Advertisment

'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' বললেই কাজ হয়ে যায় কি?

কাদের জন্য এই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'? দেশের কত শতাংশ মানুষ এর সুবিধাভোগী হবেন? কোন কোন পেশার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
work from home india

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

পঞ্চম দফায় লকডাউন। একই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল আনলক পর্ব। বলা বাহুল্য, লকডাউন আর আনলকের মাঝখানে যে সময়টা, তাতে ভাইরাস আক্রমণের সমান্তরাল গুরুত্ব পেয়েছে যে বিষয়টি, তা হলো মানুষের রুটিরুজি। শোনা গেছে পেশাদারি ক্ষেত্রের নতুন অভিমুখের কথা, 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'। বাড়িতে বসে অনলাইনের মাধমে কাজ। একই সঙ্গে কর্ম ও কর্মীকে বাঁচিয়ে রাখার পথ। সব মিলিয়ে জীবন ও জীবিকার নতুন এক পরিভাষা।

Advertisment

কোভিড ১৯-এর আক্রমণ ও সেই কারণে দেশ জুড়ে লকডাউন হওয়ার পর প্রথম এদেশের মানুষ ব্যাপক হারে এই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত হন। শুরুতে কিছুটা অসুবিধা হলেও মানিয়ে নিতে হয় সকলকেই। ক্রমশ গৃহকর্ম ও পেশাদারি কাজকর্মের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে শিখে যান তাঁরা। অনেককেই বাড়িতে নিজেদের মতো করে অফিসের কাজের একটা পরিকাঠামোও তৈরি করে নিতে হয়। ব্যাপারটা ভাবলে প্রাথমিক অবস্থায় বেশ ইতিবাচক মনে হলেও, আদতে বিষয়টা তত সরল নয়। ভারতীয় জীবনযাপন যে অভ্যাসের অনুসারী ও অনুরাগী, সেখানে লোকজনের চিন্তায় এটাই থাকা স্বাভাবিক, 'কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে এবং আবার সেই অফিস-বাড়ি'। যদিও ঘটনার গতিপ্রকৃতি বলছে অন্য কথা।

এ ব্যাপারে বিস্তারে যাওয়ার আগে দেখে নেওয়া যাক, দেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে আনলক করে দেওয়ার মুহূর্তে পেশাদারি ক্ষেত্রটাকে ঠিক কিভাবে দেখছে সরকার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, জুনের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই খুলে যাচ্ছে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি অফিস ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। কিছু ইতিমধ্যেই খুলে গেছে। এক্ষেত্রে আলাদা করে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'-এর কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশ নেই । অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বেসরকারি সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ উপস্থিতির অনুমোদন দিলেও, যথাসম্ভব বাড়ি থেকে কাজের সুপারিশ করেছে।

আরও পড়ুন: করোনা-আমফান, এবং বাঙালির আত্মপরিচয় 

প্রসঙ্গত, অন্যান্য দেশও পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে নতুন নিয়ম নিয়ে আসছে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে চারদিনের সপ্তাহ অনুসারে কাজ শুরু করার কথা বলেছেন। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতেই দক্ষিণ কোরিয়া সরকার অনলাইনে বিভিন্ন ওয়ার্কশপ ও প্রশিক্ষণ চালনার ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছে। পাশাপাশি কর্মীদের আন্তর্জাতিক ও অন্তর্দেশিয় বিজনেস ট্রিপের পরিবর্তে ভিডিও ও ফোন কলের উপর নির্ভরশীল হতে বলা হচ্ছে ।

বিশ্বের বৃহৎ সংস্থাগুলির অনেকেই কোভিড ১৯ সংক্রমণের জেরে বদলাচ্ছে তাদের কর্ম সংস্কৃতি মাইক্রোসফট অক্টোবর এবং গুগল ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মীদের 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' চালু রাখছে। আর টেক জায়েন্ট টুইটার তো প্রথম আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ অনুমোদন করে। শুধু তাই নয়, কর্তৃপক্ষের শেষ সিদ্ধান্ত মতে, এই সংস্থার কর্মীরা স্থায়ীভাবে বাড়িতে বসে কাজ করতে পারবেন। ফেসবুকও সংস্থার কর্মীদের অনেককেই স্থায়ীভাবে বাড়ি থেকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে।

