নীলার্ণব চক্রবর্তী: বাড়ির সামনের রাস্তায় এক কোমর জল। বাড়ির একতলাও জলে ঢাকা। এমন বৃষ্টি আগে কখনও দেখেছি কি না মনে পড়ছে না! ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিকে শাপশাপান্ত করছিলাম, রাস্তা দিয়ে জলমগ্ন গেরুয়াধারী এক পথিক আর্তনাদ করে উঠলেন-- মহাপ্রলয়, কোথায় পালাবি, শেষের দিন এসে গেছে যে, ভয়ঙ্কর…। সত্যি, একটা ভয় হচ্ছে বটে। উষ্ণায়নের দাঁতনখে মেঘচেরা এমন অঝোর বৃষ্টি, লাগাতার হতে থাকলে তো জলস্তর বেড়ে যাবে। বহু এলাকা জলের তলায় অচিরেই চলে যাবে। তা ছাড়া এখন যদি বা বেঁচে যাই, তা হলে আগামী দশকের মাঝামাঝি সলিল সমাধি থেকে রক্ষা নেই। চাঁদ ও উষ্ণায়নের যৌথ কারসাজিতে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় বন্যার আশঙ্কার কথা যে শুনিয়ে দিয়েছে স্বয়ং নাসা। এ সব ভাবতে ভাবতে মেরুদণ্ড দিয়ে হিমস্রোত বয়ে যাচ্ছিল… এখন কী করিতে হইবে, বাঁচার কোনও উপায় আছে কি?
পৃথিবীকে ঠান্ডা করতে হবে, এটাই উপায়। কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে অনেক গুণ। গ্রিনহাউস গ্যাসের মাথার দিকটা না পারি, ল্যাজাটা কেটে দিতে হবে অনেকটা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বিদ্যুদ্বেগে। পৃথিবীর পথে পথে যে গাড়ির সমুদ্র, তা হাল্কা করে দেওয়াটা একটা পথ হতে পারে। কিন্তু সেটি তো অমোঘ অসম্ভব, বিকল্প পথ-- পেট্রোল-ডিজেলের বদলে রাস্তা ভরিয়ে তোলা ইলেকট্রিক গাড়িতে। এবং সেই রাস্তাতেই ডেন বানাতে চান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ২০৩০ সালের মধ্যে ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করে তিনি এগজিকিউটিভ অর্ডার জারি করেছেন। বিগ থ্রি গাড়ি নির্মাতা-- জেনারেল মোটর্স, ফোর্ড মোটর্স, স্টেলান্টিস (স্টেলান্টিসের আগে নাম ছিল ফিয়াট ক্রিসলার, মিশিগানের শহর ডেট্রয়েটে এই তিনটি কোম্পানির গাড়ি তৈরির কারখানা) এই লক্ষ্যে আগে থেকেই পাড়ি জমিয়েছেন।
ফোর্ড সম্প্রতি জানিয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরিতে ২২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। জেনারেল মোটর্স বলেছে, এই সময়ের মধ্যে তারা করবে ৩৫ বিলিয়ন ডলার। আর স্টেলান্টিস বলছে, ২৫ সালের মধ্যে তারা ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরিতে ঢালবে ৩৫.৬ বিলিয়ন ডলার। এরা ছাড়া, ক্যালিফোর্নিয়ার গাড়ি নির্মাতা টেসলা তো আছেই, যাদের মূল মন্ত্রটাই হল ইলেক্ট্রিক গাড়ি নির্মাণ (নতুন পলিসির দৌড় শুরু উপলক্ষে হোয়াইট হাউসে বাকিরা ডাক পেলেও, টেসলা পায়নি)। যা হোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রেসি়ডেন্ট বাইডেন কেন এই ইলেক্ট্রিক পথে কোমর বাঁধলেন?
কেন ইলেক্ট্রিক-পথে বাইডেন?
বারাক হুসেন ওবামা উষ্ণায়ন রোধের রাস্তায় হেঁটেছিলেন জোর কদমে। ২০১২-এ অগস্টে ওবামা কড়া ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ২০২৫ সালের মধ্যে গাড়ির জ্বালানি মাইল পিছু সর্বাধিক ৫৪.৫ গ্যালনে বাঁধার নির্দেশিকা জারি করে তাঁর সরকার। এ নিয়ে অটোমেকারদের মধ্যে তৈরি হল বিভাজন। অনেকেই বলতে শুরু করেন, ওবামার বাঁধা লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব প্রায়। এর পর, ২০২০ মার্চে ওবামার নীতি রোলব্যাক করেন ট্রাম্প। বাইডেন ফের হাঁটতে শুরু করেছেন বারাকের রাস্তায়। না হেঁটে হয়তো উপায়ও ছিল না। কারণ, পরিস্থিতি চরমে পৌঁছছে। ২০১৯ সালের হিসেবে মার্কিন মুলুকের মোট গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের ২৯ শতাংশের জন্যই দায়ী যানের দাপট। সেখানে কিন্তু ইলেক্ট্রিক গাড়ির বাজারটা বড়ই ছোট। ইলেকট্রিক গাড়ি বা ইলেকট্রিক ভেইক্যল (ইভি) নির্মাণে সে দেশ তৃতীয়, আর বিক্রিতে অনেক পিছিয়ে যোজন।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউরোপ দশ গোল দিয়েছে আমেরিকাকে। গত বছরের হিসেবে, এ ক্ষেত্রে এক নম্বরে নরওয়ে। নরওয়েতে যা গাড়ি বিক্রি হয়েছিল ২০২০-তে, তার তিন ভাগের দু'ভাগই ইলেকট্রিক ভেইক্যল, এর পর আয়ারল্যান্ড। সেখানে বিক্রি হওয়া গাড়ির অর্ধেকটাই ইলেকট্রিক। আর আমেরিকা… সেখানে এই বিক্রি ২ শতাংশ মাত্র। ওবামা সরকার ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১০ লক্ষ ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল, কিন্তু তা থেকে অনেক দূরে থামে মার্কিন মুলুক। ২০১৬-র জানুয়ারিতে রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, ওবামা নির্ধারিত সময়কালে ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রি হয় মাত্র ৪ লক্ষ।
অন্য একটি সমীক্ষা বলছে, কোভিডে ২০২০ সালে মোট গাড়ি বিক্রি সেখানে ২৩ শতাংশ কমেছে, এর মধ্যে ইলেকট্রিক গাড়ির বিক্রি কমেছে ১১ শতাংশ। অনেকে বলছেন, আমেরিকার বড় কারমেকাররা যেমন, তেমনই ডেইমলারের (মার্সিডিজ বেনজ নির্মাতা) মতো জায়েন্ট জার্মান কার-নির্মাতাও বিরাট অঙ্কের অর্থ ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরিতে ঢালবে বলে জানিয়েছে। জুলাইয়ের ২২ তারিখে ডেইমলারের ঘোষণা, ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতা টেসলার সঙ্গে টক্কর নিতে তারা এ ক্ষেত্রে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। ফলে, বাজারে যেভাবে ইভি তৈরির জোয়ার আসছে, এবং তীব্র লড়াই শুরু হচ্ছে, তাতে আমেরিকাকে ঝাঁপিয়ে না পড়লে চলবে না। নিজেদের কারখানায় তৈরি গাড়ির বিক্রি বাড়াতে হবে অনেক, দেশেই তো বিশাল বাজার পড়ে রয়েছে, ফলে তা-ই টার্গেট।
আর সে কারণেই ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রির লক্ষ্য তুলে ধরলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তা না হলে বেকারত্বের ধাক্কা সুনামি হয়েও তো উঠতে পারে, মানে সেই আশঙ্কাও রয়েছে। কারণ, গাড়ি বিক্রি না হলে ইভি-মেকাররা তো লোকজনকে বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দেবে না, হবে ছাঁটাইয়ের দুরন্ত অভিযান। এমনিতেই কোভিডে অর্থনীতি দারুণ টলোমলো, বহু সংস্থা কর্মী ছাঁটাই করে ফেলেছে। ইনস্টিটিউট অফ সাপ্লাই ম্যানেজমেন্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, জুলাইতে নির্মাণ ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ১৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। নির্মাণ ক্ষেত্রের ঘনীভূত সঙ্কট কাটাতে কয়েক দিন আগে বাইডেন বাই-আমেরিকান ডাকও দিয়েছেন। মানে, হে আমেরিকাবাসী, দেশের মাল কিনুন। আগের নিয়মে, ৫৫ শতাংশ পণ্য যেমন সরকারি গাড়ি ইত্যাদি মেড-ইন আমেরিকা হতে হত, বাইডেন তা বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ করতে বলছেন এখনই। আর ২০২৯-এ গিয়ে তা ৭৫ শতাংশে নিয়ে যেতে চান। 'বাই আমেরিকান, শূন্য প্রতিশ্রুতি হয়ে উঠেছিল, তা বাস্তবে পরিণত করবে আমাদের সরকার।' বলছেন জো।
বাইরের বাজারটা কেমন?
আমেরিকার বাইরের বাজারটাও ভাল নয়। গাড়ি বিক্রি ব্রিটেনে তলানিতে এসে পৌঁছেছে। ১৯৯৮ সালের পর সেখানে এই বিক্রিবাটা সবচেয়ে কম হয়েছে জুলাইতে। ভারতের বাজারও মোটেই ভাল নয়। তা ছাড়া এ দেশে এখনও ইলেকট্রিক গাড়ির তেমন কোনও চাহিদা প্রায় নেই। এখনও ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রি এখানে এক শতাংশেরও নিচে। হুন্ডাই বলছে, আগামী তিন বছরেও এক শতাংশ স্পর্শ করতে পারবে না এ দেশের ইভি বিক্রির হার। আসলে ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রির বড় প্রতিবন্ধকতা হল, গাড়ি চার্জ দেওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামোর ভয়ানক অভাব। আমেরিকাতেও তা খুব একটা যে ভাল, তা নয়। চার্জ দেওয়ার সমস্যার জন্য সেখানে ইলেকট্রিক গাড়ি ধাক্কা খাচ্ছে সেখানেও।
কিছু দিন আগে টেসলার সিইও এলন মাস্ক জানিয়েছেন, তাঁদের সুপারচার্জার নেটওয়ার্ক অন্যদের তৈরি ইভি-র জন্যও খুলে দেওয়া হবে। সারা পৃথিবীতেই এই সংস্থাটির সুপার চার্জার রয়েছে ২৫ হাজার, যা আশার ক্ষীণ আলো দেখাচ্ছে মাত্র। আমেরিকা ধাক্কা খেয়ে শিখেছে, বাইডেনের স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও, ট্রাম্পের নীতি থেকে সরে তিনি রুপোলি রেখার জন্ম দিয়েছেন, ভারত ঠেকতে ঠেকতে, দূষণের অন্ধকূপে থেকেও কবে শিখবে সে জন্য আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে জানা নেই।