাজনীতির বাঙালি বিকল্প
বেশ কিছু মানুষ আদিবাসী দলিত নারী, শিশু, তাদের পড়াশোনা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিশুমৃত্যুর হার, এসব নিয়ে কাজকর্ম করে থাকেন। এঁদের কাজ রাজনৈতিক নয়, তবে গরীব আদিবাসী কেন খেতে-পরতে পায় না, প্রশ্ন করলেই সব দলের সরকারই খুব রেগে যায়। তাই কি নির্বাচনের মুখে যাতে এই মানুষদের কথা সাধারণ মানুষদের কানে, বা বলা ভালো ফোনে, না পৌঁছয়, বেছে বেছে কিছু মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এই নজরদারি চালানো হয়েছিল? জানা গিয়েছে, মাত্র ১০ টি ফোনেও যদি এই পেগাসাস ভাইরাস ঢোকাতে হয়, তার খরচ কিন্তু ৩৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ যে ১,৪০০ মানুষের ফোনে এই ভাইরাস দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ, তার খরচ কত হতে পারে সেটা জানতে কি গণিতজ্ঞ হতে হয়? সরকার না চাইলে কি এত টাকা কোনও ব্যক্তি মানুষ এই ১,৪০০ জনের পিছনে এমনি খরচ করেছেন, তাহলে তাঁরই বা স্বার্থ কী? তাহলে কি এই ১,৪০০ জন এতটাই শক্তিশালী যে এঁরা কোনও একটি সরকারকে উল্টে দিতে পারেন?
এখন এই পেগাসাস প্রসঙ্গে যখন অভিযোগ উঠেছে, তখন সরকারের তরফ থেকে কী বলা হয়েছিল প্রথমে? তারা হোয়াটসঅ্যাপ কোম্পানির কাছে জানতে চাইবে কেন এটা করা হয়েছে। তারা এও বলেছে যে প্রত্যেকটি নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হোয়াটসঅ্যাপ কিন্তু অনবরত বলে চলেছে যে তারা সরকারকে আগেই সতর্ক করেছিল, ২০১৯ সালের মার্চ থেকেই তারা নাকি বলে আসছে এই কথা। তাহলে সরকার তখন আমল দেয়নি কেন? তাহলে কি তারাই এই গুপ্তচরবৃত্তিতে সহায়তা করেছিল?
রাস্তাঘাটে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে যে আধারের সঙ্গে ভোটার কার্ডের লিঙ্ক করাতে হবে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন বাংলায় এনআরসি করতে দেবেন না, ওদিকে আগামী বছরের মার্চ মাস থেকে জাতীয় পপুলেশন রেজিস্টার বানানোর প্রক্রিয়া চালু হবে। বাড়ি বাড়ি যাবেন ওই দপ্তরের কর্মীরা, এবং তথ্য নেবেন, তথ্য মানে ডেমোগ্রাফিক এবং বায়োমেট্রিক তথ্য।
২০১১ সালেও এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, কিন্তু ডেমোগ্রাফিক তথ্য অর্থাৎ নাম, ঠিকানা, বয়স, লিঙ্গ বা কোথায় থাকেন, এই তথ্য নেওয়া হয়েছিল। তখন কিন্তু বায়োমেট্রিক, অর্থাৎ হাতের ছাপ বা চোখের মণি বা মুখের ছবি নেওয়া হয়নি, কারণ ২০০৯ সাল থেকে আধার চালু হয়ে যায়। কিন্তু এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ যাওয়ার ভয় ছিল না বলে অত আশঙ্কাও ছিল না। এবার সেই ভয়টা যুক্ত হয়েছে। এনপিআরে এবার আধার চাইবে। যদি আধার দিয়ে দেওয়া হয় বুঝে অথবা না বুঝে, তাহলে কিছুদিন পর নির্বাচন কমিশন বলবে এই দেখুন, সবাই স্বেচ্ছায় দিয়েছেন, তাই এবার আধার দিয়েই ভোট হোক।
আরও পড়ুন, ধর্ষণে মৃত্যুদণ্ড কিংবা গণপিটুনির দাবি: হাত ধুয়ে ফেলার রাজনৈতিক চেষ্টা
আপনি বলতেই পারেন, তাতে দোষ কোথায়?
আরটিআই করে জানা গেছে যে, আধারের তথ্য কারোর দ্বারা পরীক্ষিত নয়, কত ভুয়ো আধার আছে তাও জানা নেই, আর কত আধার লাগবে, তাও সরকার বলতে পারেনি। তাহলে যে আধার কোনও কিছুরই পরিচায়ক নয়, সেই আধার দিয়েই যদি ভোট হয়, তাহলে যে আধার কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার জায়গা নেবে না, সে কথা কে বলতে পারে?
আসলে আজকের সময়ে আধার, স্মার্টফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, প্রত্যেকটি মাধ্যমই নজরদারির এক একটি উপকরণ। প্রত্যেকটি দিয়েই নির্বাচনকে প্রভাবিত করা সম্ভব। সুতরাং এই সমস্ত কিছুর থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে ভারতবর্ষে আগে আধার কার্ড বন্ধ করতে হবে। আধার সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যোগ করলে এটা জানা কি খুব কঠিন যে কোন কোন মানুষ সরকারের বিরোধী? এবার যদি সেই সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট দেখে কোনও মানুষকে বাদ দিতে হয়, সেটাও কি খুব কিছু কঠিন কাজ হবে?
আধার যখন নাগরিকত্বের পরিচয় নয়, তখন কেন সেটাকে ভোটার কার্ডের সঙ্গে সংযোগ করা হচ্ছে ঘুরপথে? এই প্রশ্নগুলো কি করার সময় হয়নি? কিন্তু কে এই প্রশ্ন করবে? আজকে যখন নাগরিকপঞ্জি, বা এনপিআর নিয়ে জনমানসে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তখন কি বিরোধী দলেদের উচিৎ নয় এই বিষয়গুলো বন্ধের আন্দোলন করতে রাস্তায় নামার আহ্বান জানানো? নাহলে প্রত্যেকটি নাগরিকের ওপর যেদিন 'বিগ ব্রাদার' চোখ রাখবে, তখন কিন্তু আর কিছু করার থাকবে না।
(সুমন সেনগুপ্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার ও সমাজকর্মী)