নীলার্ণব চক্রবর্তী: গাড়ির বাজারের দিকে তাকালে চোখে জল আসে। সেই ক্লিশে কথাটা বেরিয়ে আসে, আবারও-- হাহা-car। সারা পৃথিবীতে এটা ঘোর বাস্তব। ফোর্ড ভারতে গাড়ি তৈরি বন্ধ করে দিচ্ছে, এটা চরম, অবশ্যই-- কিন্তু হাহা-car-এর তালিকাটা বেশ বড়। দিন কয়েক আগে, ফোর্ডের খবরটা অনেককে পেড়ে ফেলেছিল, আমিও তার মধ্যে-- এ কী হচ্ছে, এ কী হচ্ছে গো… এলিতেলি গাড়ি কোম্পানি তো নয়, ফোর্ড, এমন কি সম্ভব? হ্যাঁ, বিলক্ষণ সম্ভব, আর এটা মোটেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো কিছু নয়। আকাশ মেঘ-ভরা হয়ে ছিল বেশ আগে থেকে। বৃষ্টি যখন নেমেছে, তখন ঘাটাল কেস হয়ে গিয়েছে। তবে শুধু ফোর্ড নয়, তাবড় গাড়ি সংস্থায় সঙ্কট ঘনীভূত হয়ে রয়েছে। গড়গড়িয়ে আর চলছে না পৃথিবীর চাকা।
সেমিকন্ডাক্টর-কথা
ভারতে গাড়ি-সংকটের গহ্বরে নামার আগে একটু বিশ্ব-গাড়িতে নজর দেওয়া যেতে পারে। নজর দিতে হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টরে। কোভিড-কাল শুরুর কিছু পর থেকে মন্দার ছায়া পড়ছিল পৃথিবীতে, বহু কারখানায় তালা ঝোলে তাতে, বহু সংস্থা কর্মী ছাঁটাই করে বড় বড় কাঁচি দিয়ে। এর ফলে সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতেও ধাক্কা আসে জবরদস্ত। সেমিকন্ডাক্টর আধুনিক প্রযুক্তিতে অতি প্রয়োজনীয় একটি বস্তু। যাকে মেশিনের প্রাণস্পন্দনও বলা যায়। গাড়ি, ওয়াশিংমেশিন, স্মার্টফোন ইত্যাদি হাজারো যন্ত্র সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ ছাড়া চলবে না। কোভিডের আগে থেকেই এতে ক্রাইসিস তৈরি হয়েছিল।
ফাইভ-জি উত্থানপর্বে সেমিকন্ডাক্টরের চাহিদা হুহু করে বাড়তে শুরু করে, তাতেই এই ক্রাইসিসের জন্ম। তার উপর ২০২০ সালের মে মাসের মাঝামাঝি চিনা টেলিকম যন্ত্র নির্মাতা হুয়াওয়াইকে আমেরিকা সরকার কালো তালিকা ভুক্ত করে দেয়। এতে সে দেশের বহু সংস্থাকে হুয়াওয়াইয়ের অর্ডার বাতিল করে দিতে হয়। সঙ্কট বাড়তে থাকে। এর পর কোভিড। বেশ কয়েকটি চিপ কারখানার গণেশ উল্টে যায় মহামারিতে। এখন অর্থনীতি নিজের গতিতে ফিরছে, অন্য় অনেক কিছুর মতোই চিপের চাহিদাও হুহু বাড়ছে, কিন্তু কে দেবে চিপ, কে দেবে… সিদ্ধিদাতা উপর থেকে তাই অট্টহাস্য করছেন।
কবে কাটবে চিপ সঙ্কট
চিপ সঙ্কটে ডেট্রয়েটের কার নির্মাতারাও ঝামেলায় পড়েছে। মানে ফোর্ড, জেনারেল মোটর্সরা। জেনারেল মোটর্স, যাকে আদর করে বলা হয়, জিএম, বলে দিয়েছে, চিপ শর্টেজের জন্য উত্তর আমেরিকার ১৫টি কারখানায় দু'সপ্তাহের জন্য গাড়ি আর তারা গড়বে না। ফোর্ড মোটর্সও অত্যন্ত লাভজনক এফ-১৫০ পিক-আপ ট্রাক তৈরিতে পজ সুইচ টিপেছে। কানাডা, কানসাস সিটির কারখানায় অগস্টের শেষে খাঁড়া নামে। ডিয়ারবর্ন ট্রাক কারখানায়, যেখানে ওই এফ-১৫০ ট্রাক তৈরি হয়, সেখানেও তিন শিফটের বদলে এক শিফটে কাজ করার সিদ্ধান্ত গত মাসের শেষে জানায় ফোর্ড। নিশান, ভোক্সওয়াগেন, স্টেলান্টিস, টয়োটা, স্ক্যানিয়া এবি, মাজদা এবং সুবারুর মতো অটো কম্পানিও গাড়ি নির্মাণ কমিয়েছে এক ধাক্কায় অনেকটাই।
