Advertisment

মুষলপর্বে কংগ্রেস? রক্ষা করবে কে?

কংগ্রেস এখন জরাগ্রস্ত। আচ্ছন্ন। কে বাঁচাবে তাকে? উত্তরটা ঝোড়ো হাওয়ায় হারিয়ে গিয়েছে বোধ হয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Ashwani Kumar quits Congress

বিড়ম্বনায় হাত শিবির।


নীলার্ণব চক্রবর্তী: একবার ৭৭ দিন, আর এক বার ১৬৮ দিন। গোয়ার দু'বারের মুখ্যমন্ত্রী। লুইজিনহো ফেলেইরো তাঁর নাম। নাহ এ রাজ্যে তাঁকে বুধবার পর্যন্ত চিনতেন না প্রায় কেউই। তৃণমূলের পতাকা হাতে তুলতে বিদ্যুদ্বেগে তাঁর পরিচিতি হয়ে গেল। মোটামুটি ১৬ লক্ষ জনসংখ্যার একটি রাজ্য গোয়া, আর এই রাজ্যে জনসংখ্যা ৯ কোটি পেরিয়েছে, কলকাতারই জনসংখ্যা কাছাকাছি দেড় কোটি, তো লুইজিনহো ফেলেইরো কংগ্রেসে ফেল করলেও, যে ভাবে রাজনৈতিক জীবনের নবীকরণ করলেন, তাতে তাঁকে পাস মার্ক তো বটেই, ভাল নম্বরই দিতে হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, ভুল করছেন দাদা, লুইজিনহো নন, স্টোরিটা হল কংগ্রেসে মুষলপর্ব।

Advertisment

কংগ্রেসে মুষলপর্ব?

হ্যাঁ, ঠিকই। ঠিকই বলছেন। এবং সেই সব লক্ষণ দস্তুর মতোই স্পষ্ট। যে কাল তৃণমূলের ঘনিয়ে উঠেছিল বলে মনে হয়েছিল, এ রাজ্যে ভোটের আগে, ভোটে জিতে নবযৌবনে তারা ছুটছে। আঘাত 'সে যে পরশ' হয়ে তারা পুনর্জীবনপর্বে। সত্যিই, রাজনীতিতে কখন যে কী হয়, কেউ বলতে পারে না তো। রাজনীতি এর ফলে এক রঙ্গভূমি, ভীষণ রঙ্গ সেখানে চলে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ভীষণ রঙ্গে ভব তরঙ্গে ভাসাই ভেলা। রাজনীতিকরা সেই কাজটিই করে চলেন। তাঁরা প্রাতঃস্মরণীয়। এবং সকলেই জানেন যে, রঙ্গ করতে গিয়েই মুষলপর্বের সূচনা হল মহাভারতে। যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য বলি: 'একদিন বিশ্বামিত্র কন্ব ও নারদ মুনি দ্বারকায় এসেছেন দেখে সারণ প্রভৃতি বীরগণের কুবুদ্ধি হল। তাঁরা শাম্বকে স্ত্রীবেশে সজ্জিত করে মুনিদের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ইনি পুত্রাভিলাষী বভ্রুর পত্নী; আপনারা বলুন ইনি কী প্রসব করবেন। এই প্রতারণায় মুনিগণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, এই কৃষ্ণপুত্র শাম্ব একটি ঘোর লৌহমুষল প্রসব করবে। তোমরা অত্যন্ত দুর্বৃত্ত নৃশংস ও গর্বিত হয়েছ; এই মুষলের প্রভাবে বলরাম ও কৃষ্ণ যদুকুলের সকলেই বিনষ্ট হবে।'

বুঝতেই পারছেন নিজেরাই কী ভাবে নিজেদের শেষের ঘণ্টাটা বাজিয়ে দিল যাদব-কুল। তা এর পর, মুষলের খেলাটা যখন মহাভারতে শুরু হচ্ছে, তথন, 'সারস পক্ষী পেচকের এবং ছাক শৃগালের রব করতে লাগল'। এদিকে লুইজিনহো যেমন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, তেমনই পঞ্জাবের ক্যাপ্টেন মানে এই তো সেই দিনের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কংগ্রেসি এবং মুখ্যমন্ত্রী, যাঁর নামে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত, তিনি গিয়ে অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক করছেন, এবং পঞ্জাবের কংগ্রেস সভাপতি নভজোৎ সিধুর সঙ্গে পাকিস্তানের গা দারুণ ঘষাঘষি রয়েছে বলে অভিযোগও নাকি করছেন। অমরিন্দর বলছেন, তিনি অপমানিত, তাই কংগ্রেসে থাকবেন না। বিজেপিতেও যাবেন না।

কংগ্রেস নেতৃত্বের মহাশূন্যতা যেন চোখ টাটিয়ে দিল লহমায়। ক্যাপ্টেনকে সরিয়ে ১৯৬৩-তে জন্ম চরণজিৎ সিং চান্নির মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসলেন রাহুল, বলা হল ইয়ং মুখ, কংগ্রেস নাকি চাঙ্গা হবে। ভোটের লক্ষ্যে সিংকে সরানো, আবার অমরিন্দরকে পুরো হারানো যাবে না, তাই সিধুকে সিএম না করে চান্নিকে চেয়ার দেওয়া… কিন্তু হায় হায়…সিধুকে ভোলাতে চান্নিকে ঘোড়া চালাতে হচ্ছে। কিন্তু চান্নি কি পঞ্জাবের ঘোড়া চালাতে পারবেন? হাড়ে-হাড়ে ঘষা খেয়ে তো আগুন ছিটকোচ্ছে। যে নির্বাচনী তরি ভাসিয়ে রাখতে এত কিছু করলেন সনিয়া-রাহুলরা, সেই নৌকাটা ওই আগুনে খাক না হয়ে যায়! এ কূল, মানে অমরিন্দর, ও কূল মানে ভোট-- দুই-ই ফসকে না যায়!

মুষলপর্বের পাতা ওলটানো যাক। এই কাহিনি রচনা হচ্ছে মেঘালয়ে। সেখানে বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের মুকুল সাংমা তৃণমূলের দিকে পা বাড়িয়ে আছেন বলে খবর। মুকুল মেঘালয়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর পিছন পিছন আরও এক দল তৃণমূলের হাত ধরতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সূত্র বলছে, পিকে-র টিমের সঙ্গে তাঁদের কথাবার্তা চলমান। তৃণমূল তরফেই না কি অফার দেওয়া হয়, এখন মুকুল সাংমার কোর্টে বল। মেঘালয়ে কংগ্রেসের শক্তি ১৭, কত জন তাঁর সঙ্গে আসবেন, এবং এসে তৃণমূলকে জাতীয় পরিসরে আরও ডালপালা মেলতে সাহায্য করবেন, সেই দিকেই তাকিয়ে রয়েছে ঘাসফুল শিবির। কেন বিরুদ্ধ-সুরে মুকুল? জানা যাচ্ছে, মেঘ-রাজ্যে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সাংসদ ভিনসেন্ট পালাকে মানতে নারাজ সাংমাসাহেব। গত ২৫ অগস্ট পালাকে মেঘালয়ের সভাপতি করার পর থেকেই ক্ষোভ জানিয়ে চলেছেন তিনি, কংগ্রেস হাইকমান্ড বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু সে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে কি না, জানা নেই।

কংগ্রেসের সঙ্কট ঘনীভূত হয়ে রয়েছে রাজস্থানেও। হ্যাঁ, সেখানে মুষল নিয়ে দুই যোদ্ধা লড়াইয়ে। বুঝতেই পারছেন, অশোক গেহলট ও শচীন পাইলটের কথা বলছি। এখন গেহলৌতের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন বিএসপি-ত্যাগী ছয় বিধায়ক। ২০১৯ সালে এঁরা বিএসপি ছেড়ে কংগ্রেসে আসেন। কিন্তু এই যোগের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন মায়াবতী, তিনি হাইকোর্টে গিয়েছেন, সেখানে রায় বিরুদ্ধে যাওয়ায় গিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট এই ৬ জনকে নোটিস দিয়েছে। বলেছে, তাঁদের কংগ্রেসে যোগ দলত্যাগ বিরোধী আইনে যথার্থ কাজ কিনা, তা জানাতে হবে। রাজস্থানে বিধানসভায় ২০০ আসন। ১০১-এ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এই ছয় ছাড়া একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কংগ্রেসের থাকছে না, আসন নেমে আসছে ১০০-তে। আবার, এই ছয় জানিয়েছেন তাঁদের মন্ত্রিসভায় দুটি পদ চাই-ই চাই। যা আবার গেহলৌত দিতে চাইছেন না। মগের মুলুক নাকি-- এমনই তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। এখন ছয় ব্যক্তির বক্তব্য হল, যে দল তাঁদের বিধায়ক পদ বাঁচাবে, তাঁদের সমর্থনেই তাঁরা জিন্দাবাদ বলবেন। গেহলৌতের গোঁ, বিধায়কদের ভোজবাজি, পাইলটের প্রবল চাপ-- সনিয়া-রাহুল সানাইয়ে বেদনার সুর ধরেছেন বোধ হয়!

না, এখানেই শেষ নয় কংগ্রেসের মুষল-মানচিত্র। আছে ছত্তিশগড়। ২০১৮-তে সেখানে বিরাট জয় হয় কংগ্রেসের। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়ে টানাপোড়েন। রাহুলরা স্থির করেন, ভূপেশ বাঘেল আড়াই বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন, আড়াই বছর থাকবেন টি এস সিং দেও। যিনি এখন বাঘেল মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ইতিমধ্যে আড়াই বছর শেষ। কিন্তু ভূপেশবাবু ক্ষমতা ছাড়তে মোটেই রাজি নন। কুরসির আঠা বলে কথা, ছাড়ানো খুবই দুষ্কর। এক গুচ্ছ বিধায়ক দিল্লিতে গিয়ে হাইকমান্ডকে ভূপেশ-শক্তির বহর বোঝাচ্ছেন আপাতত। ছত্তীশগড়ে কংগ্রেসের ৭০ বিধায়ক, ভূপেশের সঙ্গে নাকি ৩৬-এর বেশি। তাই স্লোগান উঠেছে, কাকা (ভূপেশ) তুমি লড়াই করো, ৩৬ বিধায়ক সঙ্গে আছে। মুষলপর্ব সত্যি বলিউডের হিট ফিল্ম।

কেন কাঁটা বিদ্ধ কংগ্রেস

উত্তরটা এক কথায় নেতৃত্বের মহাসঙ্কট। ১৯-এর ভোটে বিপর্যয়ের পর রাহুল গান্ধি সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান। সনিয়া গান্ধি অন্তর্বর্তী সভাপতি হন কংগ্রেসের। কিন্তু এ ভাবে কত দিন চলবে? তাই নির্বাচিত পূর্ণসময়ের সভাপতির দাবি জোরদার। এই দাবি জানানো কংগ্রেসের বাগি নেতাদের দলকে বলা হয়ে থাকে জি-২৩। এর মধ্যে রয়েছেন, কপিল সিব্বল, মণীশ তিওয়ারি, গুলাম নবি আজাদ, আনন্দ শর্মা, শশী থারুররা। গত বছরের আগস্টে এমন দাবিতে এঁদের প্রথম পত্র-বোমাটি বর্ষিত হয়েছিল সনিয়ার জনপথে। কিন্তু কংগ্রেস সেই তিমিরেই, কালরাত্রি তাদের কাটছে না। গান্ধি কিংয়ের অলিন্দ থেকে বেরোতে পারছে না কং। খারাপ নেতৃত্ব বেহাল, মুষলরূপী আগ্নেয়গিরিটা খালি লাভা ঢালছে। জি-২৩ গ্রুপ এতে নিজেদের সাফল্য দেখছে, দেখবে না-ই বা কেন, একশো বার দেখবে! কপিল সিব্বল সাংবাদিক বৈঠক করে খোঁচাও দিয়েছেন। বলেছেন, আমরা জি-২৩, আমরা জি হুজুর-২৩ নই। আমরা ইস্যুগুলিকে তুলতেই থাকব। মানে, বিড়ম্বনার কারণ হতেই থাকব।

শেষে আবার মহাভারতের মুষলপর্বে ফিরছি। এই পর্বের শেষটা কী রকম? তখন কৃষ্ণের প্রয়াণকাল এসে গিয়েছে। তা বুঝতে পেরে কৃষ্ণ ইন্দ্রিয় সংযম ও মহাযোগ শুরু করলেন। তখন জরা নামে এক ব্যাধ হরিণ মনে করে তাঁর পায়ে তির ছুড়ে মারল। তার পরই কৃষ্ণের মৃত্যু হল।… কংগ্রেস এখন জরাগ্রস্ত। আচ্ছন্ন। কে বাঁচাবে তাকে? উত্তরটা ঝোড়ো হাওয়ায় হারিয়ে গিয়েছে বোধ হয়।

CONGRESS
Advertisment