'ভাইরাল' ভাইরাসে আক্রান্ত সমাজ, ঠিক ভুল একাকার

পাশাপাশি দুটি ছবি। একটিতে ঐশীর ডান হাতে ব্যান্ডেজ, আর একটি স্পষ্টতই মিরর ইমেজ, সেখানে ব্যান্ডেজ বাঁ হাতে। ছবির ক্যাপশন, 'জেএনইউ হলো নাটক শেখার জায়গা। এই জন্যেই ফিল্মের লোকজন ওখানে যাচ্ছে'।

পাশাপাশি দুটি ছবি। একটিতে ঐশীর ডান হাতে ব্যান্ডেজ, আর একটি স্পষ্টতই মিরর ইমেজ, সেখানে ব্যান্ডেজ বাঁ হাতে। ছবির ক্যাপশন, 'জেএনইউ হলো নাটক শেখার জায়গা। এই জন্যেই ফিল্মের লোকজন ওখানে যাচ্ছে'।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
fake news aishe ghosh

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

আমরা কি ক্রমশ এক দায়িত্বজ্ঞানহীন, অন্ধ, অযৌক্তিক, চেতনাহীন পথে ধেয়ে চলেছি? সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের কার্যকলাপ তো সেদিকেই ইঙ্গিত করে। কিছু একটা পেলেই হলো। তাকে আরও লোকজনের কাছে পাঠিয়ে দাও, ফেসবুক ওয়ালে, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শেয়ার করো। বিষয়ের সত্যতা যাচাইয়ের প্রশ্ন নেই। বিষয়টা ছড়িয়ে পড়ার ফলে কী কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে চিন্তা নেই। যেন স্মার্টফোন হাতে আছে, শুধু তো একবার ছুঁয়ে দেওয়া। ব্যস, কাজ হয়ে গেল। কাজটা কী করে ফেললাম, মানুষের ওপর তার কী প্রভাব পড়তে পারে, কী পরিমান ক্ষতি হতে পারে সমাজের, কিচ্ছু ভাবার দরকার নেই।

Advertisment

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, গত এক-দু'বছরে এই যে কোনও বিষয় চোখ-কান বুজে ভাইরাল করার প্রবণতা একেবারে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নির্ভেজাল গসিপ থেকে উদ্দেশ্যমূলক বানানো ও বিকৃত তথ্য ছড়ানো। এই উদ্দেশ্য ব্যাপারটাও বিবিধ। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য তো আছেই। তাঁদের নিয়ে অহরহ মাত্রাছাড়া ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-তামাশা তো হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ও ফেসবুক দেওয়ালের ভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানিং। এছাড়াও আছে। গায়িকা রানু মন্ডলের উত্থান, রাজনীতির আঙ্গিনায় পা রাখার পর অভিনেত্রী মিমি-নুসরতকে নিয়ে ট্রোল, নোবেলজয়ী অমর্ত্য-অভিজিতের বিদেশিনী স্ত্রী সাহচর্য (নোবেলপ্রাপ্তির চেয়েও বেশি গুরুত্বে) ইত্যাদি ইত্যাদি। চর্চায় কী কী আছে বলার দরকার পড়ে না। কী নেই, সেটাই খুঁজতে গেলে বাজার উজাড় হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন: জেএনইউ কী শেখাল? হয় বশ্যতা, নয় ধ্বংস

এইসব বিকৃত ধারাবাহিকতা মেনেই সাম্প্রতিক সময়ে ভাইরালচক্রে জায়গা করে নিয়েছে ঐশী ঘোষ সম্পর্কে আলোচনা। জেএনইউ ক্যাম্পাসে সুপরিকল্পিত হামলা, ছাত্রনেতা ঐশী ঘোষ ও আরও কয়েকজনের আক্রান্ত হওয়ার পর দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শুধু দেশ কেন, দেশের বাইরে থেকেও নিন্দা ও সমালোচনার বার্তা আসে। দেশ ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে থাকা জেএনইউ-র কৃতি প্রাক্তনীরাও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। যাঁদের অন্যতম নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisment

আর তারপরেই একটি চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে ঐশীর বিরুদ্ধে। এক, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন। দুই, তার ভাঙা হাত, ডান না বাঁ, সত্যি কোন হাত ভেঙেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। যেটা সব থেকে চিন্তার, এরপরই এই বিষয়টি বিপুল হারে ভাইরাল হতে থাকে। সোশ্যাল সাইটে বিচরণকারী জনগণ দায়িত্ব নিয়ে একটি অন্যায় ও অকিঞ্চিৎকর বিষয়কে নির্বোধের মতো নির্বিচারে ছড়িয়ে দেন।

যাঁরা ঐশী ঘোষের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষত ফেসবুক কাঁপিয়ে ফেলছেন, তাঁদের সামনে একটাই প্রশ্ন রাখতে চাই। যথোপযুক্ত যোগ্যতা ছাড়া ঐশী কেমন করে জেএনইউ-এর মতো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রথম সারির একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ছাড়পত্র পায়? বলা বাহুল্য, প্রশ্নটা কতখানি অবান্তর, সেটা প্রশ্নকর্তারা নিজেরাও জানেন। এটা শুধু অহেতুক ঐশীকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা। তার অপরাধ, সে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেছে। সেই উপাচার্য, যিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের সুরক্ষা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ! এই দাবীও অবশ্য ঐশীর একার নয়। জেএনইউ-এর ভিতরে-বাইরে সর্বত্র এই দাবীতে সোচ্চার মানুষ। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই ঐশী শিক্ষাগত ক্ষেত্রে পিছিয়ে, তাহলেও কি অপরাধীদের ক্যাম্পাসে ঢুকে হামলা চালানোর অধিকার জন্মায়? এই যুক্তিতেও কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়।

আরও পড়ুন: বিপর্যয় মোকাবিলা: কী পারা যায়, কী পারা যায় না

পাশাপাশি দুটি ছবি। একটিতে ঐশীর ডান হাতে ব্যান্ডেজ, আর একটি স্পষ্টতই মিরর ইমেজ, সেখানে ব্যান্ডেজ বাঁ হাতে। ছবির ক্যাপশন, 'জেএনইউ হলো নাটক শেখার জায়গা। এই জন্যেই ফিল্মের লোকজন ওখানে যাচ্ছে'। এটা আবার বলিউডের পরিচালক ও অভিনেতাদের টেনে বলা। অনুরাগ কাশ্যপ, দীপিকা পাড়ুকোন, স্বরা ভাস্কর, দিয়া মির্জা, রাজকুমার রাও প্রমুখ যেহেতু প্রতিবাদ করছেন! দীপিকা তো জেএনইউ-তে হাজিরই হয়ে যান প্রতিবাদস্বরূপ। তাঁকে নিয়ে আবার আলাদা করে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পোস্ট ভাইরাল।

মোদ্দা কথা, ঐশীর হাত ভাঙা নিয়েও তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা। হাত ভাঙার ঘটনাটা নাকি ঐশী ও তার সহযোগীদের নাটক। কিন্তু তাদের দিক থেকে এটা করার কোনও দরকার আছে কি? দিল্লী এইমস ঐশীর আঘাত প্রসঙ্গে রিপোর্টে পরিষ্কার যা লেখার লিখেছে। এ নিয়ে কোনও সংশয়ই ছিল না। হঠাৎ করে কেউ বা কারা ঐশীর এই ডান-বাঁ বিষয়ে হাস্যকর ইঙ্গিতপূর্ণ ছবি বানিয়ে ঘটনার গুরুত্ব তুচ্ছ করে, তাকে ভাইরাল করে দিল।

কথা হলো, এগুলো ভাইরাল করেন কারা? নিশ্চিতভাবে আমি-আপনি। যারা নিজেদের শিক্ষিত ও বোধযুক্ত বলে দাবি করি। একটি বিষয় ফরোয়ার্ড করার আগে পরখ করার চেষ্টা করি না। এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। এমন এক পরিবেশে বড় হয়েছি, যেখানে জরুরি কারণে ফর্ম ফিলআপের বাইরে আমি কোন ধর্মের অন্তর্গত, তা আলাদা করে মনে রাখার প্রয়োজন পড়েনি। ইদানীং দেখছি, পরিচিত অনেকেই মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন আমি কোন ধর্মাবলম্বী! হ্যাঁ, ওই হোয়াটসঅ্যাপে ফরোয়ার্ড করা মেসেজের মাধ্যমেই। সেখানে হনুমান চালিশা থেকে শিব চতুর্দশী, রাম নাম, মা শীতলা বা সন্তোষী মাতা, সবই থাকে। বিপরীতভাবে একটি বিশেষ ধর্ম ও সম্প্রদায়ের শ্রাদ্ধও থাকে। এগুলো অগ্রাহ্য করা আজকাল অভ্যাস হয়ে গেছে। কাজ একটাই, দেখলেই ডিলিট করো।