আইএইচএস মার্কিটের সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই ত্রৈমাসিকে চিপ শর্টেজের জন্য ৭ লক্ষ গাড়ি কম তৈরি হয়েছে সারা পৃথিবীতে। ব্লুমবার্গ বলছে, এই বছরের শেষে এর জন্য ক্ষতিটা গিয়ে পৌঁছতে পারে ৬১ বিলিয়ন ডলার বা ৬,১০০ কোটি ডলারে। তবে একেবারে যে ঘোর অমানিশা, তা বলা যাবে না। কারণ, চিপ তৈরিতে বিনিয়োগ আবার হচ্ছে। যেমন কয়েক দিন আগেই ইউরোপে চিপ কারখানা গড়তে ৯৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে ইন্টেল। তারা এও জানিয়েছে, অ্যারিজোনার চ্যান্ডলারে ২০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে দুটি সেমিকন্ডাক্টর তৈরির কারখানা খুলবে খুব তাড়াতাড়ি। এ পথে ক্রমমুক্তির সন্ধান করছে আইবিএমের মতো সংস্থারাও। তবে এই সঙ্কট কাটার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না রাতারাতি, একটা ধোঁয়াশা বজায় থাকছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দুর্যোগ কাটতে কাটতে ২০২৩ হয়ে যাবে। এর মধ্যে কত গাড়ির কারখানায় যে পটল তুলবে কেউ বলতে পারে না।
এবার আসি ভারতের চাকায়
ভারতে ফোর্ড যে তাদের নির্মাণে ইতি ঘটিয়েছে, তাতে সরাসরি চিপ ক্রাইসিস নেই। ফোর্ড জানিয়েছে, গত ১০ বছরে ভারতে গাড়ির ব্যবসায় তাদের নাকি ক্ষতি হয়েছে ২০০ কোটি ডলার। এক ২০১৯ সালেই এই ক্ষতিটা ৮০ কোটি ডলারের মতো। তার উপর এখানে মাহীন্দ্রা অ্যান্ড মাহীন্দ্রার সঙ্গে ফোর্ডের অংশিদারিত্ব আরেকটি বড় ভুল। বলা হচ্ছে, কুড়ি বছরের বেশি ভারতযাত্রায় ফোর্ড এর চেয়ে বড় মর্মান্তিক পদক্ষেপ নাকি নেয়ইনি। এর পর কোভিড-কাণ্ড। চিপ-হাহাকারের মধ্যে এতগুলো ধাক্কা সইতে না পেরে ফোর্ড ভারত থেকে পাততাড়ি গোটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা ছাড়া, এখন যেহেতু ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির দিকেই এই সব বড় সংস্থা নজর দিচ্ছে, সেই খাতে তারা বিনিয়োগ করবে বলে বড় বড় ঘোষণা করেছে, ভারতে ইলেকট্রিক ভেইক্যলের বাজার তৈরিতে এদের নজর।
পুরনোকে তা-ই সায়োনারা জানাতেই হত, এবং সেটাই হয়েছে। তবে, এর জন্য চাকরি যাচ্ছে অনেকের, সংখ্যাটা মোটামুটি ৪ হাজার, রিস্ট্রাকচারের মাধ্যমে বেশ কিছু কর্মীর নয়া বন্দোবস্ত অবশ্য করছে ফোর্ড। অনিশ্চয়তায় তাঁদের থাকতেই হবে, কী বা উপায়! ফোর্ডের অবশ্য কিছু এসে যায় না তাতে, বরং ক্ষতিবহুল নির্মাণ বন্ধ করে তারা এখন অসীম স্বস্তির শ্বাস ফেলছে। ফোর্ডের মতো হেভিওয়েট কোনও গাড়ি নির্মাণকারীর ভারত-ত্যাগ চিন্তার ব্যাপার, কিন্তু এটাই প্রথম নয়। গত বছর, ভারত থেকে সরেছে হার্লে ডেভিডসন এবং ২০১৭ সালে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে ডেট্রয়েটের আর এক দাপুটে জেনারেল মোটর্স।
কেন কম বিক্রি
এখানে একটা কথা বলে নিতে হবে। ভারতে সস্তা গাড়ির ছড়ানো বাজার। জিএম বা ফোর্ডের গাড়ির দাবি অনেক বেশি। তাই পড়ে পড়ে সে সব গাড়ি মাছি তাড়ায় বৈকি! হিসেব সেটাই বলছে স্পষ্ট করেই। এই দুটি সংস্থা এ দেশের প্যাসেঞ্জার ভেইক্যল মার্কেটের মাত্র ৬ শতাংশে ছিল। জেনারেল মোটর্স চলে যাওয়ার পর, এই যে এখন ফোর্ড যাচ্ছে তাতে ভারতের গাড়ির বাজারে ২ শতাংশের চেয়ে কম প্রভাব পড়বে। আর পৃথিবীর এক নম্বর গাড়ি বিক্রেতা ভোক্সওয়াগনের মার্কেট শেয়ার এ দেশে মাত্র এক শতাংশ। গ্লোবাল লিডারদের মধ্যে বলা যায় একমাত্র টয়োটাই সফল, তাদেরও মার্কেট শেয়ার মাত্র ৩ শতাংশ।
এক লাখি গাড়ি তৈরি করে সাধারণকে গাড়িওয়ালা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন রতন টাটা। তার স্বপ্ন প্রায় নিষ্ফল। সিঙ্গুরে তো একেবারে ল্যাজেগোবরে কেস হয়েছিল ওদের। আবার, ফোর্ড-জিএমের গাড়িও দামের রাজ্যে চরমে, নিরুপায় হয়ে মানে-মানে কেটে পড়তে হচ্ছে। এ সব থেকে জলের মতো পরিষ্কার, মজঝিম পন্থায় রয়েছে আমার-আপনার ভারত, অবশ্য ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে মাঝের পথ ধরাটা ভাল কি না জানা নেই।
ফিরে এসো ফোর্ড, বললে তারা শুনবে কি না তাও অজানা...