একটু খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ইউরোপ ও আমেরিকায় বহু আগেই এভাবে কাজ করার একটা ভাবনা বা পরিকাঠামো ছিল। এটা ঠিক, লকডাউনকে ঘিরে তার ব্যাপকতা নিশ্চিতরূপে বেড়েছে। এদেশেও বেশ কিছু কর্পোরেট সংস্থা, বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে, একই রকম চিন্তাভাবনা করছে। কয়েকটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইতিমধ্যেই এ বাবদ প্রয়োজনীয় আইনি পরিকাঠামো পরিবর্তনের কথাও বলতে শুরু করেছে।

কথা হলো, কাদের জন্য এই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'? দেশের কত শতাংশ মানুষ এর সুবিধাভোগী হবেন? কোন কোন পেশার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'? এখানে কয়েকটি বিষয় খুব পরিষ্কার। এর ফলে, সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ কর্মীসংখ্যা কমানোর একটা সুযোগ পাবেন। কমবে অফিস চালু রাখবার খরচ। লোকজন কম ভ্রমণ করবেন, অর্থাৎ যাতায়াত খরচাও কমবে। এই পুরো প্রক্রিয়াটার নিটফল ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, যা ইতিবাচক বলা যেতে পারে ততক্ষণই, যতক্ষণ সমাজের অধিক সংখ্যক মানুষ এতে উপকৃত হচ্ছেন।

আরও পড়ুন: ধর্মসংকট – একটি অনলাইন বৈঠকের বিবরণ

প্রযুক্তির আশীর্বাদ গত কয়েক দশক ধরেই দেখছে ভারতবাসী। সময়ের দাবি মেনেই এই প্রযুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছি আমরা। এ প্রসঙ্গে খুব মনে পড়ছে, প্রথম যেবার কম্পিউটার আসে সেই সময়ের কথা। এক বিরাট সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে যান। এই নিয়ে রাজনীতি ও বিতর্কও হয় প্রচুর। ক'জন নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করতে সক্ষম হন আর ক'জন অপারগ, তার পরিসংখ্যান নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও, বহু মানুষ যে বেকার হয়ে যান, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পরবর্তীকালে স্কুলে কম্পিউটার শিক্ষা আবশ্যক হয়ে ওঠার পর পরিস্থিতি কিছুটা সুস্থ জায়গায় আসে। এই যে পরিবর্তন, এটা শুরুতে বাধ্যতামূলক অর্থাৎ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমন একটা বার্তা বহন করলেও, এদেশের মানুষ একটা সময় কম্পিউটারের মাহাত্ম্য স্বীকার করে নেন। অর্থাৎ বিষয়টা বিতর্কে শুরু হলেও শেষে একটা ইতিবাচক রূপ নেয়।

মজার কথা হলো, মাঝে অনেকটা সময় পার হয়ে গেলেও এদেশের অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামোয় সেই অর্থে কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন কিন্তু হয়নি। কম্পিউটার, ইন্টারনেট পরিষেবা, স্মার্টফোন, মানুষের আয়ত্তে এসেছে। কিন্তু তার উৎকৃষ্টতম প্রয়োগ এখনও দেশের ক'জন মানুষের পেশাদারি-ভাবনায় প্রবেশ করেছে, তা ভাবার বিষয়। আর যাঁরা এই আধুনিক প্রযুক্তির আশীর্বাদ থেকে একেবারে বঞ্চিত, এমন মানুষের সংখ্যাটাও কম নয়। তাহলে ঘুরেফিরে এই প্রশ্ন উঠেই যায়, এই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' ঠিক কাদের জন্য? একজন মানুষের অক্ষর পরিচয় হবে, তারপর তো তিনি অনলাইন মাধ্যমে কাজ করতে সক্ষম হবেন!

আরও পড়ুন: কোভিড-১৯ ও ক্লিনিক্যাল মেডিসিন

স্বাধীনতার এত বছর পরেও দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ প্রাথমিক শিক্ষাটুকু পর্যন্ত পান না। যাঁরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন, তাঁদেরও ক'জনের বাড়িতে এই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'-এর পরিকাঠামো আছে? পরিকাঠামো থাকবে, তবেই না তাঁরা এই পদ্ধতিতে কাজ করবেন? এসব ছাড়ুন, মুষ্টিমেয় কয়েকটি ক্ষেত্র বাদ দিলে এদেশে এমন ক'টি পেশা আছে, যেখানে বাস্তবে এই পদ্ধতি অনুসরণ সম্ভব? দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতেও রয়েছে প্রচুর ছোট ছোট ফ্যাক্টরি, দোকান, ট্রেডিং সংস্থা। সেখানে এখনও ইন্টারনেট দূর, ফোনের পরিষেবাটাই ঠিকমতো নেই। তারা কি করবে?

বিপুলসংখ্যক হারে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' চালু করতে হলে শ্রম আইনেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। আট ঘণ্টা অফিসে কাজ করার যে নিয়ম, তার সঙ্গে বাড়িতে থেকে কাজ করার সময়ের তুল্যমূল্য বিচার কিভাবে করা সম্ভব? যদি আট ঘন্টা আবশ্যিক না হয়, তাহলে অনেকেই লাভবান হবেন নিঃসন্দেহে। কলেজ পড়ুয়া, গৃহবধূ, প্রতিবন্ধীরাও কাজ করতে পারবেন। কিন্তু তার জন্যও তো একটা বিশেষ পরিকাঠামো তৈরির প্রয়োজন। নীতি নির্ধারকদের সেই সদিচ্ছা আছে তো? কেউ যদি একাধিক সংস্থার হয়ে কাজ করেন, তাহলে তাঁর পেনশন ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিষয়টি কিভাবে নির্ধারিত হবে?

এমনিতেই বেতনের কাঠামো, অবসর নেওয়ার পর প্রাপ্য পেনশন বা প্রভিডেন্ট ফান্ড, ব্যাঙ্কের সুদ সমস্ত নিয়ে একেবারে অস্থির, অশান্ত ও অগোছালো এক অবস্থায় এদেশের সাধারণ চাকরিজীবী মানুষ। নতুন এই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' কতটা তাঁদের শুভার্থে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ তাই খুব অস্বাভাবিক নয়। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এই সুযোগে সংস্থার মালিকগোষ্ঠী বিপুলসংখ্যক কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে যাবে। আদতে এই প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে।

একটু তলিয়ে ভাবলেই এটাও মনে আসে, পেশাদারি কাজের ক্ষেত্রেও সত্যি কতটা সুবিধাজনক পরিস্থিতি আমরা তৈরি করতে পারি এই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' এর মাধ্যমে? তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম, যেখানে আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগের রমরমা, সেখানেও এই মুহূর্তে কর্মরতরা এতে একশো ভাগ স্বচ্ছন্দ নন। কী করেই বা  হবেন? অর্ধেক সময় এখানে ইন্টারনেট পরিষেবা যথাযথ কাজ করে না। ফলে তাঁদের কাজটাও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। নতুন কোনও পদ্ধতিকে প্রয়োগ ও গ্রহণ করার জন্য চাই সঠিক চিন্তাধারা, উন্নততম পরিকাঠামো, সর্বজনগ্রাহ্য একটা নীতি, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং পর্যাপ্ত সদিচ্ছা। স্মার্ট চিন্তা দোষের নয়। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ তাতে প্রকৃত লাভবান হবেন কিনা, সেটা ভাবার দায়িত্ব সরকার ও সংশ্লিষ্ট লোকজনের।

একদিকে পেশাদারি ক্ষেত্রে আধুনিক চিন্তাভাবনার হাতছানি। অন্যদিকে প্রতি পদক্ষেপে পরিকাঠামো জনিত অব্যবস্থা। এই পটভূমিতে আমরা ঠিক কোন অবস্থায়, তা বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এক 'আমফান'-ই যথেষ্ট। এখনও কলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চলে টেলিফোন ও ইন্টারনেট পরিষেবা স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ, আনলক হওয়ার ঠিক শুরুতে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি হবে, তারও প্রবল আশঙ্কা। 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' এক্ষেত্রে অনেকটাই সুরক্ষা কবচের কাজ করতে পারত। সর্বোপরি, দূর ভবিষ্যতে এদেশে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' সার্বিক স্তরে সফল করতে হলে, শিক্ষার বিস্তার একান্ত জরুরি। আর শুরুটা প্রাথমিক স্তর থেকেই করার, সেটাও বলা অতি আবশ্যক।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment