সকাল থেকেই দেখছি, ঘূর্ণিঝড় আমফান এবং করোনাভাইরাসের জোড়া ছোবলে মৃতপ্রায় জামাইষষ্ঠীর বাজার, এ নিয়ে খবরের আধিক্য। প্রৌঢ় শ্বশুরমশাই থলে নিয়ে ভেটকি মাছ আর মিষ্টি দই কিনতে বাজারে যাচ্ছেন না জামাইয়ের ভূরিভোজনের উদ্দেশ্যে। তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেও বহু লোককে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখলাম। এ যেন এক মহা লোকসান। আমফানের পর থেকে যে বাজার বসাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে, বাজারে যাঁরা শাকসবজির যোগান দিতেন, সেই কৃষকরাই যে আজ পথে বসতে চলেছেন, তা মোটের ওপর উহ্যই থাকল।
এই ঘোর দুর্দিনেও যাঁদের বাড়িতে জামাইষষ্ঠী কিছুমাত্র হলেও পালিত হচ্ছে, তাঁদের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকেছে এতক্ষণে। অন্যান্য বছরের মতো পেট ঠেসে জামাইকে খাওয়াতে না পারার দুঃখটাও হয়তো মনের এক কোণায় ঠেলে দিতে পেরেছেন। এবার একবারের জন্যও যদি ভাবতে পারেন, এই উৎসবের আদৌ কী প্রয়োজন আজকের যুগে, তবে হয়তো দুঃখটা আরও একটু কমতে পারে।
আর জামাইষষ্ঠী আদৌ সমগ্র বাঙালির উৎসব কিনা, তা নিয়েও একটু ভাবতে পারেন। ছোটবেলা থেকেই আমার পূর্ববঙ্গীয় পরিবারে দেখে এসেছি, ষষ্ঠীর ব্রত উদযাপিত হতে। তবে তা সন্তানদের মঙ্গলকামনায়, জামাইদের নয়। বয়স এবং জ্ঞান বৃদ্ধি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানলাম, এপার বাংলায় ষষ্ঠী আসলে জামাইষষ্ঠী, এখানে সন্তানদের ভূমিকা পরোক্ষ, বিশেষত কন্যাসন্তানদের। যদিও কালক্রমে ওপার থেকে এপারে আসা বহু হিন্দু 'বাঙাল' পরিবারই জামাইষষ্ঠীকেও নিজেদের উৎসবের তালিকায় স্থান দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: আয় বন্ধ দু’মাসেরও বেশি! সঞ্চয় থেকেই মানুষের পাশে বাংলা বিনোদন জগৎ
নানারকম জ্ঞানগর্ভ তাত্ত্বিক লেখালেখি আছে এ বিষয়ে, হিন্দু পুরাণে ষষ্ঠী দেবীর প্রকৃত ভূমিকা এবং অবস্থান থেকে শুরু করে জামাইষষ্ঠী বা স্রেফ ষষ্ঠীকে ঘিরে দুই বাংলার নানা লোকায়ত প্রথা সম্পর্কে। এই সব আলোচনা একটু নেট ঘাঁটলেই সহজেই প্রাপ্ত, সুতরাং তা দিয়ে লেখা ভারী করার বাসনা নেই। এটুকু বলা যায়, কোনও পুরাণে বা তত্ত্বে জামাইদের সঙ্গে ষষ্ঠী ঠাকরুনের বিশেষ কোনও যোগ চোখে পড়েনি। থাকলেও চোখে পড়েনি, সন্তানের সঙ্গে যোগ বরং চোখে পড়েছে।
এবার একটু ইতিহাস না টানলেই নয়। জামাইষষ্ঠী বিষয়ে সামান্যতম চর্চা করলেও একটা কথা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায় - আন্দাজ অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে 'জামাইষষ্ঠী' উৎসব হিসেবে প্রাধান্য পেতে থাকে বাংলার ঘরে ঘরে, বিশেষত পদ্মার এপারে। পণ্ডিতদের মতে এর কারণ একটিই - তৎকালীন বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ এবং সতীদাহের যুগে জামাইয়ের দীর্ঘজীবনের প্রার্থনা, যাতে মেয়েকে বাল্যবৈধব্যের বা আগুনে পুড়ে মরার অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে না হয়।
দ্বিতীয় একটি কারণেরও উল্লেখ পাবেন কোথাও কোথাও। জামাই যাতে মেয়েকে কোনোরকম 'কষ্ট' না দেয়, তাই জামাইকে এই বিশেষ দিনে বিশেষ রকম তোয়াজ করে খুশি রাখা। বছরের অন্যান্য দিনে নিয়মমাফিক তোয়াজ, আর এই দিনটিতে গলা পর্যন্ত ঠেসে খাইয়ে বিশেষ রকমের তোয়াজ। মোদ্দা কথা, মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনেকানেক প্রয়াসের মধ্যে একটি।
প্রশ্নটা সোজা - আজও কি খুশি রেখেই চলতে হবে? এখনও কেন নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় নি আপনার কন্যাসন্তানের? বাল্যবৈধব্য আর নেই, সতীদাহ তো সেই ১৮২৯ সাল থেকেই নেই, তবে আজ জামাইদের জন্য বিশেষ দিন পালন করার কারণটা ঠিক কী? তর্কের খাতিরে বলা যেতেই পারে, যে কোনও বিশেষ দিনই অর্থহীন, তা সে বাবা-মায়ের জন্যই হোক বা সন্তানের জন্য। রোজই তো 'মাদার্স' বা 'ফাদার্স ডে'। এবং তর্কের খাতিরেই মেনেও নেওয়া যায় যে সেটা ঠিক। তবু, যেখানে 'বৌষষ্ঠী' পালনের রীতি নেই, বৌকে আলাদা করে খুশি করার কোনও প্রথা চালু হয় নি, সেখানে শুধু জামাইষষ্ঠী উদযাপন করা কিসের ইঙ্গিত বহন করে?
আজও কেন ভূরিভোজনের উদ্দেশ্যে ভেটকি বা ইলিশ কিনতে বেরোতে হয়? বছরে কেন, সপ্তাহে একদিন করেও তো জামাইকে বিশেষ খাবার খাওয়ানো যায়। খাওয়ানো হয়ও সম্ভবত অনেক বাড়িতেই। তবে কেন এই দিনটির উদযাপন?
শহুরে মানুষ ভাবতে ভালবাসেন যে তাঁরা গ্রামাঞ্চলের তথাকথিত নানারকম সংস্কারের হাত থেকে মুক্ত, প্রগতিশীল। কিন্তু জামাইষষ্ঠীর ক্ষেত্রে তো দুইয়ের মধ্যে তফাৎ দেখি না। জামাইকে পঞ্চান্ন ব্যঞ্জন রেঁধে খাওয়ানোর কৃতিত্ব, আড্ডা, হইহল্লার আড়ালে এখনও লুকিয়ে আছে সে কোন নিরাপত্তাহীনতা? 'মন পাওয়ার' প্রচেষ্টা?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন