Advertisment

'তাতে আমার কী?' বলার সময় শেষ

পিএম ২.৫ এবং পিএম ১০ হলো বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার দুই প্রজাতি, তবে পরিভাষার কচকচি ঘাঁটা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আসলে যাঁরা ভাবছেন, "এতে আমার কী?", এই লেখা তাঁদের উদ্দেশে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
global air pollution

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

একটা তালিকা দিয়ে শুরু করা যাক। নিচের নামগুলো মন দিয়ে দেখুন, বাকিটা তারপর বলছি -

Advertisment

১। কানপুর, ভারত

২। ফরিদাবাদ, ভারত

৩। গয়া, ভারত

৪। বেনারস, ভারত

৫। পাটনা, ভারত

৬। দিল্লি, ভারত

৭। লখনৌ, ভারত

৮। বামেন্ডা, ক্যামেরুন

৯। আগ্রা, ভারত

১০। গুড়গাঁও, ভারত

১১। মজফফরপুর, ভারত

১২। পেশাওয়ার, পাকিস্তান

১৩। রাওয়ালপিণ্ডি, পাকিস্তান

১৪। জয়পুর, ভারত

১৫। কাম্পালা, উগান্ডা

১৬। পাটিয়ালা, ভারত

১৭। যোধপুর, ভারত

১৮। নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ

১৯। বাওদিং, চিন

২০। দোহা, কাতার

কিছু বুঝলেন না সম্ভবত। তাহলে বলি, ওপরে দেওয়া হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত ২০টি শহরের তালিকা। এবং এই সার্টিফিকেট দিচ্ছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লুএইচও বা WHO)। এই দূষণ অবশ্য শুধুমাত্র পিএম ২.৫-এর নিরিখে, পিএম ১০-এর নয়, তবে পিএম ১০-এর তালিকাতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে ভারতের।

যাঁরা এখনও জানেন না, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই, পিএম ২.৫ এবং পিএম ১০ হলো বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার দুই প্রজাতি, যাদের সম্পর্কে কিছুটা বিশদ জানতে পারবেন এখানে। তবে পরিভাষার কচকচি ঘাঁটা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। যেমন উদ্দেশ্য নয় শুধুমাত্র বায়ুমণ্ডলের দূষণের ফিরিস্তি দেওয়া। আসলে যাঁরা এই তালিকাটি দেখে ভাবছেন, "এতে আমার কী?", এই লেখা তাঁদের উদ্দেশে।

যেমন ধরুন, অ্যামাজনের জঙ্গলে বিধ্বংসী আগুন লাগল, পুড়ে গেল হাজার হাজার একর জুড়ে গাছপালা, পশুপাখি। অথবা দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া উপকূলের কাছে তেলের ট্যাঙ্কারের ধাক্কা লাগল পাথরের সঙ্গে, সমুদ্রের জলে ছড়িয়ে পড়ল লক্ষ লক্ষ গ্যালন অপরিশোধিত তেল বা 'ক্রুড অয়েল'। বা জাপানে বিশাল সুনামির ধাক্কায় ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো সেদেশের একটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট। এগুলোর একটাও কিন্তু কল্পিত ঘটনা নয়। সবই বাস্তবে ঘটেছে, গত দুই দশকের বিভিন্ন সময়ে। আরও অনেক উদাহরণ আছে, বলাই বাহুল্য, কিন্তু তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই।

উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলো, যাঁরা এসব পড়ে ভাবছেন, "তাতে আমার কী?", তাঁদের বলা, অ্যামাজনের জঙ্গলে যে পরিমাণ গাছ রয়েছে, তা থেকে আসে আমাদের বায়ুমণ্ডলের ২০ শতাংশ অক্সিজেন। অতএব এই অঞ্চলটিকে 'পৃথিবীর ফুসফুস' বললে অত্যুক্তি করা হয় না। কাজেই 'ওখানে' গাছ পুড়ছে বলে 'এখানে' নিশ্চিন্তে বসে থাকবেন, তা হয় না।

জাপানে নিউক্লিয়ার প্লান্ট দুর্ঘটনার ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের জলে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়, ক্যানসার-বাহী রাসায়নিক ছড়ায়, তা সাফ করে উঠতে লাগবে আরও অন্তত ৩০-৪০ বছর। এই রাসায়নিক যাতে আর না ছড়ায়, তার জন্য বরফের দেওয়াল তুলতে হয়েছে, কারণ প্রশান্ত মহাসাগরের জল যে অন্যান্য সাগর-মহাসাগরের জলেও ছড়াবে, তা বলা বাহুল্য।

কথা বেশি না বাড়িয়ে এটুকুই বলার, জাতিগত ভাবে কলম্বিয়া উপকূলের জলে তেল ভাসার সঙ্গে ছটপূজার পরদিন রবীন্দ্র সরোবরের তেলতেলে জলে মরা মাছ বা কাছিমের ভেসে ওঠার কোনও পার্থক্য নেই। দুটিই মনুষ্যকৃত বা 'ম্যান মেড' দুর্ঘটনা, দুটির ফলেই আমাদের যে দুর্ভোগ আসতে চলেছে, তা সম্পর্কে আমরা সমান অচেতন।

হয়তো আমাদের কিছু যায় আসে না ওপরের দূষিত শহরের তালিকাতেও, কারণ কলকাতা তো তাতে নেই। অথচ সামান্য একটা গুগল সার্চ দিলেই পাবেন হাতে গরম পরিসংখ্যান, যা থেকে বুঝতে পারবেন, কলকাতার বাতাস ঠিক কতটা দূষিত (এই লেখা জমা দেওয়ার সময় দিল্লির চেয়েও বেশি), বা কলকাতায় গাছ কাটার হার ঠিক কতটা ভীতিপ্রদ। মনে রাখবেন, যশোর রোডের সুপ্রাচীন মহীরুহগুলিকে রক্ষা করতে পথে নেমেছেন যে তরুণ-তরুণীর দল, কীভাবে শত বাধা সত্ত্বেও তাঁরা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের অভিযান।

গাছ লাগালে শুধু অক্সিজেনের সঞ্চার হয় না, বাতাসে দূষণ কমে, কারণ গাছেরা শুষে নেয় দূষণ সৃষ্টিকারী পদার্থ। কিন্তু তাতে আমার কী? আমার বাড়ির পাশের গাছটা তো রয়েছে যেমন ছিল। জলের অভাবে শুকিয়ে মরতে বসেছে কেপ টাউনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর, কিন্তু তাতে আমার বাড়ির বেসিনের কল বেশিক্ষণ খুলে না রাখার কী হলো? একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন, 'তাতে আমার কী' বলার দিন কিন্তু আর নেই। এখনও যদি ধ্বংস রুখতে উদ্যোগী না হন, তবে হয়তো ধ্বংসই আপনার এবং আপনার পরবর্তী প্রজন্মের প্রাপ্য।

পরিশেষে স্রেফ একটা কথা বলার আছে - যাদব পায়েং বলে কারোর নাম শুনেছেন? পদ্মশ্রী যাদব পায়েং? খোঁজ নিয়ে দেখুন, আসামের বনবিভাগের এই কর্মী একা হাতে ১,৩০০ একরের বেশি জঙ্গলের জন্ম দিয়েছেন। দুই দশক ধরে। 'তাতে আমার কী'-র পরের প্রশ্নটাই যদি 'তাতে আমি কী করতে পারি?' হয়, তাই একথা বলা।

আরও একটা কথা। চেরনোবিল (Chernobyl) দুর্ঘটনার কথা জানেন নিশ্চয়ই? নিউক্লিয়ার ডিজাস্টারের পরাকাষ্ঠা ধরা হয় একদা সোভিয়েত ইউনিয়নের এই নিউক্লিয়ার প্লান্টকে। আবারও খোঁজ নিয়ে দেখুন, আজ সেখানে সবুজে সবুজ, প্রজাপতি উড়ছে ফুল থেকে ফুলে, দূষণের চিহ্নমাত্র নেই। কারণ আশির দশকের ওই দুর্ঘটনার পর থেকে মানুষের পা পড়ে নি ওই অঞ্চলে। প্রকৃতি তাই স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন।

সবুজ ঠিক পথ খুঁজে নেয়। যদি আমরা বাগড়া না দিই।

Advertisment