একটা ছবি দেখলাম সকালবেলায়। পটের সামনের দিক জোড়া নীল নীল ফুলের ঝাড়। দূরে গভীর নীল জল আর আকাশ। ডানদিক দিয়ে এসে মিশেছে অন্য একটি জলের ধারা। কোন একটা নদীর মোহনা। এইখানে এসে ছবিটা গোলমাল হয়ে গেছে। যেখানে জলের ধারা এসে মিশবার কথা সেইখানে ঈষৎ চওড়া তটভূমি জুড়ে পড়ে আছে প্লাস্টিকের স্তূপ। বিছিয়ে আছে। পৃথিবীজুড়ে, আমার দেশ জুড়ে সমস্ত শিক্ষিত লোক বলছেন প্লাস্টিকের বিপদের কথা। প্লাস্টিকের ভয়াবহতার কথা। কীভাবে এই প্রাকৃতিক জল, স্থল ভরে যাচ্ছে প্লাস্টিকে। এমনকি খাবারের সঙ্গে জীবশরীরে মিশে যাচ্ছে মিহি গুঁড়ো। তবু আমরা একে আটকাতে পারছিনা। বন্ধ করতে পারছি না আমাদের প্রতিদিনের জীবন থেকে পলিথিনের প্যাকেট, পলিথিন প্যাকেজিং র্যাপার, প্লেট গ্লাস কৌটো। ইদানিং কমবার বদলে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা মাপের সাদা ঢাকনাওয়ালা কৌটো যা আসে রান্না খাবার কিনলে, বিনামূল্যে। শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়ির রান্নাঘর ভরে উঠছে এই কৌটোয়। প্রথমে বেশ লেগেছিল, আরে! এমন ছিমছাম শক্ত বন্ধ হওয়া কৌটোগুলো পাওয়া যাচ্ছে এক্কেবারে ফ্রি! সুতরাং কমবার বদলে শুরু হয়ে গেল আরেকটি একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক-বস্তুর উৎপাদন। এগুলো শ্রম বাঁচায়। মাজাঘষার দরকার নেই, খাবারটা ঢেলে নিয়ে কৌটোটা ফেলে দাও। ওয়েস্ট-বাস্কেটে পলিথিন প্যাকেটের মধ্যে করে চলে যাক। ইউজ অ্যান্ড থ্রো।
শাহিনবাগের দাদিরা লিখছেন ফেমিনিজমের চতুর্থ অধ্যায়
কী করে প্লাস্টিক ছাড়ব আমি? রান্নাঘরের তাক, শোবার ঘরের শেলফ, ড্রেসিংটেবিলের মহামূল্য মাথা আর ড্রয়ার ভরে আছে, ভরে উঠছে প্লাস্টিক আর পলিথিনে। এখন কি আর কম করা যায়! কোথা থেকে, ঠিক কোনখান থেকে শুরু করব বন্ধ করা? ওই ইউজ অ্যান্ড থ্রো জিনিসগুলো ব্যবহার না করলে ঝামেলা বেড়ে যাবে অনেক। পরিশ্রম বাড়বে। অতো ঘরের কাজের সময় কোথায়?
এইভাবেই শুরু হয়েছিল আরো অনেক জিনিস যা আজ আমাদের জীবনকে আপাদমস্তক পালটে দিয়েছে। পঞ্চাশবছর আগে আমাদের কৃষককে দিনের পর দিন ধরে, সরকারি স্তর থেকে পর্যন্ত বলা হতে লেগেছিল- তুমি কৃষিকাজের নিয়ম জানো না, তাই তুমি দরিদ্র। তুমি চিরদুঃখী। নতুন চাষের নিয়ম ও কৌশল শেখানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। এভাবে চাষ করলেই তোমার সব দুঃখ ঘুচে যাবে। ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে আজ আমরা জানি বহুজাতিক কৃষিদ্রব্য-রাসায়নিক সার বীজ কীটনাশক- উৎপাদক কোম্পানিগুলোর লাভ ও আমাদের দেশের ধ্বংস হয়ে যাওয়া জমি, দূষিত জলধার, লক্ষ লক্ষ পাম্পের ব্যবসার রমরমার সঙ্গে বিপন্ন হওয়া ভূজলের স্তর, চড়ার চেয়েও চড়া কীটনাশকের দাপটে ছিঁড়ে যাওয়া বাস্তুতন্ত্রের হিসেব। উপরি পাওনা কয়েক লক্ষ চাষীর আত্মহত্যা, নিজেদের অসংখ্য রোগব্যাধি। এবং গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবার নামে দেশ জোড়া অসংখ্য নদীর মৃতদেহ, জঙ্গলের পর জঙ্গল কেটে, গ্রাম উপড়ে ফেলে কার্বনজ্বালানি বার করে আনার বীভৎস উন্নয়ন।
স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে সময়োপযোগী বিচিত্র স্বাদু ও পুষ্টিকর খাবারের যে বিপুল সম্ভার গ্রামীণ মেয়েদের আয়ত্ত ছিল, যা বেচে তাদের অনেকে যৎসামান্য উপার্জনের সংগে শহরে সেই শাক-মূল-কন্দ-ফুলফলের বৈচিত্র্য, পুষ্টি পৌঁছে দিতেন,তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। গ্রামে সেইসব খোলা জায়গা নেই আর, পরিবর্তিত ভূমিরূপের সঙ্গে সঙ্গে তা গিয়েছে ‘আরো বেশি ফসল ফলাও’এর কবলে। এখন শাকপাতাকন্দমূল সবেরই উৎপাদন ঘটে সার আর বড়ো মালিকানার তত্ত্বাবধানে। সেই স্বাভাবিক খাদ্যসংস্কৃতি যে একটি সমাজের অন্যতম প্রধান পরিচয় ছিল সে কথা বোঝা যায় কেবল তার অভাবে। গ্রাম, যেখানে প্রকৃতির মুখ ছিল অনেকখানি খোলা, যেখান থেকে তার দাক্ষিণ্য এসে পৌঁছত শহরের দৈনন্দিন জীবনে, ক্রমশ তার জায়গা নিয়েছে আরো প্লাস্টিক, আরো প্যাকেট। এমনকি ‘ভেষজ’ বহনকারী প্লাস্টিকের মোড়ক।
ঠিক একইরকম ভাবে, মনে পড়ে, বছর কুড়ি আগে আটই মার্চের এক পক্ষকাল আগে থেকে ‘নারীদিবস’এর প্রচারের দায়িত্ব নিতেন বেশ কিছু বহুজাতিক কোম্পানি। বিখ্যাত বহুজাতিক প্রসাধন কোম্পানির বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত প্রায় উড়ে যাওয়া অতি তন্বী এলোচুল নারীমূর্তিটি এক স্বপ্নকল্প তৈরি করেছিল। একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনে দেখা যেত তরুণী গৃহিণীটি কোমরে আঁচল জড়িয়ে ছুঁড়ে ছূঁড়ে ফেলছেন পুরোন উনুন, পুরোন ফ্রিজ, পুরোন প্রেশার কুকার হাঁড়ি কড়াই, আর পাশে দাঁড়ানো পুরুষ হাসিমুখে শূন্য থেকে ধরে আনছেন নতুন চকচকে বস্তুসম্ভার। তুলে দিচ্ছেন সুন্দরীর করকমলে। কখনও বা মার্চ মাসের শুরু থেকে দোকানে দোকানে লেখা থাকত সেই অত্যাশ্চর্য বাণী, ‘আপনি যদি আপনার স্ত্রীকে ভালোবাসেন...’! ভালোবাসার কেবল দিনক্ষণ তারিখ নয়, উপায়ও বলে দেওয়া হল নির্দিষ্ট করে। যেন ঠিক থিম ম্যারেজ! একশতাধিক বছর আগে যে মেয়েরা সমানাধিকারের দাবিতে মিছিল করে, পথে নেমে, নিজেদের মর্যাদা আদায় করেছিলেন সম্মিলিতভাবে, সেই উজ্জ্বল দিনটি শেষ পর্যন্ত কেবল বহুজাতিক কোম্পানি নয়, নারীমর্যাদার বিরোধীরা কিনে নিল নিজেদের ‘প্রডাক্ট’ ও সংস্কৃতি প্রচারের ঊর্বর ক্ষেত্র হিসাবে। দেশের উচ্চতম যে অছিমণ্ডল দিনের পর দিন অধিকার ও সুরক্ষার দাবিতে পথে বসে থাকা মেয়েদের অগ্রাহ্য আর অসম্মান করেন, আজ তাঁরাই কিন্তু নিজেদের দফতরগুলিতে ‘নারীদিবস পালন’কে আবশ্যিক বলে ঘোষণা করেছেন। এর কোন কারণ নিশ্চয়ই আছে।
অপরাধী ‘মা’, নেপথ্যে নারীত্ব নয়, আছে মাতৃত্বের বিকৃতি
রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক কঠিন সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশ। সমস্ত পৃথিবীর সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বিকট বিপদ প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। এই বিপদগুলো প্রত্যেকটি অপরের সঙ্গে জড়ানো। ঠিক এই সময়েই সবচেয়ে জরুরি যথাসাধ্য বেশি বেশি মানুষের একসঙ্গে জড়ো হয়ে এই সব সঙ্কটকে আটকাবার চেষ্টা করা। সামগ্রিকভাবে, নিজেদের দৈনন্দিন আচরণে সেই বাধাদানকে নিয়ে না আসতে পারলে মানুষের সমাজ সত্যিই খাদের মুখোমুখি দাঁড়ানো। মেয়েদের ভালোমন্দ কি কোনোভাবে সেই সামাজিক স্থিতির বাইরে নিরালম্ব ভাবে থাকতে পারে?
কয়েকদিন আগে একজন বলছিলেন সারাক্ষণের কলের জল আর রান্নার গ্যাস পাওয়ার ফলে মেয়েদের গৃহশ্রম অনেক কমে গেছে। তিনি নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ সদিচ্ছা নিয়ে নিজের জ্ঞানমতই বলছিলেন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল সেই সত্তর দশকের প্রতিধ্বনি শুনছি যখন চাষীদের বলা হচ্ছিল তাদের কম পরিশ্রমে অঢেল ফসলের লাভ পাবার কথা। গ্রামের মরে-যাওয়া জমিগুলো সেই মহালাভের কৃষির পর উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে এখন প্রমোটারির অনন্ত সম্ভাবনা খুলে দিচ্ছে। স্বাভাবিক জীবিকা হারানো অসংখ্য মানুষ সেই মাটির মৃতদেহ থেকে খুদকুঁড়ো খুটে বাঁচছেন বা মরছেন। গ্রামের ধ্বংস থেকে শহর বিশ্লিষ্ট থাকবে, এরকমটা সম্ভব নয়। ফলে শহর উপছে উঠছে আবর্জনায়, অতিরেকে, অসুস্থ লোভ আর দুর্নীতিতে।
এইখানে সত্যিই কি আছে কোনো ব্যক্তিগত উন্নতিলাভের উপায়? কোনো ভালো থাকা? বিশাল আর অসামান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার এই দেশ আজ প্রাকৃতিক বিশৃঙ্খলার শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আমরা বিশ্বাস করছি ‘মেয়েদের ভালো থাকা’য়? কোন মেয়েদের? যারা পরিবেশ সঙ্কটের জন্য কিংবা জীবিকা হারিয়ে উচ্ছেদ হয়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন ঘরপরিবার নিয়ে, ঘুরে বেড়াচ্ছেন ছেঁড়া কাগজের স্তূপের মত স্থান থেকে স্থানান্তরে? যে মেয়েরা বিক্রি হতে কিংবা নিজেদের ভাড়া খাটাতে বাধ্য হন? সেইসব পরিবারের শিশু আর পুরুষদের থেকে আলাদা সেই মেয়েদের স্বার্থ? অধিকার? পরিচয়? যে মেয়েরা ‘কলের জল’এ কাজ সারেন আর যারা খাবার জলের উৎসগুলি ছেড়ে পরিবারের পুরুষদের সঙ্গে বাচ্চাদের হাত ধরে দূরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, একইরকম উন্নতির সুযোগ দরকার তাঁদের?
আজ যে মেয়েরা নিজেদের এলাকা থেকে বিনামূল্যে নানারকম স্থানীয় জ্বালানি সংগ্রহ করে রান্নার কাজ শেষ করেন, কাল তাঁর জ্বালানির ভর্তুকি উঠে যাবে, শুরু হবে দাম বাড়তে থাকা অথচ তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে যাবে নিজস্ব উপাদানগুলির অধিকার, আমাদের জলের অধিকার, ভূমির অধিকার, নিজের মত জীবনযাপনের অধিকারের মতই। মেয়েরা আর পুরুষরা, মেয়েরা আর মেয়েরা- এরা আজকের এই তীব্র সঙ্কটের দিনকালেও কি পরস্পর বিবদমান ভিন্নপক্ষ? একেবারে ভিন্ন এঁদের সামগ্রিক ভালো থাকার স্বার্থ?
যেখানে প্রয়োজন ছিল পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহযোগিতা, সেখানে এসে দাঁড়াচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার, পারস্পরিক দোষারোপের ভাবনা। সেই ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য যখন ওপর থেকেও উৎসাহ আসে, আমরা কি তখন আরেকবার নতুন করে ভাবব? খেয়াল করব কি কেমন ভাবে গত বিশ-ত্রিশ বছরে শ্রমিকদিবস পালনের জায়গা নিয়েছে নারীদিবস পালন?
বাস্তবে ক্রমশ কমে আসছে নারীর সামাজিক অধিকার। আন্তর্জাতিক প্রচারের ক্যানভাসে পয়লা মে’ কে পেছনে ফেলেছে ৮ই মার্চ। এর রাজনীতি নিয়ে কি ভাবব?
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে