একটা বাজার জ্বলেপুড়ে খাক। জ্বলছে তো জ্বলছেই। দেড় দিনেও আগুন নিভছে না। কবে নিভবে কেউ জানে না। তিন দিনে, চার দিনে, না কি আরও বেশি সময় লাগবে ?
কার দোষ, কার দায়, সে নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়ে গেছে। যেমন হয় যে কোন হইচই-ফেলা দুর্ঘটনায়। শুরু হয়ে গেছে পোস্টমর্টেম। চলবে আগামি কয়েকদিন, বা তারও বেশি, যতক্ষণ না আরেকটা বেশ ভয় ধরিয়ে-দেওয়া আগুন লাগে অন্য কোন বাজারে বা অন্য কোথাও অন্য কোন ব্রিজ ভেঙে পড়ে। বাগরি-বিতর্কের জায়গা নেবে অন্য কিছু হাতেগরম, ফের উঠবে উত্তেজিত প্রশ্ন, দায় কার? দোষ কার?
দমকল বিভাগের দোষ? যারা শর্তসাপেক্ষে বাগরি মার্কেটের লাইসেন্স দিয়েছিল দুই মাস আগে? আর অগ্নিনির্বাপণের সুরক্ষাবিধির সেই শর্তগুলি আদৌ মানা হচ্ছে কি না সে বিষয়ে চোখে ঠুলি পরে বসে ছিল? জতুগৃহ হয়ে ওঠার সব রকম উপাদান মজুত রয়েছে জেনেও কেন এই চরম উদাসীনতা?
দমকলমন্ত্রী তথা মেয়র বলছেন, পুজোর মুখে এত বড় একটা বাজার দুম করে অগ্নিসুরক্ষার অভাবের কারণে বন্ধ করে দেওয়া যায় না মানবিক কারণে। বেশ তো, খুব ভাল কথা। কিন্তু নজরদারি করা যেত না সপ্তাহে অন্তত একদিন করে, চাপে রাখা যেত না ব্যবসায়ীদের, যাতে তাঁরা অগ্নিসুরক্ষার বিষয়টিকে চূড়ান্ত অবহেলা করার সুযোগ না পান?
দোষ পুরসভার? যারা ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছিল? যারা এখন বলটা দমকলের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এই বলে, ফায়ার লাইসেন্স কেউ পেয়ে গেলে কি করে আটকে রাখা যায় ট্রেড লাইসেন্স? সেই চিরপরিচিত নিজের দপ্তরের পিঠ বাঁচানোর খেলা। এটা ভুলে গিয়ে যে দমকল আর পুরসভা, দুটিই সরকারি প্রতিষ্ঠান। উভয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকাটা শুধু জরুরিই নয়, এ সব ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক।
দোষ ব্যবসায়ীদের? যাঁরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর উপেক্ষা করেছেন দমকল বিভাগের নির্দেশিকা, যাঁদের অনেকে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করেছেন 'হুকিং' করে, রমরমা ব্যবসার মুনাফার এক শতাংশও বিনিয়োগ করেননি অগ্নিসুরক্ষার বিধিগুলি কার্যকর করায়? বরং যত্রতত্র যেমন খুশি বোঝাই করে রেখেছেন দাহ্য পদার্থের স্তূপ। সরকারের নির্দেশিকা মানার ন্যূনতম সদিচ্ছা থাকলে লক্ষ লক্ষ টাকার ক্ষতি নিয়ে আজ হা-হুতাশ করতে হত না হয়তো। যাঁরা সর্বস্বান্ত হলেন, তাঁদের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি নিয়েই বলতে হচ্ছে, এখন 'যত দোষ নন্দ ঘোষ' বলে সরকারের দিকে আঙ্গুল তুললে শোনার লোক খুব বেশি পাওয়া মুশকিল।
২০০৩, সত্যনারায়ণ পার্ক। ২০০৮, নন্দরাম মার্কেট। ২০১৩, সূর্য সেন মার্কেট। ২০১৩ এবং ২০১৫, হাতিবাগান মার্কেট। ২০১৮, বাগরি মার্কেট। এর পর কবে? কোথায়?
আরও পড়ুন: "এমন আগুন আগে কখনও দেখিনি"
এক একটা বিপর্যয় ঘটে, হইচই হয় কিছুদিন।তারপর যেই কে সেই। সরকার ভুলে যায় শহরের বাজারগুলির একটা সার্বিক ফায়ার সেফটি অডিট করে ব্যবসায়ীদের কড়া হাতে বিধি মানতে বাধ্য করার কথা। আমরাও দু'দিনের ফেসবুক এবং হোয়াটস্যাপ-বিপ্লবের পর সব ভুলে যাই। ভুলে যাওয়ার রসদও তো নেহাত কম নয়। বিরাট কোহলি-তৈমুর-রাফাল-সেক্রেড গেমস-পুজোপার্বণ... আরও কত কী! ব্যস্ত সময়, ব্যস্ত জীবন। অত মনে রাখতে গেলে তাল রাখা যায় না।
এবং, শঙ্খ ঘোষ যেমন লিখেছিলেন, "আমরা প্রতিবাদ করি/ করতে করতে ঘুমোই/ ঘুমোতে ঘুমোতে কথা বলি/ যা ঘটবার ঘটতে থাকে/ ঘটতে থাকে।"
দোষ কারো নয় গো মা!