গত সপ্তাহে আমরা স্বাস্থ্যের উপর গুটখা, পানমশলা ইত্যাদি তামাকজাত পদার্থের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম, যেগুলো চিবিয়ে বা চুষে খাওয়া হয়। ধূমপান বিষয়ে দু-এক কথা না বললে তামাকের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তামাক ও নিকোটিনের চরিত্র, জৈবরাসায়নিক কার্যপ্রণালী, নেশা ও নির্ভরশীলতার জন্ম এবং ক্যান্সার সৃষ্টি করার পথ সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে আগের সপ্তাহেই। সেসব কথার পুনরাবৃত্তি না করে তার পর থেকে শুরু আজকের কথাবার্তা।
ধূমপানের ইতিহাস অতি দীর্ঘ। এই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধর্ম, বাণিজ্য, শোষণ, রাজনীতি, এমনকি চিকিৎসাও। আজ থেকে অন্তত সাত হাজার বছর আগে মানুষ ধূমপান করত, তার প্রমাণ আছে। সম্ভবত আরও আগে চলত এই অভ্যাস। প্রাগৈতিহাসিক ও প্রাচীন যুগে ধূমপান ছিল কিছু ধর্মীয় আচারের অংশ। বিশেষ 'শমন' ঘরানার কিছু ব্যক্তি ধূমপানের সাহায্যে একটি তুরীয় অবস্থায় পৌঁছে প্রেতাত্মাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করতেন। এই পদ্ধতিতে তাঁরা মানুষের যেসব সমস্যার সমাধান করতে পারেন বলে দাবি করতেন, তার মধ্যে ছিল রোগ নিরাময়ও।
আরও পড়ুন: গুটখা, স্বাস্থ্য ও রাজনীতি
পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে সামাজিকভাবে ধূমপানের প্রচলন হয়। সম্পর্ক পাকা করার সময় সবাই মিলে ধূমপান করার চল ছিল অনেক জায়গায়। ক্রমশ ধূমপান হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত বিনোদনের পদ্ধতি। হুঁকো, বং, পাইপ, থেকে চুরুট, সিগারেট, বিড়ি… নানা রূপে তামাকের ধোঁয়া মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
একথাও বলে রাখা প্রয়োজন যে ধূমপানের ইতিহাসের পুরোটাই তামাক সংক্রান্ত নয়। পৃথিবীর সর্বত্র তামাক জাতীয় গাছ পাওয়াও যেত না। গাঁজা, আফিম সহ বিভিন্ন ভেষজপাতা ধূমপানের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে আমাদের আলোচনা আবর্তিত হবে তামাকের ধোঁয়ার রিংয়ের পরিধি বরাবর।
তামাক গোত্রের বেশিরভাগ গাছ স্বাভাবিকভাবে জন্মাত দুই আমেরিকায়, বাকি অল্প কয়েকটি অস্ট্রেলিয়াতে। সর্বাধিক জনপ্রিয় 'নিকোটিয়ানা ট্যাবাকাম' দক্ষিণ আমেরিকা থেকে পাওয়া, আরও বেশি কড়া তামাক 'নিকোটিয়ানা রাস্টিকা' উত্তর আমেরিকার। ওই মহাদেশের আদি বাসিন্দারা ধূমপান করতে, দাঁতের মাজন হিসেবে, ঘরে ধুনো দিতে, কীটনাশক হিসেবে এবং ওষুধ হিসেবে তামাক পাতা ব্যবহার করতেন। কলম্বাস ও তাঁর সঙ্গীরা এই পাতাটির ব্যবহার লক্ষ্য করেন এবং পাতাটিকে ইউরোপে নিয়ে আসেন। ১৫৫৬ সাল নাগাদ এক ইংরেজ নাবিককে তামাকের ধোঁয়া পান করতে দেখা যায়।
১৫৬০ সালে জঁ নিকোট ফ্রান্সে তামাক পাতাকে জনপ্রিয় করেন। 'নিকোটিন' কথাটি এসেছে তাঁর নাম থেকেই। সেই সময় ইউরোপের চিকিৎসা মহলে গাছপালার ঔষধি-গুণ নিয়ে প্রবল আগ্রহ। তামাক অল্পদিনের মধ্যেই একটি সর্বরোগহর মহৌষধি হিসেবে প্রচার পায়। এ যেন ইতিহাসের মশকরা। আজ যা চরম ক্ষতিকর পদার্থ হিসেবে সর্বত্র নিন্দিত, আধুনিক চিকিৎসার জন্মলগ্নে, আধুনিক চিকিৎসার জন্মভূমিতে সেই তামাক ঐশ্বরিক ভেষজ হিসেবে নন্দিত ছিল।
আরও পড়ুন: বর্ধমানে ডাক্তার ও তাঁর স্ত্রীর উপর হামলা: গভীর অসুখের বার্তা
ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব বুঝতে লেগে গেল দীর্ঘদিন। কেমন ক্ষতি করে ধূমপান বা তামাকের নেশা? পরিমাণের নিরিখেই দেখা যাক প্রথমে। একবিংশ শতকের শুরুতে হিসেব করে দেখা গিয়েছিল, একা তামাকই প্রতি বছর ত্রিশ লক্ষ মৃত্যুর জন্য দায়ী। ২০৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তামাকজনিত বাৎসরিক মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি। দুনিয়া জুড়ে মানুষের রোগ ও মৃত্যুর পয়লা নম্বর প্রতিরোধযোগ্য কারণ হল তামাক। তামাকজাত ধূমপানের ফলে হৃদরোগ, মস্তিষ্কের স্ট্রোক, ক্রনিক ব্রংকাইটিস ও এমফাইসিমা জাতীয় ফুসফুসের রোগ এবং বহুরকম ক্যান্সারের সম্ভাবনা লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।
তামাক পোড়ানো ধোঁয়ার মধ্যে নিকোটিন সহ প্রায় চার হাজার রকমের রাসায়নিক থাকে। এর মধ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পলিসাইক্লিক অ্যারোমাটিক হাইড্রোকার্বন, টোব্যাকো স্পেসিফিক এন-নাইট্রোস্যামাইন ও অন্য কিছু সমধর্মী যৌগের কথা আগের পর্বে উল্লেখ করা হয়েছিল। এদের পাশাপাশি থাকে এমন বেশ কিছু রাসায়নিক যা শ্বাসনালী ও ফুসফুসের ঝিল্লিতে জ্বালা বা প্রদাহ সৃষ্টি করে, যেমন অ্যাক্রোলিন, অ্যামোনিয়া, বেঞ্জিন, অ্যাসিটোন, অ্যাসেটিক অ্যাসিড, ফর্ম্যালডিহাইড। এরা শ্বাসনালী ও ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে থাকে। নিয়মিত ধূমপান করলে রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা নানাভাবে ক্ষতিকর।
ধূমপানের আনন্দ, নেশা, স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির জন্য দায়ী মূলত নিকোটিন। ধূমপানের পর নিকোটিন দ্রুত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। অল্প পরিমাণে নিকোটিন স্নায়ু ও মস্তিষ্ককে উত্তেজিত বা চাঙ্গা করে। বেশি পরিমাণে নিকোটিন তাড়াতাড়ি মস্তিষ্কে পৌঁছলে ঝিমুনি ধরায়। অতিরিক্ত পরিমাণে তা মাথা ঘোরা, বমি ভাব সৃষ্টি করতে পারে।
হৃদস্পন্দনের গতিবৃদ্ধি, রক্তচাপ বৃদ্ধি, ধমনির দেওয়াল মোটা হয়ে যাওয়া, তার মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া (থ্রম্বোসিস) এবং তজ্জনিত হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের (ব্রেন অ্যাটাক) জন্যও দায়ী মূলত নিকোটিন। তা সত্ত্বেও সিগারেটের নেশা ছাড়ানোর জন্য নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (অর্থাৎ নিকোটিন-যুক্ত চিউয়িং গাম বা চামড়ায় লাগানো প্যাচ) ব্যবহার করা হয় অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিকগুলোর হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য।
আরও পড়ুন: দীপাবলির সুখ ও অসুখ
ইউরোপে এবং মূলত ইউরোপীয় বণিকদের হাত ধরে এশিয়া ও আফ্রিকায় তামাক ও ধূমপান যখন জনপ্রিয় হচ্ছে, সেই সময়েই ধূমপানের বিরোধিতাও শুরু হয়েছে। ক্ষতির দিকটাও মানুষের নজরে আসছিল, বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা না গেলেও। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে তামাকের দিগ্বিজয় রুখে দেওয়ার চেষ্টাও শুরু হয় সপ্তদশ শতাব্দীতেই। ১৬০৪ খ্রিষ্টাব্দে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের রাজা জেমস (স্কটল্যান্ডে ষষ্ঠ ও ইংল্যান্ডে প্রথম জেমস নামে পরিচিত) তামাক বিক্রির উপর চার হাজার শতাংশ শুল্ক ধার্য করেন, কিন্তু তাঁর এই তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
অটোমান সম্রাট চতুর্থ মুরাদ প্রথম তামাক নিষিদ্ধ করেন। তার কয়েক বছরের মধ্যে ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মিং বংশের শেষ সম্রাট ঝু ইউজিয়ান চীন দেশে তামাক ব্যবহার ও বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ক্যাথলিক চার্চও ধূমপানকে পাপ বলে চিহ্নিত করেছিল। ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে পোপ সপ্তম আর্বান স্পষ্ট ভাষায় তামাকজাত ধূমপানের নিন্দা করেন। ১৬৩৪ সালে মস্কোর চার্চ রাশিয়ায় তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
পরবর্তীকালে বহু জায়গায় চিকিৎসক ও নাগরিকদের তরফে তামাক বিরোধী আন্দোলন হয়েছে। আমেরিকায় তামাকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করেন ডঃ বেঞ্জামিন রাশ, ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে। আন্দোলন হয়েছে জার্মানিতে। ইংল্যান্ডে ১৯৫০ সালে রিচার্ড ডোল ধূমপান ও ফুসফুসের ক্যান্সারের মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে আমেরিকায় চিকিৎসকেরা তামাকজাত পদার্থ নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেন। ক্রমশ প্রমাণিত হয় স্বাস্থ্যের উপর তামাকের অজস্র কুপ্রভাব।
তবু তামাকের বিশ্বজয় রোখা সহজ হয়নি। তার কারণ, তামাকের অর্থনীতি।
আমেরিকায় ভার্জিনিয়া অঞ্চলে প্রথম ব্রিটিশ উপনিবেশ জেমসটাউনের পত্তনের পরেই বাণিজ্যিকভাবে তামাক চাষ শুরু হয়। অতি লাভজনক হয়ে ওঠে তামাক ব্যবসা। লণ্ডনের ভার্জিনিয়া কোম্পানি সোনার সন্ধানে গিয়ে যত লোকসান করেছিল, তার সবটা উসুল করে লাভের মুখ দেখে তামাক বিক্রি করে।
প্রথমে ভারতের নীলচাষের মতোই দাসপ্রথার ওপর নির্ভর করে হতো তামাকের চাষ। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আইন হওয়ার পর আইনের ফাঁক দিয়ে বিভিন্ন চুক্তির ভিত্তিতে অতি কম বেতনে শ্রমিক নিয়োগ করা শুরু হয় উপনিবেশগুলোতে। ১৬৭৬-৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ভার্জিনিয়াতে গভর্নর উইলিয়াম বার্কলে'র বিরুদ্ধে নাথানিয়েল বেকনের নেতৃত্বে বিদ্রোহ এবং ১৭৬৫-৭৩ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ এই তামাক উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব ফেলে।
আরও পড়ুন: ‘তাতে আমার কী?’ বলার সময় শেষ
বেকন বিদ্রোহের পর চুক্তির ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগে সমস্যা বাড়ায় কালো চামড়ার মানুষদের দাস হিসেবে শ্রম করানোর প্রবণতা বাড়ে। আমেরিকা স্বাধীন হওয়ার পর দাসপ্রথা-নির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়া অলাভজনক সাব্যস্ত হয়, কিন্তু পরবর্তীকালে আবার তা ফিরে আসে। ১৮৬০-এর বিদ্রোহের পর স্থায়ীভাবে এর পরিবর্তন হয় এবং মার্কিন তামাকের ক্ষেতে ভাগচাষ প্রথার প্রচলন হয়।
পুরো সময়টা জুড়ে নানা কৌশলে তামাক উৎপাদক সংস্থাগুলি বিপুল মুনাফা অর্জন করতে থাকে। বিশ্ব জুড়ে তামাকের বাজার প্রসারিত হয়। ভারতের মতো দেশে ব্রিটিশ সরকার গাঁজা জাতীয় প্রাচীন ধূমপানের বস্তু নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করায় তামাকের বাজার উন্মুক্ত ও লাভজনক হয়ে ওঠে।
এভাবে মার্কিন তথা বিশ্ব অর্থনীতিতে চুরুট ও সিগারেট কোম্পানিগুলি ক্ষমতার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। যেভাবে বিভিন্ন পেট্রলিয়াম কোম্পানি অর্থবলে পরিবেশ দূষণ বিরোধী আন্দোলনকে প্রশমিত করছে, সেই কায়দায় এই কোম্পানিরা দীর্ঘ সময় তামাক-বিরোধী আন্দোলনকে দমিয়ে রেখেছে। তামাকের ক্ষতিকর দিকগুলো যত স্পষ্ট হয়েছে, ততই এরা অর্থের জোরে কিছু বিজ্ঞানজীবী ও বুদ্ধিজীবীকে নিয়োগ করে কুযুক্তির মাধ্যমে সরকার ও সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে তামাক ততটা ভয়ঙ্কর কিছু নয়।
পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের বিভিন্ন দেশে গুটখা ও পানমশলা নিষিদ্ধ হলেও এখনও বেআইনি নয় সিগারেট, চুরুট, বিড়ি ইত্যাদি। আঠারো বছরের কম বয়সীদের কাছে এসব বিক্রি করা নিষিদ্ধ হয়েছে বা সিগারেটের খাপে ভয় পাওয়ার মতো ছবি এঁকে স্পষ্টভাবে ক্যান্সার ও মৃত্যুর কথা লিখতে বাধ্য করা হচ্ছে, এটুকু অন্তত ভালো। এই অর্জনটুকুও এসেছে বহু কঠিন পথ পেরিয়ে।
নিষিদ্ধ করতে না পারার অন্যতম বড় কারণ অর্থনৈতিক। আইটিসির মতো বড় তামাক কোম্পানির পাশাপাশি ভারতে বিড়ি শিল্পও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিড়ি বাঁধা একটি কুটিরশিল্প, যার উপর দাঁড়িয়ে আছে কিছু জেলার অর্থনীতি। গ্রামাঞ্চলের বহু মানুষের গ্রাসাচ্ছাদন হয় এর থেকে। তাছাড়া বিড়ি তৈরি করতে তামাক ছাড়াও লাগে যে তেন্দুপাতা, তা সরবরাহ করে পেট চালান বহু আদিবাসী পরিবার। সুতরাং দুম করে এই পুরো ব্যবস্থাটাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কোনো সরকারের পক্ষে নেওয়া কঠিন। তা বলে একটি ক্ষতিকর বাণিজ্যকে উৎসাহ জুগিয়ে যাওয়াও সরকারের কর্তব্য নয়, বিশেষত জনস্বাস্থ্যের দায় যেহেতু শেষ অবধি সরকারের উপর বর্তায়।
এসব শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের বিকল্প রুজির সংস্থানের কথা ভাবা প্রয়োজন, কিন্তু সেই উৎসাহ সরকারের আছে কি? ব্রিটিশ আমল থেকে সিগারেট সহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্য বিক্রি থেকে সরকার বিপুল রাজস্ব আয় করে থাকে। স্পষ্টত, তারা এই রাজস্ব হারাতে চায় না। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী একবার রাজকোষ ভর্তি করার জন্য জনগণকে বেশি করে সিগারেট খাওয়ার কথাও বলে ফেলেছিলেন, যা মোটেই দায়িত্বশীল কাজ হয় নি। অসতর্ক মুহূর্তেও একজন মুখ্যমন্ত্রী এমন কথা বলতে পারেন না, বিশেষত তিনি যখন নিজেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
জনসাধারণের মধ্যেও রয়েছে নানারকম বিভ্রান্তি। অনেক শিক্ষিত মানুষই বলেন, সিগারেট খেলেই মারা যায় নাকি? কই অমুকে তো সিগারেট খেয়েও দিব্বি বেঁচে আছে আর তমুকবাবু কোনো নেশা না করেও হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন! এটি কুযুক্তি, যা কৌশলে আমাদের মাথায় ঢোকানো হয়েছে। মাঝরাস্তা দিয়ে হাঁটলেও সবাই গাড়ি চাপা পড়ে না, কিন্তু পড়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। ধূমপানের ক্ষেত্রেও তেমন, এবং এই সম্ভাবনা বৃদ্ধির কথা বহু গবেষণা ও সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।
আরও পড়ুন: গরুর কুঁজে সোনা, কুকুর খাও, কেন বলেন দিলীপ ঘোষ?
কিছু ক্ষেত্রে সিগারেটকে সংস্কৃতি ও বিপ্লবের সঙ্গে একাকার করে মহিমান্বিত করার চেষ্টা হয়েছে, যাকে বিপ্লব, সমাজসেবা, কবিত্ব ইত্যাদির অপমান বলা যেতে পারে। বিড়ি-সিগারেট ছাড়াও এই প্রতিটি কাজই সাফল্যের সঙ্গে করা সম্ভব। স্বাধীনতা, বিশেষত নারী স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবেও ধূমপানকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে বারবার। বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় দৈনিকে সুদক্ষ কলমে মহিলা সাহিত্যিকেরা এই মর্মে দীর্ঘ প্রবন্ধ ও স্যাটায়ার-ধর্মী রচনা লিখেছেন। এইসব প্রচেষ্টাকে তাঁরা নিজেরাই একবার ভালো করে খতিয়ে দেখতে পারেন। নিজের নেশাকে গরিমান্বিত করতে গিয়ে বহু তরুণীকে প্রাণঘাতী নেশার দিকে ঠেলে দেওয়ার পাশাপাশি নারীর ব্যক্তি-স্বাধীনতার গুরুতর বিষয়টিকে লঘু করে ফেললেন না তো?
হয়ত ভাবছেন, সব কিছু জেনেও ব্যক্তিগত মৃত্যু ও ব্যাধি বেছে নেওয়ার অধিকার আপনার আছে। বেশ। তাহলে আপনি কি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন যে দেশের আর্থিক মন্দা এবং আপনার ক্রয়ক্ষমতা যেখানেই পৌঁছক না কেন, অসুস্থ অবস্থায় সমাজ বা সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য প্রত্যাশা করবেন না? যদি প্রত্যাশা মরে না গিয়ে থাকে, তবে ভেবে দেখুন পলিথিন ফেলে নর্দমা ভর্তি করা, গাছ কেটে ফেলা, হাসপাতালে শব্দবাজি ফাটানোর মতোই ধূমপান করে ক্যান্সার বা হৃদরোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি করাকেও একদিক থেকে সামাজিক অপরাধ ভাবা যায়।
মৃত্যুর সংখ্যাটাও বড় কম নয়। আর মাত্র এক দশক পরে তা দাঁড়াবে প্রতি বছরে এক কোটি। রোগীর সংখ্যা তার বহুগুণ। সেই চাপ সামলাতে গেলে ধূমপান নামক ব্যাধিটির চিকিৎসা করতে হবে এখনই। সুখের কথা হলো, চিকিৎসা সম্ভব। বেশিরভাগ মানুষের ধূমপান ছাড়তে কোনো ওষুধ লাগে না। যাঁরা অত সহজে পারেন না, তাঁদের জন্য কার্যকর ওষুধ আছে। অবশ্য সেই চিকিৎসা ব্যক্তিগত স্তরে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অসদিচ্ছার চিকিৎসার পদ্ধতি আলাদা।