আরও পড়ুন: পুলিশ, প্রশাসন, এবং ভিলেনের মুখোশ

কিন্তু সাম্প্রতিক একটি মেসেজ রীতিমতো হতভম্ব করে দিল। কারণ দুটো। এক, সেটা এসেছে একজন অযাচিত মানুষের কাছ থেকে। এমন এক মানুষ যাঁকে আমি উদার ভাবালম্বী হিসেবেই জানতাম। দুই, মেসেজের বিষয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন রচনায় আর একটি সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। যে মানুষটা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে রাখি-বন্ধন উৎসবকে নতুন আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলায়, তিনি এভাবে ভাবতেন? মোটেই না। আসলে তাঁর নামটাকে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।

ভেবে আতঙ্কিত হলাম, আমার মতো অনেকেই এটা পাবেন এবং নাচতে নাচতে ফরোয়ার্ড করবেন। পুলকিত হবেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে দলে পেয়ে। বিদ্বেষে বিষাক্ত, বিকৃত তথ্য ছড়ানোর আগে একবারও নিজেদের প্রশ্ন করবেন না, কেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও তৎপরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ তথা ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচরণকারীরা শুধু নন, দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় কেউই কম যান না। নেতাদের ভাষা ও ভাষণে রুচির চরম অধোগতি আজকাল ডালভাত। কেউ কেউ রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। সেই রেকর্ড সৃষ্টির ভিডিওগুলিও তুমুলভাবে ভাইরাল হয়। সম্প্রতি এক প্রথমসারির টিভি চ্যানেলের পক্ষ থেকে এমনই এক ভিডিও প্রদর্শনের সময় সংবাদ পাঠক বললেন, "আমরা এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করিনি।" এর মানে কী? যাচাই করো নি তো দেখাচ্ছ কেন? যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টিকারী একটি ভিডিও যদি সংবাদমাধ্যমই এভাবে 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' করে বাজারে ছাড়ে লোকজনকে খাওযানোর উদ্দেশ্যে, তবে নিয়ন্ত্রণহীন সোশ্যাল মিডিয়া কী করতে পারে, বলার অপেক্ষা রাখে না।

নিয়ন্ত্রণ! এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আজ। আর এটা অন্য কেউ বলার জন্য নয়, আইন-প্রশাসনের ভয়ে নয়, নিজের বিবেচনা দিয়ে রপ্ত করতে হবে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, যিনি যেখানে আছেন, কিছু ফরোয়ার্ড করার আগে দয়া করে ভাবুন তার প্রভাব সম্পর্কে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি তাদের ব্যবসা করছে, করবে। তাদের ব্যবসাকে যারা কাজে লাগানোর, লাগাবে। আপনি মাঝখান থেকে কোনও ভুল ভাবনার শিকার হচ্ছেন না তো? অজান্তেই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন না তো? বিশ্বাসঘাতকতা করছেন না তো নিজের বোধ, বুদ্ধি, চেতনা ও মননের সঙ্গে?

প্রযুক্তির আশীর্বাদ ইন্টারনেট আজ আমাদের মুঠোয়। মুঠোফোনে জগৎ। সেই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। এগিয়ে যাওয়ার পথে পিছিয়ে যাচ্ছি না তো কোথাও? একদা সভ্যতার অন্য এক সংকট আবিষ্কার করে হতাশ ও বিমর্ষ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বেঁচে থাকলে নতুন আঙ্গিকে লিখতেন কি 'সভ্যতার সংকট'? হয়তো। তাঁর উত্তরাধিকার মেনে আমরা কি এটুকুও উপলব্ধি করতে পারি না? পারি না সচেতন এক অভ্যাস গড়ে তুলতে? সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর মাধ্যমে অনেকেই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কাজ করছেন। আসুন সেই কাজগুলোতেই অনুপ্রাণিত হই। বিভ্রান্তিমূলক বিষয়গুলি ভাইরাল হওয়া বন্ধ হোক। এ কাজ আমাদেরই করতে হবে। করতেই হবে।

JNU fake news